পারমাণবিক বোমা ও সন্ত্রাসবাদের আস্ফালন

এবিএম সালেহ উদ্দীন :

বিজ্ঞানীদের বিচার-বিবেচনায় পদার্থের সবচেয়ে ক্ষুদ্র অংশকে পরমাণু বলা হয়। ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনÑএই তিন উপাদান দিয়ে পরমাণু গঠিত হয়। পরমাণু বানানোর আগে বিজ্ঞানীদের প্রধান যুক্তি ছিল এটি শুধু পৃথিবীর জ্বালানিশক্তিকে বৃদ্ধির কাজেই নয়, রাষ্ট্রপুঞ্জের বিত্ত-বৈভবের মধ্য দিয়ে মানুষের কল্যাণের পথকে সুগম ও শক্তিময় করে তুলবে। কিন্তু মানুষের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় ফলাফল দেখা গেছে তার উল্টো। পরমাণুকে মানববিধ্বংসের প্রধান ভয়ংকর তেজস্ক্রিয়াসম্পন্ন বিষাক্ত মারণাস্ত্রে পরিণত করেছে।

পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিধর দেশ আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানি, চীন ও ফ্রান্স প্রথমে পারমাণবিক বোমা বানিয়ে শক্তির পরীক্ষার আস্ফালন দেখিয়েছে। ওইসব রাষ্ট্র পরমাণু মজুত করার কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ার মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার একপর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর পারমাণিক বোমা নিক্ষেপ করে বসে। সেই ঘটনা মানববিধ্বংসের ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ও মানবতার করুণতম অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, মৃত্যুজনিত বিভীষিকা, হাজার হাজার আহত মানুষের আর্তচিৎকারে বীভৎস রূপ পরিগ্রহ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণিক বোমার আঘাতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি এবং আশপাশের অঞ্চলের অধিবাসীরা ভয়াবহ ধ্বংসের অসহনীয় যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন। নিরীহ, নিরপরাধ লক্ষ মৃত্যুযন্ত্রণা ও আহাজারিতে সমগ্র বিশ্ব হতবাক ও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।

বিশ্বযুদ্ধের চলমান অবস্থার শেষ দিকে ১৯৪৪ সালের দিকে জার্মানি পরাজয়ের মুখে পড়ে। তখনো তারা পারমাণবিক বোমা বানায়নি। হুমকি-ধমকি ও হামারি-তুমারি মেরেছে এবং তাদের প্রত্যাশা ছিল আমেরিকা যেন পরমাণু বোমা বানানো স্থগিত রাখে। কিন্তু ইতিমধ্যে আমেরিকা সকল তকমার আগেই তাদের পরমাণু বোমা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে আসল কাজটি সম্পন্ন করে ফেলে। ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের মিত্রদেশসমূহ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে পৃথিবীতে প্রধান শত্রুদেশ হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই থেকে বড় বড় দেশগুলো এবং অন্যান্য রাষ্ট্রপুঞ্জের মধ্যে পরমাণু বোমার অজুহাতে নানান কৌশলে মারণাস্ত্র কুক্ষিগত করবার চক্রান্ত দানা বেঁধে উঠতে থাকে। যার বর্তমান কুফল স্বাধীন ফিলিস্তিন দখলকারী আগ্রাসী শক্তি ইসরাইল। অতি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইল সকল আন্তর্জাতিক শান্তির নীতিমালা লঙ্ঘন করে ভয়ংকর মারণাস্ত্র তৈরি, মানববিধ্বংসের কাজে প্রয়োগ এবং মজুত করা শুরু করে। অস্ত্র মজুত করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেসব ভয়ংকর মারণাস্ত্র স্বাধীন ফিলিস্তিনের মানুষের ওপর প্রয়োগ করে। ফিলিস্তিনকে দখল করে অত্যন্ত অমানবিকভাবে ফিলিস্তিনি নারী-শিশুসহ লাখো মানুষকে নিষ্ঠুরতম পদ্ধতিতে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। শুধু তা-ই নয়, ইসরাইলের বিষাক্ত মারণাস্ত্র চওড়া মূল্যে এখন ইয়েমেন, ইরাক, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সীমানা পেরিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চালান দেওয়া হয়ে থাকে। আর সেই সব মারণাস্ত্র সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের স্বৈরাচারী শাসকেরা সাধারণ নিরীহ মানুষের ওপর প্রয়োগ করে এবং অবলীলায় মানুষ মারে।

এটাও সত্যি, পারমাণবিক বোমার মালিক কিংবা তেজস্ক্রিয় মারণাস্ত্র মজুতকারী শুধু ইসরাইল নয়, ভারত ও পাকিস্তানের মতো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাষ্ট্র পর্যন্ত আজ পারমাণবিক বোমার অধিকারী। অথচ এসব মারণাস্ত্র তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়। জনগণের নাগরিক অধিকার খর্ব করে এরা মানুষ মারার কারখানা বানায়। প্রতিটি যুদ্ধের ব্যয়ভার সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের জনগণের ওপরই বর্তায়। যেমন বর্তমানে ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনে জের হিসেবে আক্রান্ত দেশের যুদ্ধের সিংহভাগ খরচ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যেমন তালেবান খেদাতে প্রেসিডেন্ট আফগানিস্তানে ঢুকেছেন এবং সে দেশটিতে সৈন্য পাঠানো থেকে শুরু করে ২০ বছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার গচ্চা দিয়ে অগণিত সৈনিকের ক্ষয়ক্ষতি ও আত্মবিসর্জন দিয়ে শেষ পর্যন্ত সে দেশ থেকে বেরিয়ে আসেন।

এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, কেউ আবার মারণাস্ত্র তৈরি ও মজুতকরণের খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেসব মারণাস্ত্র প্রয়োগের নীতিমালার কাছে-ধারে নেই। বরং আত্মরক্ষার অজুহাতে সাধারণ মানুষের জীবনপাত এবং অন্যের ভূমি দখল করার দুরভিসন্ধি ও চক্রান্তকে বাস্তবায়নই সমগ্র পৃথিবীকে কলুষিত করে চলেছে। পরিবেশ বিনষ্টকারী মানববিধ্বংসী যুদ্ধ ও বোমাবর্ষণের মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবী দূষিত হয়ে পড়েছে।

এভাবেই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসী চক্র চীন, কোরিয়া, মিয়ানমার, ইরান-তুরান, মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিষাক্ত পরমাণু দ্বারা তৈরি বোমাবাজির মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কার্যক্রম ছড়িয়ে যায়।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভয়ংকর আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলায় নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার (টুইন টাওয়ার) এবং তৎসংলগ্ন সাত টাওয়ার ধ্বংস করা হয়। সেই ভয়ংকর হামলায় কয়েক হাজার নিরীহ মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটে। সেদিনের (১১ সেপ্টেম্বর) ধ্বংস-প্রক্রিয়ায় সন্ত্রাসীচক্র আমেরিকার বিশ্ববিখ্যাত পেন্টাগন ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে টার্গেট করে চারটি যাত্রীবাহী বিমানকে ব্যবহার করে। এর মধ্যে আমেরিকান এয়ারলাইন্স বোয়িং ৭৬৭ এবং ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৬৭ দুটি বিমানকে ঘুরিয়ে নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ক্রাশ করানো হয়। পরবর্তী সময়ে সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়, ছিনতাইকৃত চার বিমান দিয়ে মোট ১৯ জন তরুণ সন্ত্রাসী সেই ভয়ংকর ঘটনা ঘটায়। সেই ঘটনায় সমগ্র পৃথিবী হতভম্ব ও হতবিহ্বল পড়ে। সভ্যতার করুণ মৃত্যু ত্বরান্বিত করার জন্য ধ্বংসবাজ শোষকশ্রেণি নানা অজুহাতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম ছড়িয়ে দেয়।

বিশ্বব্যাপী আজকের সন্ত্রাসের উৎস সম্মুখে, অন্তরালে ও পশ্চাতের এ রকম ভয়াবহ চিত্রের মধ্য দিয়েই বর্তমান পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসের সংজ্ঞা কী এবং কোন পথে তার গতিবিধি, সেসব তো বিশ্লেষকেরা বলবেন। কিন্তু দেশে দেশে সন্ত্রাসের ভয়ংকর পরিণতির কথা মনে করলেও গা শিউরে ওঠে। সন্ত্রাসী কার্যক্রমে শুধু বোমার ব্যবহারই নয়, মানুষ হত্যা করানোর নতুন নতুন প্রযুক্তি ও শক্তির উদ্ভাবন ঘটানো হয়।

এ ক্ষেত্রে মানুষের কথা যদি বলি, তাহলে দেখা যাবে, মানুষই মানুষের শত্রু। মানুষের হিংস্রতা, পাশবিকতা ও ধ্বংসের উন্মাদনা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়, তখন ওই মানুষ আর মানুষ থাকে না। হিংস্র পশুর চেয়েও অধম এমন অমানুষদের বর্বরতায় নিরীহ মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটে। এখানে নিটসের বিখ্যাত উক্তিই সত্য। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ আর পশুর মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই। মানুষ সর্বদা সহজাত প্রবৃত্তির তাড়নায় লোভ, লালসা, আহার, মৈথুনের ব্যবস্থায় তৎপর থাকে; কখনো সে পশুর চেয়ে ভয়ংকর ও পাশবিক হয়ে ওঠে কিন্তু অন্য সব প্রাণিকুল তার বিপরীত।’ হ্যাঁ, মানুষের মাঝে ভয়ংকর হিংস্রতা এতই প্রবল যে অনেক সময় সে পশুর চাইতেও বেশি বিপজ্জনক। ক্ষমতা, লোভ-লালসা আর হীন স্বার্থ চরিতার্থের জন্য মানুষ অনেক ভয়ংকর কাজ করতেও দ্বিধা করে না। কখনো সে অত্যন্ত নির্মম, নৃশংস, হিংস্র হয়ে ওঠে। আর সে কারণেই আজকের পৃথিবীতে মানুষের করুণ অবস্থা। বর্ববরতা ও হীন স্বার্থপরতার কারণেই আজকের চলমান পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মানুষের ভেতর থেকে উঠে গেছে দয়া, মায়া ও ভালোবাসা। সর্বত্র শুধু মানবতার সংকট।

আবার এটাও সত্যি, কিছু মানুষের উদ্যোগ, ত্যাগ ও বলিষ্ঠ ভূমিকার ফলেই পৃথিবীর শান্তি ও স্বস্তির দুয়ার খুলে যায়। ওই ভালো মানুষগুলোর কারণে পৃথিবী এখনো টিকে আছে।

প্রথম মহাযুদ্ধের পর ১৯২০ সালে ‘লিগ অব নেশন’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল শান্তির জন্য। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। তিরিশের দশকে পৃথিবীর কোনো কোনো দেশের স্বৈরতন্ত্র এতই প্রবল হয়ে উঠল যে বিশ্বময় শান্তির পরিবেশ নষ্ট হলো।
চারদিকে উগ্র ক্ষমতাসীন শোষকদের জাঁতাকলে বিপন্ন হলো শান্তি ও স্বস্তি। শুরু হলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। তারপর ‘ইউনাইটেড নেশন’ জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা। যার লক্ষ্য ছিল স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া। পৃথিবীকে শান্তিময় রাখা এবং মানুষের স্বাধীনতার পথ উন্মোচন করা। প্রতিটি দেশের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা। মানুষকে শান্তিতে বসবাসের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করে দেওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, জাতিসংঘ তা করতে পারেনি।

বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার শেষান্তে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মানববিধ্বংসী যে ভয়ংকর বোমাবর্ষণ হয়েছিল, তাতে কত সংখ্যক অতি নিরীহ সাধারণ মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানি ঘটেছিল? কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে সেই বিষাক্ত বোমায় যারা মারাত্মক বিষাক্রান্ত হয়েছিল, তারা শুধু বিকলাঙ্গই হয়নি। তাদের ঔরসজাত সন্তানও বিকলাঙ্গ হয়েছে। তার পরবর্তী সব ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা।

বলা বাহুল্য, ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া নিয়মে কথিত পাকিস্তান ও ভারতের শাসকদের মাধ্যমে জনগণের ওপর নিপীড়নের চিত্র এখনো জম্মু-কাশ্মীরসহ অনেক অঞ্চলেই দেখা যায়।

তেমনি ফিলিস্তিন দেশটির অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ইসরাইল নামের রাষ্ট্রপুঞ্জের আগ্রাসনে ঐতিহ্যবাহী ফিলিস্তিন ও লেবাননের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। সেই দেশটির প্রায় সব অংশই এখন ইসরাইলের দখলে। ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরাইলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের অসহায় মানুষের দুর্দশার পেছনেও ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের ষড়যন্ত্র।
ইসরাইলের আগ্রাসনে ওইসব দেশের কত লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। সেই ১৯৪৭-৪৮ থেকে ইসরাইলি বর্বরতা, হিংস্রতা ও পাশবিকতার বীভৎস কলঙ্ক সমগ্র পৃথিবীকে কাঁদিয়েছে। সবই ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদের ছত্রচ্ছায়ায় এবং বড় দেশের প্রত্যক্ষ মদদে। অন্যদিকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়কার বীভৎস রূপ দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রক্তপাতের ইতিহাস অনেকের জানা আছে। বর্তমান বিশ্বের সন্ত্রাসের ইন্ধনদাতা, জোগানদাতা এবং সকল সন্ত্রাসীচক্রের প্রতি ঘৃণা করা ছাড়া আর কিছু থাকে না। ইতিহাস সাক্ষী, বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রাজ্যবাদী চেতনায় স্বাধীনতার নামে আরও অনেক দেশের উদ্ভব ঘটল। তথাকথিত প্রতাপশালী দেশগুলোর নাটকের অংশ হিসেবেই কোনো কোনো রাষ্ট্রের উদ্ভব। এর ফলে কয়েক দশকের মধ্যে কীভাবে পৃথিবীর স্বৈরতন্ত্র ভয়ংকর থেকে আরও বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠল।

জাতিসংঘ কিছুই করতে পারল না। বরং তার গড়া রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের নাট্যমঞ্চকে সরব রেখেই পৃথিবীর নানা প্রান্তে স্বৈরতন্ত্র ও শোষকশ্রেণি আরও বেশি পোক্তভাবেই মাথাচড়া দিয়ে ওঠে এবং অনেকে এখনো বহাল রয়েছে।

হায়রে কপাল! সবাই শুধু হিটলারকে দোষারোপ করে নিজের উগ্রতা ও শক্তিমত্তার উন্মত্ততাকে আরও বেগবান করার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। সবাই কিন্তু শান্তির কথা বলেই ধ্বংসাত্মক যুদ্ধকে প্রলম্বিত করছে। অথচ সেই সব যুদ্ধের শিকার হয় নিরীহ মানুষ। আর এটাও সত্যি, স্বৈরতন্ত্রের হিংসাত্মক অভিলাষের উন্মত্ত প্রদর্শনের জন্য অনেক দেশের রাষ্ট্রপুঞ্জ খুব ব্যতিব্যস্ত। ফলে পৃথিবী আরও অনাকাক্সিক্ষত ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

ধ্বংসের দিকে এগিয়ে গোটা বিশ্বকে অশান্তকরণে পারমাণবিক বোমা মজুতকারী দেশের সঙ্গে আরও কিছু ছোট দেশ উগ্রবাদী নীতিতে স্ব স্ব দেশে শক্তি সঞ্চয় করে যাচ্ছে। তারা অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ক্রয় করে নিরীহ মানুষের ওপর প্রয়োগ করছে।

মনে আছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয় জর্জ বুশ সন্ত্রাস নির্মূলের কথা বলে ইরাক আক্রমণ করেছিলেন। সেই জাতিসংঘের অনুমোদন ছিল না। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এবং বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ সেই অমানবিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু জর্জ বুশ কারো কথা শোনেননি। তিনি আগ্রাসন চালালেন। সঙ্গে ছিলেন ব্রিটেনের টনি ব্লেয়ার। সাদ্দাম হোসেনের গড়া আধুনিক ইরাক ধ্বংস হয়ে গেল। সাদ্দামের ফাঁসি হলো। ইরাকি জনগণের দুঃখ-দুর্দশা কমল না। বরং হাজার গুণে বেড়ে গেল। সন্ত্রাস বন্ধ হলো না। বরং শতগুণে সন্ত্রাসের আন্ডা-কন্ডাসহ বেড়ে গেল ভয়াবহভাবে। বড় দেশের ছত্রচ্ছায়ায় আল কায়েদা, তালেবান কিংবা আইএস নামের জঙ্গিবাদী দুষ্ট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। শান্তি আসেনি। বর্তমানে ভয়ংকরভাবে সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়।

স্বৈরতন্ত্রের কোনো সুফল নেই। স্বৈরতন্ত্র সর্বদাই মানবতার শত্রু। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশে স্বৈরতন্ত্রই শক্তিশালী। সিরিয়ায় জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকা স্বৈরশাসক বাশার আসাদের অত্যাচার ও নিষ্পেষণে এ পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। প্রতিনিয়ত সেখানে নিরীহ মানুষের করুণ মৃত্যু হচ্ছে। অসহায় নারী-শিশুসহ লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

মিসরের স্বৈরশাসক মোবারকের পতন হলেও সেখানে আবারও চেপে বসেছে স্বৈরতন্ত্র। সৌদি স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য পার্শ্ববর্তী দেশ ইয়েমেন ধ্বংস হয়ে গেছে। যে দেশটি একসময় এই সৌদি রাজতন্ত্রের স্রষ্টা আবদুল আজিজ ও তার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল। তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করেছিল। সেই দুর্দিনের বন্ধুদেশটিকে অত্যন্ত নির্মমভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে বর্তমান সৌদি শাসক। ইয়েমেনের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জনগণের জীবন-জীবিকার সবকিছু ভয়ংকর বোমার আঘাতে আঘাতে তছনছ করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, সৌদি আরবের সেই সব মারণাস্ত্রের জোগানদাতা হচ্ছে ইসরাইল। উপরে আলখাল্লা আর ভেতরে রাজতন্ত্রের বিষাক্ত ছোঁয়ায় সৌদি সরকারের মানববিধ্বংসী একতরফা যুদ্ধ ও বর্বরতায় ইয়েমেনের হাজার হাজার মানুষের করুণ মৃত্যু হয়েছে। ফকির হয়ে গেছে দেশটি ও তার জনগণ।

একইভাবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তানির্ভর সরকার সেখানে যুগ যুগ ধরে বসবাসকৃত লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগণকে নৃশংসভাবে হত্যা ও বিতাড়নের মাধ্যমে পাশবিক অত্যাচার অব্যাহত রাখছে।

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীনদের শোষকশ্রেণির জননিপীড়নমূলক নিষ্ঠুরতম স্বৈরতন্ত্রী দমননীতি ও মানসিকতার ফলে কী পরিমাণ ধ্বংস নেমে আসে, তার অসংখ্য নজির পৃথিবীতে আছে। এই নিবন্ধে সবকিছু তুলে ধরা সম্ভব নয়। শুধু এতটুকু বলা যায়, নানান কৌশল ও অবয়বে মানববিধ্বংসের কাছে বিশ্বজুড়ে চলমান সন্ত্রাসের মাত্রা ভয়ংকরভাবে ক্রমবর্ধমান।
মানুষের প্রতি মানুষের বৈষম্যমূলক আচরণ, নিষ্ঠুরতা, হিংসাবর্তী নিপীড়ন ও দমননীতি বন্ধকরণে শুধু মারণাস্ত্র নিরস্ত্রীকরণের স্লোগানই যথেষ্ট নয়। সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাস বন্ধকরণ ও মূলোৎপাটনে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বব্যাপী মানববিধ্বংসের কলকাঠির পরিবর্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে মানুষ গড়ার হাতিয়ার বানাতে হবে। পৃথিবী, প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষের বসবাসের নির্মল পরিবেশ ধ্বংসের হাত থেকে বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।

(প্রবন্ধটি ১১ সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে প্রকাশিত)।