প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য বিছনাকান্দিতে

সিলেট : ‘প্রকৃতির এত রূপ আমি দেখি নাই কখনো, বুঝিতে পারি নাই দূর হইতে, কাছে আসিয়া নিজেকে হারাই তাহারই আলিঙ্গনে’ যেকোনো ভ্রমনপিপাসু এখানে আসার পর এই অনুভূতি না হয়ে উপায় নেই। এমন অপরূপ সুন্দর জায়গাটির নাম বিছনাকান্দি। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা শীতল স্বচ্ছ পানির স্রোতধারা বয়ে গেছে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার বিছনাকান্দির ওপর দিয়ে। পানির সাথে ভেসে আসা ছোট-বড় পাথর, নীল আকাশের গায়ে সবুজ পাহাড়ের হেলান আর পাহাড়ি নদীর কুলুকুলু ধ্বনি যেকোনো পর্যটককে বিমোহিত করে।
এঁকেবেঁকে চলা নদীতে সাম্পানের ভ্রমণ, নদীর পানিতে নারী-শিশুদের পাথর কুড়ানো আর জেগে ওঠা পাথুরে দ্বীপে দুই দেশের মনোহরী পণ্যের পসরা মানুষকে আকৃষ্ট না করে পারে না। কিন্তু সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই বিছনাকান্দি পর্যটকদের কাছে যেমন এক অনন্য স্থান, তেমনি এখানে পৌঁছাতে যে দুর্ভোগ মানুষকে পোহাতে হয় তা নিদারুণ কষ্টের। প্রকৃতির কাছে পাওয়া অনন্য সৌন্দর্যের আনন্দের পুরোটাই থমকে যাচ্ছে এখানকার যোগাযোগব্যবস্থায়। সরেজমিন দেখা যায়, সিলেট শহর থেকে বিছনাকান্দি পৌঁছাতে রাস্তা যেন মৃত্যুকূপ। খানা-খন্দ ও বড় বড় গর্তে ভরা রাস্তায় প্রচ- ঝাঁকুনিতে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকেই। দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অনেক যানবাহন। সিলেট শহর থেকে বিছনাকান্দি পৌঁছাতে যেখানে সময় লাগার কথা মাত্র এক-দেড় ঘণ্টা, সেখানে সময় লাগছে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। তারপর বেশ কিছুটা রাস্তা রয়েছে যেখানে কাদার কারণে কোনো যানবাহনই চলে না। হেঁটে যাওয়াও কষ্টসাধ্য। আরো বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ এলাকায় কোনো ধরনের পাবলিক টয়লেট না থাকা। এতে করে চরম ভোগান্তির শিকার ভ্রমণপিপাসুরা। বিশেষ করে নারী যাত্রীদের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। কারণ সিলেট থেকে তিন-চার ঘণ্টা জার্নি করে নামার পর ফ্রেশ হতে তাদের জন্য কোনো বাথরুম বা টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। কয়েকটি বাড়ি থাকলেও সেগুলো তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। তবে একটি বাড়িতে নারীদের যাওয়ার সুযোগ থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় সুবিধা খুবই কম। তার ওপর সেটি খোলা টয়লেটের মতোই অপরিষ্কার হওয়ায় অনেকেই যেতে পারেন না। স্থানীয়রা জানান, সিলেট শহর থেকে দু’টি রাস্তা দিয়ে বিছনাকান্দি যাওয়া যায়। যার একটির দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। অপর রাস্তার দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। সিলেট থেকে বাসে অথবা সিএনজি অটোরিকশায় করে প্রথমে যেতে হয় গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এ উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম রুস্তমপুর। যেখানে হাদারপাড় বাজারে গিয়ে নামতে হয় যাত্রীদের। প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে গেলেও এখানেই থামতে হয় সবাইকে। এরপর প্রায় ১০-১৫ মিনিট হেঁটে যেতে হয় সাম্পান ঘাটে। সেখান থেকে সাম্পানে অরো ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছাতে হয় স্বপ্নের বিছনাকান্দি জলপ্রপাতে। তবে নদীর পাড় দিয়ে মোটরসাইকেলেও যাওয়া যায় সেখানে। কিন্তু হাদারপাড় বাজার পৌঁছাতেই ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। ঢাকা থেকে কয়েকটি পরিবার নিয়ে বিছনাকান্দি বেড়াতে যান মনির হোসেন ও আজিজুল হাকিম। তার সাথে পুরুষের পাশাপাশি ছিলেন নারী ও শিশুরা। সকালে সিলেট শহর থেকে রিজার্ভ বাসে করে রওনা হন স্বপ্নের বিছনাকান্দির দিকে। সবার চোখেমুখে আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। সিলেট তামাবিল জাফলং হাইওয়েতে ওঠার পর শুরু হয় বিপত্তি। রাস্তার উঁচু-নিচুতে ঝাঁকুনি খেলেও সেটা মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন সবাই। কিন্তু হাইওয়ে থেকে গোয়াইনঘাট অর্থাৎ বিছনাকান্দি যাওয়ার সড়কে প্রবেশ করলেই শুরু হয় চরম বিপত্তি। বিশাল বড় বড় গর্তে ভরা রাস্তা যেন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। যে পাশের চাকা ওই গর্তে পড়ে বাস সে দিকে সপূর্ণটা হেলে পড়ে। এ সময় চিৎকার দিয়ে ওঠে বাসের যাত্রীরা। এরপর ঝাঁকুনি তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে বিছনাকান্দির আনন্দ যেন বাসেই শেষ হতে বসে তাদের। পাথর বোঝাই শত শত ট্রাক চলাচলের কারণে এ রাস্তা মানুষ চলাচলের অনুপযোগী।
তিনি আরো জানান, এখানেই শেষ নয়, সিলেট থেকে রওনা দিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা বসে থাকার পর যখন গোয়াইনঘাটের হাদারপাড়া বাজারে সবাইকে নামানো হয়, তখনই ভোগান্তি পড়ে যান যাত্রীরা। বিশেষ করে নারী যাত্রীদের করুণ অবস্থা হয়। কারণ সবার ধারণা ছিল এত বড় একটি পর্যটন এলাকা সেখানে অবশ্যই কোনো পাবলিক টয়লেট থাকবে। সেখানে নেমে ফ্রেশ হয়ে তবে যাবে স্বপ্নের বিছনাকান্দি। কিন্তু বিছনাকান্দির আশপাশে কোনো ধরনের টয়লেট না থাকায় বিপাকে পড়েন তারা। ওই বাজারের আশপাশে কয়েকটি বাড়ি থাকলেও তারা কাউকে ঢুকতে দেন না। তবে খলিল নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে একটি টয়লটে যেতে পারেন নারীরা। কিন্তু পর্যটকের সংখ্যা বেশি ও টয়লেটের অবস্থা ভালো না হওয়ায় অনেকেই সেখানে যেতে পারেন না। খলিলুর রহমানের মেয়ে শাবানা বলেন, প্রতিদিন কয়েক শ’ নারী পর্যটক আসেন এখানে। আর সবাইকে এই স্টপেজে নেমে হেঁটে ট্রলার ঘাটে যান। সেখান থেকে বিছনাকান্দি যেতে হয়। বাস বা প্রাইভেট গাড়ি থেকে নেমে সবাই পাবলিক টয়লেটের সন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু না পাওয়ায় বিভিন্ন বাড়ির টয়লেট ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করেন। শাবানা বলেন, তাদের একটি টয়লেট। শত শত মানুষ ব্যবহার করায় সেটির অবস্থাও ভালো না। সবাই হয়তো সেটি ব্যবহার করতে পারেন না। স্থানীয় দোকান ব্যবসায়ী আরিফুল জানান, প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার পর্যটক আসেন এখানে। এদের মধ্যে অনেকে সরকারি বড় বড় কর্মকর্তা, নেতারাও থাকেন। সবাইকে এই হাদারপাড়া বাজারেই নামতে হয়। তবে খুব অল্পসংখ্যক লোক মোটরসাইকেল বা নিএনজি অটোরিকশা নিয়ে সরাসরি চলেন বিছনাকান্দি। তিনি বলেন, গাড়ি থেকে নেমে সবাই তার দোকানে ছুটে গিয়ে একটি কথাই জানতে চান ‘ভাই পাবলিক টয়লেট কোথায়’। কিন্তু নিরুপায় হয়ে তাকে বলতে হয়, এখানে কোনো পাবলিক টয়লেট নেই। এলাকাবাসী বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত পাথর বোঝাই বেপরোয়া ট্রাকের কারণে এ এলাকার রাস্তার এই দুরবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনোভাবেই বেপরোয়া ট্রাকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় রুস্তমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাব উদ্দিন বলেন, পাবলিক টয়লেট না থাকায় পর্যটকদের কষ্ট হয় এটি তিনি বুঝতে পারেন। কিন্তু নানা বাধ্যবাধকতার কারণে হাদারপাড়ে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করতে পারেননি। এ ব্যাপারে জেলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংস্থায় তিনি একাধিক আবেদন করেছেন। নিজ উদ্যোগে বিছনাকান্দিতে একটি অস্থায়ী টয়লেট নির্মাণও করেছিলেন। তবে পরিবেশবিদদের বাধায় সেটা ভেঙে ফেলতে হয়েছে। চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে হাদারপাড়া বাজারেই একটি পাবলিক টয়লেট নির্মাণের কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে শিগগিরই তা সম্পন্ন করা হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাথরবোঝাই ট্রাকের কারণেই মূলত রাস্তার সমস্যা। তবে এটি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর সাথে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা জড়িত রয়েছে। তাদের সবার সমন্বয়ে রাস্তা ঠিক করতে হবে। এ দিকে পর্যটকদের বক্তব্য, রাস্তা ও সেবামূলক ব্যবস্থা ঠিক করা গেলে বিছনাকান্দি দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। এ থেকে সরকারের বড় ধরনের রাজস্বও আসতে পারে। স্থানীয়দের একটি সূত্র জানায়, এখানকার পাথর ব্যবসায়ীরা চান না এখানে বেশি বেশি পর্যটক আসুক। কেননা এতে তাদের অবৈধ পাথর উত্তোলন ব্যবসার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূলত সে কারণেই রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয় না।