পার্টিতে মাস্তি করে বিপাকে ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী

ঠিকানা অনলাইন : এক পার্টিতে নেচে-গেয়ে বিপাকে পড়েছেন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন। তাকে নিয়ে আলোচনা উসকে দিচ্ছে নানা প্রশ্ন।

কয়েক সপ্তাহ আগে গ্রীষ্মের এক রাতে বন্ধু আর পরিচিতজনদের সঙ্গে এক পার্টিতে অংশ নেন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন; ব্যক্তিগত ওই আয়োজনে অ্যালকোহল পানের পাশাপাশি নেচে-গেয়ে আনন্দে মাতেন ৩৬ বছর বয়সী এই রাষ্ট্রনেতা।

রাজধানী হেলসিঙ্কির কোথাও ওই পার্টিতে কেউ একজন ফোন বের করে ভিডিও করতে শুরু করেন। ক্যামেরার সামনেই বাদ্যের তালে তালে নাচের সঙ্গে হাসাহাসি আর আলিঙ্গন চলে।

বিবিসি লিখেছে, ফিনল্যান্ডের সমাজে ত্রিশোর্ধ্ব কোনো সাধারণ নারীর জন্য খুবই সাধারণ একটি রাতের চিত্র এটা। কিন্তু ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সানা মারিন কোনো সাধারণ নারী নন।

পার্টির সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হলে প্রথমে দেশের ভেতরে, তারপর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শোরগোল পড়ে যায়। রাজনৈতিক চাপে সানা মারিন বাধ্য হন ড্রাগ টেস্ট করাতে হয়, যদিও ফলাফল আসে ‘নেগেটিভ’।

পরে অন্য এক অনুষ্ঠানের একটি ছবি ফাঁস হয়, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন কেসারন্তায় দুজন সেলিব্রেটিকে প্রায় উন্মুক্ত বক্ষে পরস্পরকে চুমু খেতে দেখা যায় সেখানে। সানা মারিনকে তখন ক্ষমা চেয়ে বলতে হয়, বিষয়টি ‘ঠিক হয়নি’।

বিষয়গুলো নিয়ে সানা মারিনের সমালোচনা করে তার সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টিরই (এসডিপি) সাবেক সেক্রেটারি মিকায়েল জাংনার বলেছেন, ফাঁস হওয়া ওইসব ছবি আর ভিডিও প্রধানমন্ত্রীকে ‘হাস্যস্পদ’ করে তুলেছে। আগামী বছরের নির্বাচনে তার টেকা মুশকিল হয়ে যাবে।

“লোকে যখন আপনাকে নিয়ে হাসবে, রাজনীতিবিদ হিসাবে আপনার দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না… এটা তার (সানা মারিন) ক্যারিয়ারকেই ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।”

জাংনারের ভাষায়, পার্টি করাটা সমস্যা নয়, ভুল মানুষের সঙ্গে পার্টি করাটাই সমস্যা তৈরি করেছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ভিডিও বা ছবিতে সানা মারিনকে যদি তার শৈশবের বন্ধু বা রাজনৈতিক দলের সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা যেত, সাধারণ মানুষ হয়ত সেটা মেনে নিত; ভাবত তাদের প্রধানমন্ত্রী তাদের মতই। কিন্তু সেলিব্রেটিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মাস্তি করা তারা হজম করতে পারছে না।

ফাঁস হওয়া ভিডিওগুলোতে সানা মারিনকে একজন পপ তারকা, মিডিয়া উপস্থাপক এবং সোশাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের সঙ্গে নাচতে দেখা গেছে।

হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইয়োহানা ভুরেলমা এক্ষেত্রে ফিনল্যান্ডের রাজনৈতিক কেতা-কানুনের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে টপলেস ছবি অনেক ফিনিশীয়দের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। অনেকের কাছে ওই ভবন গণতন্ত্রের একটি পবিত্র স্থান, সুতরাং ওই সম্মানের জয়গাটা বজায় রাখতে হবে।”

অনেকে আবার বলছেন, সানা মারিনকে ঘিরে এই বিতর্কের মূলে রয়েছে লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি। এরকম আরো অনেকের বিরুদ্ধে ‘তার জন্য মানানসই নয়’ এমন পার্টিতে অংশ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে আগেও।

ফিনল্যান্ডের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীরা নিজেদের নাচের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন সানা মারিনের সমর্থনে। তাদের ভাষ্য, একজন তরুণ ও আকর্ষণীয় নারী রাজনীতিবিদ ওইভাবে ফুর্তি করার সাহস দেখিয়েছেন, এটাই তার একমাত্র দোষ।

সানা মারিন নিজেও বলেছেন, “(মহামারীর) এই অন্ধকার সময়ে একটু আলো, একটু আনন্দ, একটু মজা করা আমার দরকার ছিল।”

কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলছেন। তাদের ভাষ্য, ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর যদি অভিজাত পরিবারের কেউ হতেন, তাহলে এত কথা উঠত না।

সানা মারিনের পরিবারে তিনিই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। সে সময় তাকে ছোটখাটো কাজ করে খরচ চালাতে হয়েছে। ‘সাধারণ মানুষদের একজন’- এই ভাবমূর্তি তিনি মেনে নিয়েছেন।

মিকায়েল জাংনার অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, এ পরিস্থিতিতে সানা মারিনের জায়গায় অল্প বয়সী অন্য কোনো পুরুষ নেতা থাকলে প্রতিক্রিয়া ‘আরও অনেক খারাপ’ হত। ‘উত্তেজক নাচ, পার্টি… সব মিলিয়ে একটা বিপর্যয় ঘটে যেত।”

ইয়োহানা ভুরেলমাও একই কথা বলেছেন। তার মতে, একজন পুরুষ হলে ওই কর্মকাণ্ডকে যেরকম ‘কেলেঙ্কারি’ হিসেবে দেখা হত, সানা মারিনের ক্ষেত্রে তেমন ঢি ঢি পড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি দেখা যায়নি।

প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন এবং তার স্বামী মার্কাস রাইকোনেনের চার বছরের এক মেয়ে আছে। এমনও মন্তব্য করা হয়েছে, একজন মা হিসাবে তার ওই আচরণ উচিত হয়নি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভুরেলমার ভাষ্য, একজন বাবাকে উদ্দেশ্য করে এমন মন্তব্য কেউ করে না। ভিডিওগুলোতে এমনভাবে যৌনতা নিয়ে আসা হয়েছে যে, কোনো পুরুষের ক্ষেত্রে সেরকম হত না।

২০১৮ সালে ফিনিশ গ্রিন পার্টির সাবেক সভাপতি টোকো আল্টোকে নিয়ে একটি কেলেঙ্কারি হয়েছিল, তাকে একটি গে ক্লাবে গায়ে শার্ট ছাড়া নাচতে দেখা গিয়েছিল।

দুই মাস পর তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি ক্লান্ত, বিষণ্ন। কিন্তু তার ঘটনায় সানা মারিনের মত যৌনতার সুর ছিল না।

তুর্কু ইউনিভার্সিটির জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক আনু কোইভুনেন বলেন, সানা মারিনের অবস্থানে থাকা একজন পুরুষও কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হতেন, কিন্তু লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে সানা মারিনের ক্ষেত্রে অভিযোগের ভাষা ‘ভিন্ন’।

প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সানা মারিন এবারই প্রথম পার্টিতে মাস্তি করে ঝামেলায় পড়েননি, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে কোভিড আক্রান্ত একজনের সংস্পর্শে আসার পর ক্লাবে গিয়ে পার্টি করার অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। সেসময় তিনি দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তবে সর্বশেষ যে পার্টি নিয়ে বিতর্ক, সেটা সাম্প্রতিক।

২০১৯ সালে দায়িত্বগ্রহণের সময় বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী সরকারপ্রধান ছিলেন সানা মারিন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যান্তি রিনের পর যখন ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হলেন, তার আগে সানা মারিনকে খুব একটা কেউ চিনত না। করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে তিনি শান্ত ও দৃঢ়চেতা নেতা হিসেবে সুনাম পেয়েছিলেন।

অধ্যাপক কোইভুনেন বলেন, সানা মারিন কঠোর নীতি, দৃঢ় নেতৃত্ব এবং কঠিন দর কষাকষির জন্য পরিচিত। তবে তার এই ভাবমূর্তির বিপরীতে পার্টির ভিডিওগুলোতে তাকে ‘ভিন্ন জগতের মানুষ’ বলে মনে হয়েছে।

জোহানা ভুরেলমার বিশ্বাস, সানা মারিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে বিতর্ক, তা ফিনল্যান্ডের মত নয়। দেশের ভেতরে তর্কটা হচ্ছে রাজনৈতিক ও বৈধতার প্রশ্নে। একজন প্রধানমন্ত্রীর জন্য ওই আচরণ মানানসই কিনা, সেটাই হচ্ছে বিষয়।

“আর আন্তর্জাতিকভাবে এটি একটি নৈতিক সমস্যা হয়ে উঠেছে, কারণ সানা মারিন একজন নারী এবং তরুণ রাষ্ট্রনেতাদের একজন, যারা সংখ্যায় কম।”

জাংনার বলেন, পার্টি নিয়ে বিতর্ক সানা মারিনের দলকে পরবর্তী নির্বাচনে ঝামেলায় ফেলতে পারে। এমনকি এসডিপির সরকারের অবসানও ঘটাতে পারে।

তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি সানা মারিনের জন্য আবার ভালো কিছু বয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন তার দলের সাবেক সেক্রেটারি জাংনার।

তার মতে, সানা মারিন বিশেষ করে তরুণ ও নারী ভোটারদের প্রচুর সমর্থন পাবেন। এ বিষয়টি পরের বছরের নির্বাচনের আগে কিছুটা পুরনো ধাঁচের এসডিপির জন্য সমর্থন তৈরি করতে পারে।

“২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সানা মারিন বেশ ভালোভাবে এগিয়ে থাকতে পারেন এবং জয়ী হতে পারেন। পররাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার মত বিষয়ে ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্টেরও ভালো ক্ষমতা রয়েছে।

“ফিনিশীয়রা ব্যর্থতা থেকে ফিরে আসার কাহিনী পছন্দ করে। এসব গল্পে দেখা যায়, ব্যর্থরা জানে, কীভাবে ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে হয়।”

সানা মারিনের দলের সাবেক নেতা জাংনার বলেন, “সানা মারিন বেশ শক্তিশালী একটি সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি করেছেন, যারা তাকে রকস্টার হিসাবে দেখেন। আমি তার মত আর কাউকে দেখিনি। আর তার ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে যায়নি।”

ঠিকানা/এসআর