নিজস্ব প্রতিনিধি : ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের পর নবগঠিত কমিটিতে খুব বেশি পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। পুরোনো নেতৃত্বের ওপরই আস্থা ও ভরসা রেখেছে দলটি। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের ৮১টি পদের মধ্যে ৪৬ জনের নাম ঘোষণা করেছেন দলটির নবনির্বাচিত সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের কর্মকাণ্ডে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়, অদক্ষ ও ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে ফেলা স্বল্পসংখ্যক নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে কমিটি থেকে।
২৪ ডিসেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক ছাড়াও অন্য গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তেমন পরিবর্তন আনেননি দলীয় প্রধান। মাত্র ছয়জন নেতা কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্ব থেকে বাদ পড়েছেন। বাদ পড়া ছয়জনের পাঁচজনকেই পদায়ন করা হয়েছে দলের ‘থিংক ট্যাংক’ হিসেবে পরিচিত উপদেষ্টা পরিষদে। আর উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বাদ পড়েছেন একজন। দলের গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম সভাপতিমণ্ডলী থেকে বাদ পড়েছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ, রমেশ চন্দ্র সেন ও আবদুল মান্নান খান। তাদের উপদেষ্টা পরিষদে নেওয়া হয়েছে। সেখানে এসেছেন আগের কমিটির সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। সম্পাদকমণ্ডলীতে বাদ পড়েছেন বিদায়ী কমিটির যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক হারুনুর রশীদ, শ্রম ও জনশক্তিবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক। হারুন ও সিরাজের স্থান হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদে। সম্মেলনের দুদিন পর ২৬ ডিসেম্বর রাতে আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক করা হয়েছে জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ও নড়াইল-২ আসনের সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মুর্তজাকে। ওই দিন গণভবনে সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই ঘোষণা দেন।
গত ১৪ বছরে চারটি সম্মেলনে গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ৩১২টি পদের মধ্যে মাত্র ২৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ ছিল নতুন মুখ। কমিটিগুলোতে বেশি হয়েছে পদের রদবদল। অর্থাৎ ঘুরেফিরে একই ব্যক্তিরা পদ-পদবি পেয়েছেন। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২১ দশমিক ১৫ শতাংশ নেতার পদ পরিবর্তন হলেও তারা কমিটিতে থেকে গেছেন। আগের কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, এমন নেতার সংখ্যা খুবই কম, অঙ্কের হিসাবে সেটি ১৯ দশমিক ২৩ শতাংশ।
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় অবস্থান ধরে রাখা এবং আসন্ন রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় দলটির নেতৃত্বে তেমন রদবদল করা হয়নি। তা ছাড়া নেতৃত্ব প্রশ্নে দলীয় কোন্দল যাতে মাথাচাড়া না দেয়, দলের ওপর পরীক্ষিত ও পুরোনো নেতাদের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব যাতে বজায় থাকে, সেসব বিবেচনায় পুরোনোদেরই বহাল রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যারা অভিজ্ঞ ও পুরোনো নেতা, মূল গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তাদের নিয়োগ দেওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। সামনের নির্বাচন আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানে এক পাশে আছে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল। বিএনপির সঙ্গে অলিখিতভাবে জামায়াত তো আছেই। এ ছাড়া বাম শক্তি, ওয়ানম্যান পার্টিগুলো আছে, যেগুলোর বেশির ভাগ সরকারবিরোধী অবস্থানে আছে বলে মনে হয়। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের সামনে যারা প্রতিপক্ষ, তারা কিন্তু বেশ শক্তিশালী। নেতৃত্ব নির্বাচনে হয়তো এসব বিষয় বিবেচনা করতে হয়েছে। তা ছাড়া বর্তমান আর্থসামাজিক ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সামনে একধরনের ঝুঁকি আছে। কিছু বিদেশি দূতাবাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা অন্যান্য কর্মকাণ্ডে নাক গলাচ্ছে, যেগুলো সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়বে বলে মনে হয়। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় অভিজ্ঞ নেতৃত্বের প্রয়োজন আছে।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর দলের জাতীয় সম্মেলনে নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আসে। ওই সময় নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি প্রশংসিত হয়। পরের চারটি সম্মেলনে ওই কমিটির মতো বড় পরিবর্তন আর আসেনি। ২০০৯ সালের কমিটিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারাই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠে বিরোধীদের কর্মসূচি মোকাবিলা করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় আওয়ামী লীগকে জয়ী করতে কাজ করেছিলেন ওই কমিটির নেতারা। এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মাঠ দখলের চেষ্টা করছে, নির্বাচনের বাকি আর এক বছর। এই সময়ে পুরোনো ও পরীক্ষিতদের অভিজ্ঞতাকে আরও কাজে লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
কমিটির মূল পদগুলো ঘোষণার পর দলের নেতাদের মধ্যে প্রকাশ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। দলের নেতারা বলছেন, কাউন্সিলরদের সামনে রেখে তাদের মূল নেতা যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাতে অনেক হিসাব-নিকাশ রয়েছে। তবে নেতারা বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিলেও কর্মীদের মধ্যে কিছুটা হতাশা রয়েছে। কারণ নেতা বড় পদ পেলে কর্মী বা সমর্থকেরা বেশি অনুপ্রাণিত হন। কমিটি ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে যোগ দেওয়া তৃণমূল কর্মীদের অনেকেই হতাশা প্রকাশ করেন। নেতৃত্ব ঘিরে তাদের মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল, কমিটি ঘোষণার পর তা অনেকটাই ম্লান হয়। কারও কারও বক্তব্য ছিল, আগের কমিটির সবাইকেই যদি রাখা হয়, তাহলে সম্মেলনের কী প্রয়োজন ছিল?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই- এটা সবাই মানেন। কিন্তু অন্য শীর্ষস্থানীয় পদগুলোতে রদবদল প্রয়োজন ছিল। তা না হলে এই কমিটির জন্য সম্মেলন ডাকার দরকার ছিল না।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, বলা যায় নবীন-প্রবীণদের সমন্বয়ে ভালো কমিটি হয়েছে। আরও কিছু নতুন মুখ হয়তো আসবেন, তারাই ভবিষ্যতে দলের আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে যাবেন।
তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া ওবায়দুল কাদের বলেন, আগামী নির্বাচন ও বিশ্ব পরিস্থিতি সামনে রেখে আমাদের দেশেও সংকট আছে। জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, বিএনপির নেতৃত্বে সরকার হটানোর আন্দোলনসহ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সামনে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো মোকাবিলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অভিজ্ঞদের রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের সভাপতি।