পানিতে আর রাজনীতিতে নাকাল মানুষ

বাংলাদেশের মানুষের জীবনে নানা কারণে দুর্গতি নেমে আসে। প্রকৃতির রোষে যেমন, তেমনি রাজনীতির ঝোড়ো হাওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ দুর্গত হয়। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, অতিবৃষ্টি, রোগবালাই, দুর্গতির অন্ত নেই। সেই সঙ্গে মড়ার উপরে খাড়ার ঘার মতো আছে রাজনীতি। আর সেই দুর্গতি উদ্ধারে যত ত্রাণ আসে তারও ভালো একটা অংশ চলে যায় খাদকদের পেটে।
এবার দেখা যাচ্ছে দুই শত্রুরই মুখোমুখি বাংলার মানুষ। সামনে নির্বাচন, তাই নির্বাচন নিয়ে রাজনীতি উত্তপ্ত। শেষ পর্যন্ত কী রূপ নেয়, কে জানে! তার ওপর শুরু হয়েছে বন্যা। বৃহত্তর সিলেটের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ বন্যাদুর্গত। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক জনের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। ত্রাণের আশায় মানুষ প্রতীক্ষায় থাকছে। পর্যাপ্ত দূরে থাক, ন্যূনতম প্রয়োজনও মিটছে না। উল্টো একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা এবং সরকারি দলের লোকজন হাঁ করে আছে দুর্গত মানুষের ত্রাণ গ্রাস করার জন্য।
অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে যত নাটক, তর্ক-বিতর্ক, ঘটন-অঘটন, আলোচনা-সমালোচনা, ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ, সন্ত্রাস-সংঘাত, প্রাণহানি, রক্তপাত আর মামলা-মোকদ্দমা ঘটে, পৃথিবীর আর কোনো দেশে মনে হয় এমনটা হয় না। নির্বাচন নিয়ে, এ কথা সত্য, পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি কিছু ঘটনা ঘটে। কিন্তু বাংলাদেশ যেন সে ক্ষেত্রে একেবারেই ব্যতিক্রম, তুলনাহীন। মিডিয়াতেও বিচিত্র সব সংবাদ পাওয়া যায় নির্বাচন নিয়ে। এসব সংবাদ যেমন কৌতূহল এবং বিস্ময়ের জন্ম দেয়, তেমনি ভীতিরও সঞ্চার করে।
বিজ্ঞজনেরা বলেন, যে দেশে সেবা নয়, ক্ষমতাই একমাত্র লক্ষ্য, সে দেশে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা কিংবা যেকোনো পন্থায় নির্বাচনকে প্রভাবিত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রতিযোগিতায় তেমনটা ঘটাই স্বাভাবিক। যেখানে ন্যায়-অন্যায়, নীতি-নৈতিকতা কিছুই কাজ করে না, সেখানে যা অপরিহার্য তাই ঘটে। ও নিয়ে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করেন, তারা নাকি জেনেশুনেই রাজনীতি করেন। তারা জানেন যে তারা জনগণের সেবার জন্য রাজনীতি করেন না। তারা রাজনীতির নামে যেসব ভালো ভালো কথা বলেন, তাতে দেশ ও জনগণকে সেবা করার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য থাকে না। থাকে যার যার আখের গোছানোর তাল। সে কারণেই অভিজ্ঞজনেরা বলেন, তাদের মুখে থাকে গণতন্ত্রের কথা আর অন্তরে লালন করেন স্বৈরতন্ত্রের মন্ত্র। মুখে থাকে আশীর্বাদের কথা, জনসেবার কথা, আর মনে মনে পোষণ করেন ব্যক্তিগত সুখ এবং সম্পদ লাভের আকাক্সক্ষা।
২০১৮ সাল বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের বছর। কে যে কাকে ঘায়েল করে, কে যে কাকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ক্ষমতায় যেতে পারে, তার প্রতিযোগিতা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। বলা হয় যে, প্রেমে এবং যুদ্ধে অন্যায় বলে কিছু নেই। যে সময় এই প্রবাদবাক্যের জন্ম, তখন বাংলাদেশের জন্ম হলে হয়তো বলা হতো প্রেমে, যুদ্ধে এবং বাংলাদেশের নির্বাচনে অন্যায়, অগ্রহণযোগ্য বলে কিছু নেই। বাংলাদেশে যখনই নির্বাচনের ডামাডোল বেজে ওঠে, তখনই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে মাঠে নেমে পড়ে। উদ্দেশ্য সাধন বলতে আর কিছু নয়, ক্ষমতার স্বাদ নেওয়া। হয় সরাসরি না হলে অন্তত লেজুড় হয়ে। মুখে যাই থাক, মনে মনে জপতে থাকে ‘ন্যায়-অন্যায় জানি না, জানি না, জানি না। শুধু ক্ষমতা জানি, ক্ষমতা জানি।’ ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায় মিডিয়াকর্মীদের। নানা চমক নিয়ে নির্বাচনী খবরাখবর প্রকাশিত হতে থাকে।
এ বছরও তার ব্যতিক্রম লক্ষ করা যাচ্ছে না। বিরোধী দল গণতন্ত্র, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আর খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি তুলে মাঠ গরমের চেষ্টায় ব্যস্ত। সরকারের, রাষ্ট্রের সকল মেকানিজম আর শক্তির মোকাবিলা করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। তারাও মুখে জনগণের কথা বলছে। নানা অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের মন ভোলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু মনে মনে তারাও বলছে, ‘একবার ক্ষমতা পেয়ে নিই, তারপর দেখাব কত ধানে কত চাল। এত দিনের নিপীড়ন, নির্যাতন আর বঞ্চনার শোধ সুদে-আসলে কীভাবে তুলে নিতে হয় দেখিয়ে দেব।’
আর সরকারি দল তো সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে মসনদে বসে মোচে তা দিয়ে যাচ্ছে। বিরোধীদের নিত্যনতুন ফাঁদে ফেলার চক্রান্ত চালানো আর জনগণের চোখে ধুলো দিয়ে উন্নয়নের বড় বড় কথা বলার বাইরে আর কোনো কাজ দেখা যায় না। কিন্তু বড় বড় ফ্লাইওভার আর যানজটে নাকাল জনজীবনে রাস্তাঘাট নির্মাণের নামই যে একমাত্র উন্নয়ন নয়, সেটা বোঝার অবসরও নেই তাদের কারও। একটি দেশের মানব উন্নয়নকে অবহেলা করে যে প্রকৃত কোনো উন্নয়ন হয় না, তা বাংলাদেশের ক্ষমতাবানরা কিছুতেই বুঝতে চান না। জনগণের একটি বড় অংশও বুঝতে পারে না। যে কারণে আইন-আদালতকে পাশ কাটিয়ে মাদক দমনের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-েরও অনেক সমর্থক দেখা যায় এই সভ্য যুগেও। ‘উইনার টেকস দ্য অল’ এ কথার প্রকৃত তাৎপর্য বুঝি বাংলাদেশেই অনুভব করা সম্ভব হয়। দেশে মানুষের আয় বৈষম্যের দিকে তাকালে বুঝতে পারা যায়, উন্নয়নের ছোঁয়া সাধারণ মানুষের গায়ে কতটুকু লেগেছে? ১৬-১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ৪০-৫০ হাজার মানুষের কাছে দেশের অর্ধেকের অধিক সম্পদ পুঞ্জীভূত। ধনী-গরিবের ফারাক বিরাট।
আর এই সম্পদের মালিক হওয়ার তাড়না থেকেই জন্ম নেয় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবণতা। কেননা বাংলাদেশে সম্পদ অর্জনের প্রধানতম উৎসই ক্ষমতা। তাই যাদের মধ্যে বড়লোক হওয়ার জন্য ন্যায়-অন্যায় ভেদজ্ঞান থাকে না, তারা রাজনীতিকদের অনৈতিক পথে ধাবিত হতে সমর্থন জানায়, উৎসাহিত করে। তাতে তাদের স্বার্থ হাসিলের পথ প্রশস্ত হয়। সেসব কারণেই নির্বাচনী বছরে রাজনীতিবিদদের হুঁশ-জ্ঞান বিসর্জন দিয়ে দিগি¦দিক ছোটাছুটি লক্ষ করা যায়। পত্রপত্রিকায় নির্বাচন নিয়ে কৌতূহলের সব সংবাদ প্রকাশ পেতে দেখা যায়। ক্ষমতাসীনরা উন্নয়ন সংবাদের প্রচার বাড়িয়ে দেয়। মিডিয়ায় তাদের খবর ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচারে সাংবাদিকদের অনেক সময় বাধ্য করা হয় বলেও শোনা যায়। বিদেশের কাছ থেকে প্রশংসাপত্রও সংগ্রহ করে আনতে দেখা যায়। বিদেশিদের তুষ্টি বিধানেও ব্যস্ততা বাড়ে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে এখন আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা অবাধ, সুষ্ঠু, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে গণ্য করা হয় না। এখন উন্নয়নের চাদরে গণতন্ত্রকে ঢেকে দেওয়া হয়। কেননা গণতন্ত্রের চর্চায় সমাজ বিকশিত হয়, আর উন্নয়নের ডামাডোলে পকেট ভারী হওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। দলের মানুষ, দলের পৃষ্ঠপোষকদের খুশি করা যায়। প্রায় দেড় শতাধিক বছর আগে আমেরিকায় দাস প্রথা উচ্ছেদের নায়ক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন মানুষের ওপর আশা রেখে গর্বভরে বলেছিলেন, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল শ্যাল নট পেরিশ ফ্রম দ্য আর্থ।’ গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষ সে কথায় আজও আস্থা রাখলেও বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র আজ নির্বাসিত। উন্নয়নের ডামাডোলে গণতন্ত্রের নাভিশ্বাস দেখা দিয়েছে।
অথচ বাংলাদেশেই গণতন্ত্রের ভিত্তি সবচেয়ে শক্ত থাকার কথা ছিল। কেননা বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে গণতন্ত্রের আদর্শকে ধারণ করে। যে মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ বাঙালি জীবন দিয়ে এবং আরও কয়েক লাখ মা-বোন সম্ভ্রম দিয়ে দেশ স্বাধীন করেন তার একটি স্তম্ভের অন্যতম ছিল গণতন্ত্র। এবং স্বাধীনতাসংগ্রামে যে দলটি, যে দলের জন্মদাতা নেতৃত্ব দিয়েছেন, যিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে বারবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন, তার দলটিই এখন ক্ষমতায়। অথচ তাদের দ্বারাই গণতন্ত্রের নাকাল অবস্থা।
তারা মনে করেন, তারা যা বলবেন যা করবেন তা-ই সঠিক বলে বিশ্বাস করতে হবে দেশের মানুষকে। তারা যদি বলেন বর্তমানে দেশে যা চলছে সেটাই গণতন্ত্র, সেটাই উন্নয়ন। তারা যদি বলেন দেশে যা হচ্ছে সেটাই উন্নয়ন। তাদের কথাই ’৭২-এর সংবিধান। তাহলে আজকের পরিস্থিতিতে অসহায় জনগণকে তা মেনে নিতে হলেও অবশ্যই তা আব্রাহাম লিংকন, অমর্ত্য সেনের মতো গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়নদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় পড়ে না। প্রকারান্তরে তা একনায়কতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র ব্যতীত কিছু নয়।
দেশের সাধারণ মানুষের মনে ইদানীং প্রায়ই একটি প্রশ্ন উচ্চারিত হয় ‘দেশ আজ কোন পথে চলছে।’ কথায় বলে, বৃক্ষের পরিচয় তার ফলে, রোগের পরিচয় তার লক্ষণে। কিন্তু একটি দেশের পরিচয়? একটি দেশের পরিচয়, দেশটি কীভাবে শাসিত হচ্ছে তার মাধ্যমে। একটি দেশের সংবিধান হতে পারে গণতান্ত্রিক, গণমুখী, কল্যাণকর। শাসকগোষ্ঠীর ভালো ভালো প্রতিশ্রুতিও থাকতে পারে। তাতেই গণতন্ত্রের পরিচয় মেলে না। একটি দেশের পরিচয় খুঁজে নিতে হবে শাসকগোষ্ঠীর প্রবণতার মধ্যে। কীভাবে দেশটি পরিচালিত হচ্ছে। সংবিধান শুধু কেতাবেই আছে, নাকি বাস্তবে তা মানা হচ্ছে। উন্নয়নের সুফল সাধারণ মানুষ কতটা পাচ্ছে। বাক্্স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকার দেশের কমন পিপল কতটুকু ভোগ করার সুযোগ পচ্ছে তার মধ্য দিয়ে।
বাংলাদেশের শাসক দলের গতি-প্রকৃতি খেয়াল করলে যে কারও পক্ষে বলে দেওয়া কষ্টকর হবে না দেশটি কোন পথে। সবচেয়ে হতাশার কথা, যেসব দল এবং রাজনীতিবিদ বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতা করে মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে, তাদের ওপর ভরসা রেখে মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভয় পাচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছে কেন যেন উভয়কেই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলে মনে হয়। জনগণ জেনে নিয়েছে, উভয় দলের কাছেই ক্ষমতার চেয়ে বড় কিছু নয়। ক্ষমতার কাছে জনসেবা, দেশসেবা সবই কথার কথা।
কোনো নির্বাচন ঘনিয়ে এলে উভয় পক্ষের এই চরিত্র আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। এবার অবস্থা আরও ভয়াবহ মনে হচ্ছে। কেননা রাজনীতির মাতাল হাওয়ার সঙ্গে এবার যোগ হয়েছে প্রকৃতির বৈরী হাওয়া।