পাহাড়ে খুনোখুনি: মামলা করেন না স্বজনেরা

রাঙামাটি : পার্বত্যাঞ্চলের ছোট-বড় পাহাড়ের মতোই পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার আকার। কিন্তু সমতলের মতো পাহাড়ের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্যের বাইরেও দৃশ্যমান আরও একটি পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো খুন-খারাবি হলে সমতলে মামলার বাদী হন স্বজনেরা। আর পাহাড়ে পুলিশ। তবে বেওয়ারিশের বেলায় অভিন্ন কথা।
পাহাড়ে স্বজন হারানোর বেদনায় বিলাপ করা, মরদেহ গ্রহণ কিংবা ধর্মীয় রীতিতে তার সৎকার সবই চলে অন্যের দেখিয়ে দেওয়া ‘নির্দিষ্ট ছাঁচে। এমনকি মৃতের আত্মার শান্তি কামনায় ধর্মীয় কোনো অনুষ্ঠান হবে কি না তাও। আর এটি তৈরি হয়েছে আঞ্চলিক দলগুলোর ভাতৃঘাতী সংঘাতে হত্যা, গুম, অপহরণ আর চাঁদাবাজির মতো নীরব অত্যাচারে। যার ভার শুধু এখানে বসবাসরত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীই বয়ে চলেন। এলাকাভেদে এখানে সরকারের সমান্তরাল শাসন চালাতে ‘সশস্ত্র দুঃসাহস’ দেখিয়ে চলছে আঞ্চলিক দলগুলো। ব্যাপক অনুসন্ধান আর স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত ডিসেম্বর থেকে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ৫ মাসে পাহাড়ের দুই জেলা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে আঞ্চলিক দলগুলোর ভাতৃঘাতী সংঘাতে খুন হন ২৪ জন। হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে ২৬ জনকে। অপহরণ করা হয় ইউপিডিএফের দুই নারী নেত্রীসহ ১৭ জনকে। গত ৫ ডিসেম্বরে মাত্র ১১ ঘণ্টার ব্যবধানে নানিয়ারচর উপজেলায় ইউপিডিএফ নেতা সাবেক ইউপি সদস্য অনাদী রঞ্জন চাকমা ও জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দু চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। দুই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে হত্যা মামলা রুজু করে।
৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমাকে (৩৮) গুলি করে খুন করা হয়। কিন্তু স্বজনেরা মামলা করতে রাজি হননি। হত্যাকা-ের ঘটনায় চার দিন পর ৬ জানুয়ারি পুলিশ অজ্ঞাত সাত-আটজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। অবশ্য ৯ জানুয়ারি জেএসএস-এম এন লারমা ও ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক দলের শীর্ষ ১৭ নেতাকে আসামি করে খাগড়াছড়ির জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগ করা হয়। মিঠুন চাকমার জেঠাতো ভাই ও ইউপিডিএফ নেতা অনি বিকাশ চাকমা এর বাদী হন।
সর্বশেষ গত ৩ মে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের সামনে চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাকে প্রতিপক্ষের অস্ত্রধারীরা গুলি করে হত্যা করে। এ সময় তার মোটরসাইকেল চালক রূপম দেওয়ান গুলিবিদ্ধ হন। পর দিন ৪ মে শক্তিমানের শেষকৃত্যে অংশ নিতে আসার পথে প্রতিপক্ষের অস্ত্রধারীদের ব্রাশফায়ারে ‘ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’ দলের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা বর্মাসহ পাঁচজন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরও আটজন। তবে দীর্ঘ সময় ধরে অজ্ঞাত কারণে হত্যা মামলা রুজু করতে আসেননি তাদের স্বজনেরা। পুলিশও বাদী হয়নি মামলার। অবশেষে ৬ খুনের ঘটনার সপ্তম দিন গত ৯ মে দুপুরে নানিয়ারচর থানায় দুটি অভিযোগ করলেন তাদের অনুসারীরাই।
অভিযোগে ইউপিডিএফের ১১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর একটি করেছেন নানিয়ারচরে উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা হত্যাকা-ে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মোটরসাইকেলচালক রূপম দেওয়ান। এতে নামোল্লেখ করে ৭২ জনকে আসামি করা হয়েছে। আর অপর মামলাটি করেছেন ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা বর্মার অনুসারী অরজিন চাকমা। এতে নামোল্লেখ করে ৪৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় স্বজনদের অনাগ্রহ বিষয়ে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের কেন্দ্রীয় সদস্য লিটন চাকমা বলেন, ‘প্রসিতের নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের পক্ষ থেকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকির কারণে পরিবারের পক্ষে কেউ মামলা দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না’। তার দাবি, গত বছর ডিসেম্বর থেকে এ পর্যন্ত তাদের ১৪ নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে ইউপিডিএফ। তাদের অনেকের খবরই প্রশাসন ও গণমাধ্যমে আসেনি।
এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে প্রসিতের ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমা বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ মূল অপরাধীদের আড়াল করবে, নিরাপরাধ মানুষকে হয়রানির সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে’। জনগণকে নিয়ে তাদের কোনো কর্মসূচি নেই। তাই জনগণই তাদের প্রতিহত করছে। ইউপিডিএফ জনগণের সঙ্গে আছে।
খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) এম এম সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে খুনোখুনি বাড়ছে। নিজেদের নিরাপত্তার কারণেই স্বজনরা মামলা দায়েরে আগ্রহ দেখান না। বাদী পাওয়া না গেলে পুলিশ বাদী হয়’।
রাঙামাটি পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবীর বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূপ্রকৃতিই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নির্বিঘœ করার জন্য বড় অন্তরায়। সমতলের মতো আইনি প্রতিকার কিংবা ব্যবস্থা নেওয়ার মতো এখানে পরিবেশ নেই। ভিকটিম এগিয়ে এলেই আইনি প্রতিকার দিতে পুলিশ প্রস্তুত আছে।