পৃথিবী নামের গ্রহটি কি সত্যি এবার ধ্বংস হয়ে যাবে? তার অন্তিম সময় কি ধেয়ে আসছে। মানবজাতির বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে যাবে এ পৃথিবী? এ রকম অশনিসংকেত মিলছে ঘরে-বাইরে চতুর্দিক থেকে। চারদিকে দুঃসংবাদ আর দুঃসংবাদ। দুঃসংবাদের প্রবল প্লাবনে সুসংবাদ যেন ভেসে গেছে! তাই তো কোথাও থেকেই কোনো সুসংবাদ নেই। বাংলাদেশ আমাদের জন্মভূমি। আমেরিকা আমাদের বাসভূমি। সর্বত্রই এমন সব সংবাদ, যেন পিলে চমকে যায়!
সবাই বলছেন, বৈশ্বিক সংকটের অভিঘাতেই যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেই সংকটই বিশ্বজুড়ে আজ ছড়িয়ে পড়েছে। সে কারণেই বর্তমান সংকটকে বৈশ্বিক সংকট বলা হয়েছে। কিন্তু যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে, সেই সংকট তৈরির পেছনে তিনটি দেশ ছাড়া আর কারও কোনো অবদান নেই। চীনের উহানের কোভিড-১৯ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব মহামারির জন্ম দিল। তার পেছনে অন্য কোনো দেশেরই কোনো হাত ছিল না। কিন্তু ভুক্তভোগী হলো সব দেশ। সব দেশের মানুষই প্রাণ দিল। এখনো সেই সংকট থেকে মানুষ মুক্তি পায়নি। এখনো বিশ্বব্যাপী মানুষ মরছে। এই আমেরিকাতে এখনো প্রতিদিন কয়েকশ করে মানুষ মরছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকেও শুরু হয়েছে বৈশ্বিক তীব্র অর্থনৈতিক সংকট। সেই সংকটে যুদ্ধরত দুই দেশ কতটা বৈশ্বিক সংকটের শিকার, তা তারা অনুভব করতে পারছে, সে কথা বলতে না পারলেও বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। সব বিশেষজ্ঞ, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, জ্ঞানী-গুণী, প্রজ্ঞাবান সবাই সামনে বিশ্বজুড়ে মহামন্দা দেখতে পাচ্ছেন। মহামন্দার রূপ কেমন হবেÑতাও তুলে ধরছেন অনেক নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন জাতিসংঘ, তেমনি নিজ দেশ বাংলাদেশকেও বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, সামনে ভয়াবহ মন্দা ধেয়ে আসছে। এই মন্দা মহামন্দায় রূপ নেবে। এ থেকে দেশ ও মানুষকে রক্ষা করতে এখন থেকেই সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে সেই ধেয়ে আসা মহামন্দা মোকাবিলা করতে।
অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আগামীতে সমগ্র বিশ্বকেই গ্রাস করবে বলে মনে করছেন বিশ্বের সমর বিশ্লেষকেরা। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল রাশিয়ার অংশ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এতে বিশ্বজুড়েই চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল অ্যান্তোনিও গুতেরেস, ইউরোপ ও বিশ্বনেতারা এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। পুতিন হুমকি দিয়েছেন, অধিকৃত চারটি অঞ্চলে প্রতিপক্ষ কোনো রকম আক্রমণ চালানোর চেষ্টা চালালে রাশিয়া প্রয়োজনে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারে দ্বিধা করবে না। তার এই ঘোষণায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘পুতিনের আচরণ পৃথিবীকে বড় ধরনের যুুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’
বড় যুদ্ধের আতঙ্ককে আরো অবশ্যম্ভাবী করে তুলছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ন্যাটো সদস্যভুক্ত হওয়ার সক্রিয় উদ্যোগকে। যোগদানের প্রাসঙ্গিক সব প্রস্তুতি শেষ করে এনেছে ইউক্রেন। অচিরেই সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদন করবেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। এ রকমটা ঘটলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোও জড়িয়ে পড়বে। ন্যাটোর ঘোষিত দায়িত্ব হচ্ছে তার সদস্য যেকোনো দেশকে রক্ষায় ন্যাটো প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে। ন্যাটোর সদস্যদেশের মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জার্মানি, ফ্রান্সÑএই চার পরাশক্তির বাইরে আরো অনেক দেশ। যদিও রাশিয়ার বিরুদ্ধে চীনের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্র তো ইউক্রেনের হারানো রাষ্ট্রসীমা ফিরিয়ে আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এমন পরিস্থিতি চলমান থাকলে সমর বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বিশ্বব্যাপী একটা বড় যুদ্ধই কেবল নয়, পরমাণুযুদ্ধের ভয়াবহতাও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে মহামন্দার আশঙ্কা নিয়েও দেশে দেশে উদ্বেগ প্রকাশিত হচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সতর্কতা নিয়ে ঠিকানার গত ৫ অক্টোবরের সংখ্যায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ৮৬ পৃষ্ঠায়। প্রতিবেদনটির শিরোনাম হয়েছে, ‘আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি ৯৮ শতাংশ’। যার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যেও।
প্রতিবেদনটিতে মন্দার আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, ‘বিশ্বজুড়ে রেকর্ড উচ্চতার মূল্যস্ফীতির চাপ। পরিস্থিতি সামাল দিতে আগ্রাসীভাবে সুদের হার বাড়াচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। কোভিডজনিত প্রতিবন্ধকতা এবং তার পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধ। এর ফলে বিপর্যস্ত অবস্থা পার করছে বিশ্ব অর্থনীতি। এ অবস্থায় আগামী বছর বৈশ্বিক অর্থনীতি মন্দায় পড়তে যাচ্ছে।’ মার্কিন বিনিয়োগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নেড ডেভিস রিসার্চের একটি সম্ভাব্যতা তুলে ধরা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মন্দার ঝুঁকি ৯৮ দশমিক ১ শতাংশ। সর্বশেষ ২০০২, ২০০৮ ও ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটকালে ঝুঁকির স্তর এমনটিই ছিল।
নেড ডেভিসের গবেষকেরা বলেছেন, ‘২০২৩ সালে কিছু সময়ের জন্য একটি গুরুতর অর্থনৈতিক মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারীরা আরো বেশি ঝুঁকি নিয়ে সতর্কতা করছেন।’ অথচ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে না। চলতি বছর এবং আগামী বছরে প্রকৃত আয় আরো কমবে। বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের সম্পদের পরিমাণ কমলেও সাধারণ নাগরিকদের ব্যয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। চলমান সংকটের অভিঘাতে মার্কিন নাগরিকদের পারিবারিক সম্পদ হ্রাস পেয়েছে। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে তাদের সম্পদের রেকর্ড পতন ঘটেছে। বর্তমান সময়ে মার্কিন অর্থনীতি মন্দার কবলে এখনো না পড়লেও মন্দার ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
বর্তমানে আমরা বসবাস করি বিশ্বপল্লির কনসেপ্টে। কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে একা একা এগিয়ে যেতে পারে না। কিন্তু গ্লোবাল বিশ্বপল্লির বিশ্বব্যবস্থায় আফ্রিকা-এশিয়ার দরিদ্র, দুর্বল, পিছিয়ে পড়া দেশগুলো কতটা লাভবান হয়Ñএ কথা নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও বড় বড় পরাশক্তি, মুনাফালোভী, যুদ্ধবাজ দেশের কর্মকাণ্ডে যে দরিদ্র দেশগুলো প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এ কথা বলা যায়। বাংলাদেশের মতো দেশ বা আফ্রিকার কোনো হতদরিদ্র দেশ কোভিডের মতো বিশ্ব মহামারি কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য কোনো রকম দায়ী না হলেও তার কুপ্রভাব থেকে কেউ দূরে থাকতে পারছে না। তাদের শিক্ষা, আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্য, বস্ত্র এবং জীবনের বিনিময়ে ধনী দেশগুলোর খেয়াল-খুশি মেটাচ্ছে।
এই অবস্থার অবসান ঘটা জরুরি। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? শিশুতোষ পাঠ্যে আমরা পড়েছি সেই ‘ব্যাঙ এবং দুষ্ট বালকদের’ গল্প। আসলে যা কারো জন্য খেলা, তা-ই আবার কারো জন্য মৃত্যু! এই খেলা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া দরকার। নইলে পৃথিবী নামের গ্রহটির অন্তিম সময় ঘনিয়ে আসতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।