বিশেষ প্রতিনিধি : রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বড় বড় আপদ সামলে নিলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থা আর ঢাকতে পারছে না সরকার। পারছে না মোকাবিলা করতেও। আগে দক্ষতা, আত্মবিশ্বাস ও নানা কৌশলে অবিরাম অনেক বিপদ কাটিয়ে নিয়েছে। ফাঁপরের ওপরেও কেবল চোখে-মুখে ধুলোই নয়, বীরত্বের সঙ্গে এগিয়েও থেকেছে। সরকার প্রাকৃতিক-বৈশ্বিক দুর্যোগকে কাজে লাগিয়েছে সাফল্যের সঙ্গে।
করোনার দোহাই দিয়ে অনেক কিছু সামলেছে। গত মাস কয়েক চেষ্টা করেছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দিয়ে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও আন্তর্জাতিক সহায়তা- সহানুভূতি নিয়েছে। হালে সবকিছুতে টান পড়ে যাওয়ায় আর তা কুলাতে পারছে না। শুঁটকি-লতির চড়া দাম বা দীর্ঘ যানজটের জন্যও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করার যুক্তি বিকোচ্ছে না মানুষের কাছে। শুধু আমদানি পণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত জিনিসপত্রেরও অযৌক্তিক বাড়তি দাম মানুষের ভাতের থালায় টান দিয়েছে।
একটা সময় যানজটের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দুনিয়াকে, যেকোনো অঘটনের জন্য ব্রিটেন বা সেখানে অবস্থানকারী বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে দায়ী করতে সমস্যা হয়নি। বিশ্বব্যাংক বা ড. ইউনূসকে দোষী করলেও বাধা আসেনি। মানুষকে কম-বেশি গেলানোও গেছে। অতি চাতুরী এবং ‘গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়ন জরুরি তত্ত্ব’ বাস্তবায়নের জেরে সরকারের হালে এ দশা। চতুর্মাত্রিক চাপে এমন চ্যাপ্টা হওয়ার শঙ্কা সরকার কখনোই করেনি।
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার কাজে অনীহার কারণে সকল রাজনৈতিক দলের ওপর ঝড়-ঝাপটা এসেছে। সুশাসন বা গণতন্ত্রকে ন্যূনতম কাঠামোতে রাখার বদলে অভিনব যে কায়দায় দীর্ঘ ১৪ বছর ক্ষমতায় রয়ে গেল এবং আরো ছয় বছর ক্ষমতায় থাকার কৌশল চর্চা করেছে, বাংলাদেশে আগে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। যা রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্র, সংবিধান, জাতিসংঘের নীতিমালা এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার পরিপন্থী কি না, তা ভাবার ফুরসতও দেওয়া হয়নি। ওই ভাবনার সম্ভাব্য অংশীজন রাজনীতিক, অর্থনীতিক, কূটনীতিক, শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের রাখা হয়েছে দৌড়ের ওপর। সাংবিধানিক সংকট, আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতা, বৈশ্বিক স্নায়ুযুদ্ধের এই সন্ধিক্ষণে এসে সেই হিসাব-নিকাশ, বিশ্লেষণ চলছে পুরোদমে। এদের সঙ্গে সায় ও সুর মিলিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি আরো কিছু চাপও হয়েছে। গেল তিনবারের কৌশল চতুর্থবার বাস্তবায়ন সহজসাধ্য হবে কি না, মোটাদাগের প্রশ্ন।
অর্থনীতি ও রিজার্ভ নিয়ে নৃত্য, ‘আমরা ঋণ নিই না, দিই’ ধরনের বড়াইয়ের অবস্থা আর নেই সরকারের। দেশ সিঙ্গাপুর-কানাডা হয়ে যাওয়ার আওয়াজের গোমরও ফাঁস হয়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি-মূল্যস্ফীতির তথ্যও পরিষ্কার। ঘটা করে দেশকে শতভাগ বিদ্যুতায়নের রাজ-উৎসবের অতলেও হাত পড়ে গেছে। দৃশ্যত গোটা দেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয়, আনলিমিটেড লোডশেডিং, মিল-কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট এবং নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতির ধাক্কা। আর নেপথ্যে বিভিন্ন সেক্টরে সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, পাচারের ধকল এখন একসঙ্গে পড়েছে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে বিরোধী দলের সোচ্চার হয়ে ওঠা। এসবের কেমেস্ট্রি সামলে ওঠা কঠিন ঠেকছে সরকারের জন্য। এর জেরে একেক সময় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের একেক কথায় তালগোল আরো পাকছে।
যুদ্ধের সময় দেশে বিদ্যুৎ ছিল না মনে করিয়ে ভবিষ্যতে প্রয়োজনে দিনে ঘরবাড়িতে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। ‘আমাদের রিজার্ভ কমে গেছে। আমাদের হাতেও টাকা নেই। সামনে কী হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না’-মন্তব্যও করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, বিদ্যুৎ বিপর্যয় নিয়ে এ ধরনের কথায় কান না দিতে। তথ্যমন্ত্রীর মতে, এটি উপদেষ্টা তৌফিক ইলাহীর ব্যক্তিগত কথা, সরকারের ভাষ্য নয়। বাম কয়েকটি দলকে দিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টার অপসারণ দাবি মাঠে ছেড়ে দিয়েছে সরকারেরই একটি গ্রুপ। এর আগে, এমন কেওয়াজ বেধেছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের কথায়।
গালগল্পের বাহাদুরি ও জোড়াতালিতে মানুষকে তুষ্ট করার নীতি বুমেরাং হয়ে এখন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে। টানা দুই বছর করোনা মহামারির সঙ্গে লড়াইয়ের ধাক্কা সয়ে গত মাস কয়েকের বাজার পরিস্থিতি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস তুলেছে। এখন লাগামহীন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের নজিরবিহীন ঊর্ধ্বগতিতে শ্বাস পুরোপুরি বন্ধের জোগাড়। নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে দু’বেলা খাবার জোটানোই কঠিন হয়ে পড়েছে। একদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয়-দুর্নীতি, সরকারের লোকদের বিলাসী জীবন, ৪৩ কোটি টাকা দিয়ে সচিবের রাজকীয় বাড়ি, বিরাট লটবহর নিয়ে বিদেশ সফর, কেবল সাঁতার কাটা নয়, ছাগল পালন শিখতেও আমলাদের বিদেশে যাওয়া, হাজার কোটির ইভিএম, লক্ষ কোটি ক্যাপাসিটি চার্জ; অন্যদিকে জনগণকে কৃচ্ছ্র সাধনের আহ্বান বিশেষ এক টার্নিং পয়েন্টে নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশকে। সেই তাপ-চাপের ছিটেফোঁটা বেরিয়ে পড়ছে মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীনদের প্যানিক ডিসঅর্ডারে।