ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ
পেনসিলভানিয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে প্রাইমারি নির্বাচনে বাংলাদেশি-মার্কিন নারী ড. নিনা আহমেদ লড়ে জয়ী হতে পারেন নি। সত্যি কি তিনি পরাজিত হয়েছেন? পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে নিনা আহমেদ আহমেদ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। কংগ্রেস পদের নির্বাচনে তৈরি হওয়ার জন্য তিনি ফিলাডেলফিয়া ডেপুটি মেয়রের পদে ইস্তফা দেন। কিন্তু কিছুদিন পর সুপ্রিম কোর্ট তার এলাকা অন্য এলাকার সাথে একীভূত করে তার এলাকা শূন্য ঘোষণা করলে দিলে তিনি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ফিলাডেলফিয়ার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তাকে অনুরোধ জানান লেফটেন্যান্ট গভর্নরের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য। প্রথমে তিনি ইতস্তত করলেও পরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেন। তাই অন্য প্রার্থীরা যখন এক বছরেরও আগে থেকে প্রচারণা শুরু করেছেন, তিনি বাধ্য হয়ে, অনেক দেরিতে, মাত্র ১১ সপ্তাহ নির্বাচনী প্রচারণা করার সময় পান। এ সময় তার সাথে যোগ দেন সর্বস্তরের মানুষ।
ফিলাডেলফিয়াতে নিজের কর্মতৎপরতার গুণে ড. নীনা আহমেদ হয়ে উঠেছিলেন একটি পরিচিত নাম। মাত্র ২১ বছর বয়সে স্বামী-স্ত্রী আমেরিকাতে আসেন তারা। ১৯৯০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া থেকে পিএইচডি এবং জেফার্সন ইউনিভার্সিটিতে মলিকুলার জেনেটিক্সের উপর ফেলোশিপ করেন। তারপর উইলস আই হাসপাতালে রিসার্চ সাইন্টিস্ট হিসেবে অত্যন্ত সাফল্যের সাথে পেশাগত উন্নতি সাধন করতে থাকেন। সে সময় ফিলাডেলফিয়ার অনেক সাধারণ মানুষের দুঃখ ও অর্থনৈতিক দৈন্য তাকে মানসিক পীড়া দেয়। তিনি বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের মুখচ্ছবি দেখে শুধু রিসার্চে নিয়োজিত না থেকে রাজনীতিতে প্রবেশ করে এর প্রতিকারের জন্য সক্রিয় হন। তার স্বামী আহসান নসরুল্লাহ ততোদিনে নিজেকে ব্যবসায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ড. নীনা আহমেদকে চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি রাজনীতিতে নামার অনুপ্রেরণা দেন।
স্বামীর অনুপ্রেরণা এবং প্রবাসী স্বদেশিদের ভাগ্যোন্নয়নে ফিলাডেলফিয়া ডেমক্র্যাটিক পার্টিতে যোগদান করেন। নীনা শহরের বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে আত্মনিয়োগ করেন। কারো সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়াই নিজ মনোবলের জোরে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জন্য প্রচারণা, তহবিল সংগ্রহ, বিভিন্ন দেশের নতুন অভিবাসীদের সাহায্য করাসহ নানা কাজে তার ব্যস্ততা বাড়তে থাকে।
একজন বিজ্ঞানী এখন রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্য এবং নিজের উপর অগাধ আস্থা, সংবেদনশীলতা, বাগ্মিতা ও সাহসের জন্য খুব দ্রুতই সব মহলে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তৎকালীন ফিলাডেলফিয়ার মেয়র ২০০৯ সালে তাকে একাধারে এশিয়ান কমিশন এবং জাতীয় নারী সমিতির সভানেত্রী হিসাবে মনোনয়ন প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ফিলাডেলফিয়া ফাউন্ডেশনের বোর্ড মেম্বার নির্বাচিত হন। ধীরে ধীরে তিনি আমেরিকার মূলমঞ্চে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন।
২০০৪ সালে ড. নীনা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হাওয়ার্ড ডিনের নির্বাচনী প্রচারণায় জাতীয় পর্যায়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন এবং বাংলাদেশি কমিনিটির সাথে উন্নয়নের জন্য কাজ শুরু করেন। ২০১৪ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসাবে প্রেসিডেন্ট ওবামা তাকে এশিয়ান-আমেরিকান এবং প্যাসিফিক আইল্যান্ডার কমিশনের সদস্য নির্বাচিত করেন। ২০১৫ সালে তিনি ফিলাডেলফিয়ার ডেপুটি মেয়র নিযুক্ত হয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পেনসিলভানিয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে প্রাথমিক নির্বাচনে নীনা আহমেদেও অংশগ্রহণ পুরো আমেরিকাতে বাংলাদেশিদের ভেতর আলোড়ন সৃষ্টি করেন যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবার সযোগিতার উদাহরণের একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। বাংলাদেশি-আমেরিকানরা ফিলাডেলফিয়া, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ওয়াশিংটন ডিসি, মিশিগান, বাল্টিমোর, ভার্জিনিয়া, ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাদা এবং আরো অন্যান্য জায়গা থেকে তার জন্য বিপুল পরিমাণ তহবিল সংগ্রহ করেন। ফিলাডেলফিয়ার মূলধারার অঢেল রাজনৈতিক সহযোগিতা পেলেও সমস্ত দেশের বাংলাদেশি-আমেরিকানদের তহবিল সংগ্রহ ছিলো একটি অনবদ্য সহায়তা।
ড. নীনা আহমেদের নির্বাচনী প্রচারণা মূলত ছিলো বর্তমান সরকারের মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করা এবং পেনসিলভানিয়াতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠা করা। সবার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, রাজনীতিতে স্বচ্ছতা, নারীদের সমান অধিকার এবং সম্মান, অভিবাসীদের ন্যায্য অধিকার ইত্যাদি যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তিনি তার প্রচারণা চালিয়ে যাবেন। নীনা আহমেদ বলেন, আমি ভয় পাই না, কারণ আমি বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম দেখেছি এবং সেই ভয়ঙ্কর সময়ের ভিতর দিয়ে পার হয়েছি। পাকিস্তানিদের বর্বরতা এড়াবার জন্য আমার মা আমাকে তখন ছেলেদের মত চুল কেটে রাখতেন। আমি ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছি। তাঁদের আত্মত্যাগের জন্য আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি এবং আমি আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরেছি। বাংলাদেশ আমার হৃদয়ে এবং আমি যতোটুকু পারি সাহায্য করে যাবো।
ড. নীনা বলেন, আমার নির্বাচনী প্রচারণার আরেকটা বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে- আমি সামনে গিয়ে আজ দ্বার খুলে দিতে চাই, যেনো কেউ আপনাদের বা আপনাদের প্রজন্মকে তাদের গায়ের রং, ধর্ম, বা কোন দেশে থেকে এসেছে- সেটা জিজ্ঞেস করতে না পারে।
নীনা আহমেদ যেনো দেখিয়ে দিতে চাইলেন যে এ দেশের মানুষ জানুক বাংলাদেশ থেকে একজন শিক্ষিত সুবক্তা নারী, যিনি একজন বৈজ্ঞানিক, সৎ ও সাহসী রাজনীতিবিদ আমাদের জানান দিয়ে গেলো।
নীনা আহমেদের নির্বাচনে বৃহত্তর ফিলাডেলফিয়ার বহু সংখ্যক বাংলাদেশি-আমেরিকান ভলান্টিয়াররা প্রচন্ড উৎসাহের সাথে দিনরাত প্রচারণা চালিয়ে যান। এমন কি অনেক ডানকিন ডোনাট এবং অন্যান্য জায়গায় চাকরিরত সাধারণ বাংলাদেশি-আমেরিকানরা ভোটারদের ফ্রি কফি বিতরণ করে তার জন্য ভোট প্রর্থণা করেন। দিনটি ছিলো অপূর্ব সুন্দর এবং সহমর্মিতার উদাহরণ। ড. নীনা আহমেদের নির্বাচনী প্রচারণা এবং তার অর্জন বাংলাদেশিদের ভেতর অফুরন্ত আশার বাণী নিয়ে এসেছে। তাই এ নির্বাচনে নীনার সাথে বাংলাদেশি-আমেরিকানদেরও সামনে চলার এবং আগাম জয়ের শুভ সূচনা করেছে।