পিতৃত্ব ফেরিযোগ্য পণ্য নয়!

মুহম্মদ শামসুল হক

বিশ শতকের শেষ পাদের এবং একুশ শতকের গোড়ার দিকে বিজ্ঞানমনস্ক নতুন প্রজন্মের চিন্তাচেতনা পরিপন্থী এই রচনাটির জন্য শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মূলত কারও চেতনায় আঘাত করার জন্য নয়, নিছক বিবেকের তাড়নাতেই রচনাটি তৈরি করতে হচ্ছে। কারও অজানা নয় যে বন্ধ্যাত্ব কোনো দম্পতির কাম্য নয়। সংসার নীড় রচনার পর প্রত্যেক দম্পতিই নির্দিষ্ট সময়ে সংসারে নতুন মুখের আগমন প্রত্যাশা করে। কিন্তু কোনো অজানা কারণে নতুন মুখের আগমন বিলম্বিত হলে দম্পতির কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে; অভিভাবকদের মুখে মেঘ উড়তে শুরু করে এবং নানা গুঞ্জনে সুখের সংসারে রাহুর পদচারণ শুরু হয়ে যায়। সন্তান-সন্ততি পিতা-মাতার জীবনে জগদীশ্বরের কত বড় আশীর্বাদ, তা বন্ধ্যা দম্পতিরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন।

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় শিশুর জন্মদানের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা উভয়কে ২২ জোড়া হারে সর্বমোট ৪৪ জোড়া ক্রোমোজোম প্রদান করতে হয়। আবার নারীদের ২২ জোড়া ক্রোমোজোমের প্রকৃতি সর্বদা ঠিক থাকে এবং পুরুষের ২২ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে ২১ জোড়ার প্রকৃতি সর্বদা ঠিক থাকে। আর মাঝে মাঝে ১ জোড়া ক্রোমোজোমের প্রকৃতি পরিবর্তিত হয় এবং ওই পরিবর্তিত ক্রোমোজোমের কারণে নবজাতক শিশুটি বালক হয়। অথচ সনাতনী ব্যবস্থায় এবং নিরক্ষর সমাজব্যবস্থা কন্যাসন্তান জন্মের দায়ভার সর্বদা প্রসূতির ঘাড়ে চাপিয়ে থাকে।

উল্লেখ্য, পিতা-মাতার উর্বর শুক্রাণু ও ডিম্বাণু মিথুন প্রক্রিয়ায় পরস্পর নিষিক্ত হলেই মাতৃগর্ভে ভ্রƒণের সঞ্চার হয়। কোনো দম্পতির ডিম্বাণু ও শুক্রাণু উর্বর না হলে তাদের সারা জীবন বন্ধ্যাত্বের অভিশাপ পোহাতে হয়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান নানা উপায়ে ভ্রƒণ সঞ্চারের চেষ্টা করলেও জগদীশ্বরের অবদানের নিকট তা নেহাত তুচ্ছই বলা চলে। তাই অনায়াসে বলা যায়, পিতৃত্ব কিংবা মাতৃত্ব মূলত বিশ্ববিধাতার অনন্য অবদান। অথচ দুর্ভাগ্যক্রমে বিজ্ঞানমনস্কতার দোহাই দিয়ে এবং প্রাগ্রসরতার বুলি আউড়ে একশ্রেণির ব্যবসায়ী হাল আমলে পিতৃত্ব এবং মাতৃত্বকে নিয়ে রমরমা বাণিজ্য শুরু করেছেন। ৩ জুলাইকে বিশ্ব পিতৃত্ব দিবস (ওয়ার্ল্ড ফাদার’স ডে) হিসেবে অভিহিত করে দিবসটি উপলক্ষে রকমারি ফুল, মুখরোচক আহার্য, বাহারি পোশাকের বাণিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা আয় করছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠী।

পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব দিবস উপলক্ষে চোখ ঝলসানো বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মধ্যম বয়সী যুবক-যুবতীদের পকেট কাটার ঘৃণ্য প্রতিযোগিতার আড়ালে পিতা-মাতার প্রতি সন্তান-সন্ততিদের প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের চিন্তাচেতনায় ভালোবাসা দিবস, পিতৃত্ব দিবস, মাতৃত্ব দিবস ইত্যাদি স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসেছে। তাদের দৃঢ়বিশ্বাস, সারা বছর গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড, নিজ প্রিয়তমা পত্নী, পুত্র-কন্যাকে নিয়ে আলাদাভাবে সুখ-শান্তিতে বসবাসের পর বিশেষ বিশেষ দিবসে পিতা-মাতাকে ফুল দিয়ে বরণ এবং ভূরিভোজে আপ্যায়ন করলেই সন্তান হিসেবে পিতা-মাতার প্রতি তাদের করণীয় যথারীতি নির্বাহ হয়ে যায়। সময়ের অগ্রগতিতে নতুন প্রজন্মের এই ভ্রান্ত ধারণা ক্রমশ ডালপালা মেলে বিশাল মহিরুহের আকার ধারণ করছে। ফলে বৃদ্ধাশ্রম, ওল্ডকেয়ার সেন্টার ইত্যাদিতে সারা দুনিয়া ভরে যাচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত অসহায় পিতা-মাতার সংখ্যাও উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শ্রুতিকটু শোনালেও বলতে বাধ্য হচ্ছি জন্মের অব্যবহিত পর মানবশিশুর মতো অসহায় সৃষ্টি আর কেউ হয় না। বানরের শাবক প্রসবের অব্যবহিত পরপরই গাছের ডাল ধরে ঝুলতে শেখে। গরুর বাচুর জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উঠে দাঁড়াতে এবং যত্রতত্র চড়ে বেড়াতে পারে। অথচ শুধু হামাগুড়ি দিয়ে চলতে এবং আলতোভাবে হাঁটতেই প্রত্যেক মানবশিশুর দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগে। শিশুর সেবা-যত্ন, আহার-বিহার, ভরণপোষণ, শিক্ষাদান এবং তাদেরকে যুগোপযোগী মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পিতা-মাতার অবদানের তুলনা হয় না। এমনতর বাস্তবতার নিরিখে হজরত লোকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে বলেছিলেন, হে বৎস! কখনো পিতা-মাতার সঙ্গে উচ্চস্বরে কথা বলো না। তাদের মর্মপীড়ার কারণ হয়, এ ধরনের উহ্ শব্দটিও মুখে উচ্চারণ করো না। আর তাদের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনাকালে বলবে, রাব্বির হামহুমা কা’মা রাব্বাইয়ানি ছাগিরা।
যুক্তরাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থায় দিনে দিনে ইউনিট ফ্যামিলির সংখ্যা বাড়ছে। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে সঙ্গে রাখা অনেকেই অযথা বিড়ম্বনা এবং নিজেদের সন্তান-সন্ততির অন্তর্নিহিত সহজাত গুণাবলির সুষম বিকাশের অন্তরায় জ্ঞান করে থাকেন। বর্তমানে ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সী অনেক পিতা-মাতাই নিজেদের এবং সন্তানদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে পিতা-মাতাকে ওল্ডকেয়ার সেন্টারে প্রেরণ করছেন। আজ থেকে ২০-৩০ বছর পর যখন তারা ৭০ বছর বয়সে পা দেবেন, তখন নিজেদের অবস্থা কী হবে তা এখনই দয়া করে একটু ভেবে দেখুন। কারণ তখন বৃদ্ধাশ্রম এবং ওল্ডকেয়ারে থাকা লোকের সংখ্যা এত তুঙ্গে উঠবে যে স্থান সংকুলান না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সেই বয়সে ন্যুব্জ দেহ এবং কুব্জ পৃষ্ঠ নিয়ে আপনার আর আমার আশ্রয় হবে আমেরিকার সড়ক। তদুপরি আমেরিকায় বর্তমানে যে হারে সিঙ্গেল ফাদার এবং সিঙ্গেল মাদারের সংখ্যা বাড়ছে, হয়তো-বা ৩০ বছর পর পরিবার বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তখন হিমাঙ্কের নিচের তাপমাত্রা এবং কাঠফাটা রোদে আমাদের অবস্থা কী হবে, তা ভাবতে অজানা আশঙ্কায় সত্যিই শরীর শিউরে ওঠে। হে দয়াময়, তুমি আমাদের সহায় হও। আমিন!

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক
১৭ জুন ২০২৩