আশরাফ হাসান
কবি তমিজ উদ্ দীন লোদী আধুনিক বাংলা কবিতায় উচ্চকিত এক নাম। তার কবিতা প্রতীকবাদী ব্যঞ্জনায় জীবনের বেদনাপাঠ। দূরগামী দৃষ্টির প্রখরতা, গভীর বোধসঞ্জাত কল্পচিত্রের প্রসারণ, হৃদয়নিবিড় বাকভঙ্গি, মূল্যবোধে উত্তরণ তার কবিতাকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। আশির দশকের শ্রমনিষ্ঠ এ কবি ইতিমধ্যে কবিতায় নির্মাণ করেছেন নিজস্ব কাব্যভাষা।
কবি তমিজ উদ্ দীন লোদী যেন কবিতায় বিশ্বায়নের মহাসড়কে পদচিহ্ন আঁকেন। বিশ্বময় মানবিক মূল্যবোধের জরাজীর্ণ চেহারা কবিকে উদ্বেগাকুল করে। অনবদ্য পঙ্ক্তিমালায় তুলে আনেন মানবতার প্রতি ভণিতাপ্রণয়-আত্ম-উন্মোচিত হয় ‘রেসিজম’ : ‘ধারণ করবার আগেই ভাঙলো প্রণোদনা/ ক্ল্যারিওনেট বাজিয়ে যারা গাইলো মানবতার গান/ তারাও সাদা মানুষ ও কালো মানুষে ভাগে হয়ে গেলো/ সুপ্রিমেসির বীভৎসতা উড়ে আসলো বাদুড়ের মতো।/ যেসব সহজ প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছিল/ সেসবও জটিল হতে থাকল ক্রমাগত/ যেন কুন্তার কান্তে উঠে আসলো আবারো ক্রীতদাসের শেকল পরে।/ এখন কি শোনা যাবে মার্টিনের আত্মার ক্রন্দন!’ (ভাঙলো প্রণোদনা)
‘স্খলিত বসনের মতো’ কবির কবিতায় শিল্পনিপুণতায় উন্মোচিত হয় স্বার্থপর চরিত্রের মুখোশ, বর্ণহীন জলের দেহজাল। অথচ নেশার্দ্র নির্লিপ্ততায় জানে না, নাচের মুদ্রায় সে কতটা বেমানান, কতটা জলগহিনে লুকিয়ে আছে তার দ্বন্দ্বকুটিল রহস্যরূপ। ‘উত্তলে অবতলে’ কবিতায় : ‘তোমার প্রতিবিম্ব নেচে ওঠে উত্তলে অবতলে/ অথচ তুমি কোনো নাচের মুদ্রাতেই অভ্যস্ত নও/ প্রতিফলনের বিভায় ভেসে যায় তোমার দেহাভাস/ মুখ স্থির হয়ে থাকে শুধু দর্পণে।/ মুখোশআঁটা মুখগুলো তরঙ্গের মতো ওঠে নামে/ যেন আউটসাইডার দাঁড়িয়ে আছে তফাতে/ যার কোনো ছায়াই প্রতিফলিত নয়/ অথচ সে গুনছে মুদ্রার ভবিতব্য, মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।/ উত্তলে ভাসে মুখ জলভাঙ্গা ঢেউয়ের মতন/ অবতলে ভাসে মুখ রহস্যে, কুহক জড়ানো।’
যুদ্ধভয়ার্ততা, আশা-নৈরাশ্য, শোষণমুক্তির ক্ষিপ্র প্রভা, প্রেম-বিরহের সমতলসংকট কিংবা রিয়েলিজমের খড়্্গরৌদ্রে কমপ্লেক্স-অনুভূতিতে ভর দিয়ে আসে সত্তর ও আশির দশক। কবিতায় উচ্চকিত হয় জীবন-মৃত্যু-সম্ভ্রমের দীপ্ত অঙ্গীকার। কবি তমিজ উদ্ দীন লোদী এই দ্বন্দ্বসংক্ষুব্ধ সময়সন্তাপ কিংবা ‘আনন্দময় নৈরাশ্য’কে নির্মাণ করেন ভিন্ন আঙ্গিকে, যেখানে জীবনের জন্যে শিল্পর সমান্তরালে অন্তরালবর্তী অতীন্দ্রিয়বোধের ব্যাপ্তি পাঠককে চমকিত করে : ‘পার্শ্বগামী চরিত্রের মতো খাটো, শ্লথ, কিছু/ কম স্পর্শাতীত, অতীন্দ্রিয়, কিছুটা বিভ্রম/ গাঢ় শাদা মেঘ হয়ে আসে হাওয়ায় হাওয়ায় আঙিনায়।/ পৃথিবীর মাটি- টেরাকোটা, পটে আঁকা ছবি/বর্ণমালা, অক্ষরবৃত্তের ছন্দ, ভেসে আসা সুদূর প্রাচীন শব্দ/ স্পর্ধাদৃঢ় প্রতিজ্ঞার মতো জ্বলে ওঠে;/ জ্বলে ওঠে মৃত্যুর প্রতিভা, দীপ্র ইতিহাস।’ (চলো যাই অভিকর্ষ-ব্রতে)
তমিজ উদ্ দীন লোদীর কবিতা দেশজতা, সর্ববিস্তারি মূল্যবোধের আর্তি, মানবিক মুক্তি-আকুলতা, মানুষের প্রতিবিম্বন-মাটির আঘ্রাণ ও স্বাতন্ত্র্যকে অক্ষুণ্ন রেখেই অভাবনীয় মিশেলে গ্লোবাল-ইমেজে পরিব্যাপ্তি লাভ করে। প্রবাসযাপিত জীবনে একজন কবি ও শিল্পীর আত্মোপলব্ধ সত্তার এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণ। এখানে কবির সফল কাব্যযাত্রা সন্দেহাতীত এবং আমাদের উদ্দীপ্ত করে বিপুলভাবে। কবি যখন উচ্চারণ করেন, ‘ডুমুরের পাতার মতো পাপ ওড়ে বাতাসে/ স্খলিত বসনের মতো ঝরে সম্ভম’; অথবা ‘তোমার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছে রোদ বিড়ালের থাবার মতন’-তখন চেনা মাটির ঘ্রাণ যেমন উড়ে আসে তেমনি আধুনিক চিত্রকল্পের চমৎকারিত্ব পাঠককে বিমোহিত করে : ‘তোমাকে সেলিব্রেট করতে করতে/ ভেজা ঘাসের উপর নেমে এলো আধখানা চাঁদ/’
কবি তমিজ উদ্ দীন লোদী অভিন্ন আত্মীয়তাবন্ধনে আবদ্ধ থেকেও নিজস্ব নির্মাণভূমিতে পদচ্ছাপ আঁকেন : ‘মনে হয় শৈশব দৌড়াচ্ছে/ বালিকারা কলরব করতে করতে নেমে যাচ্ছে টিলা বেয়ে/ হ্লস শব্দে উড়ে যাচ্ছে পাখি/ শেষ বিকেলের লালচে রোদের মতো কপোল’ (ঝরাপাতা ও সরোবরে অশান্ত মীন)। কবির প্রেমানুভূতি এক অনুচ্চ স্বরে অথচ অন্তর্গত নিবিড়তায় কেলাসিত হয়ে ওঠে-নাগরিক বেদনাবাহিত চিত্রকল্পে, উপমায় উর্ত্তীর্ণ হয়ে ওঠে কবিতা : ‘টেবিলে ভালোবাসা নিয়ে বসে আছি/ অথচ ঠান্ডা হয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছে হট চিকেন স্যুপ/ চুলের ঘ্রাণ আর অবয়ব/ একটি আয়নার মতো লাফাচ্ছে অবিরাম।/ হাসি উড়ছে হাওয়ায়/ হাসির আড়ালের অশ্রুগুলো ঝরে পড়ছে টুপটাপ/ আগুন উসকে উঠছে চুলোয়/ প্রতীক্ষা পুড়ছে মাংস পোড়ার গন্ধের মতো।’ (টেবিলে ভালোবাসা নিয়ে বসে আছি)
প্রবাসের সাথে জন্মভূমির অপূর্ব মেলবন্ধনের চিত্রকল্প পাঠকমনকে পুলকিত করে। ‘জ্যাকসনহাইটস’ কবিতায় : ‘ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে এসেছে যেন লবণাক্ত হাওয়া/ চারপাশে আয়না হয়ে ঝুলে আছে সাইনবোর্ডগুলো/ জ্যাকসনহাইটসের দৃশ্য যেন অকস্মাৎ ছুঁলো/ বাংলা অক্ষয়ের খেলা। দৃশ্যমান জিলিপির তাওয়া।/ চা আর কফির গন্ধে মেতে ওঠে আড্ডার মচ্ছব।/ শাহজালাল শাহপরাণ, চারদিকে সুফিদের নাম।/ চারপাশে অভিবাসী শ্রমজীবী মানুষের/ কোলাহল প্রীতি আর অস্তিত্বের অনন্ত আহব।/ যেন মিনি বাংলাদেশ উঠে আসে শোক ও বিলাসে/… বারবার ভেসে ওঠে রক্তমাখা গর্বিত স্বদেশ/ এই নিরাত্মীয় দেশে স্বপ্নে থাকে চুম্বনের রেশ।’
আমেরিকার নিউইয়র্কে বসবাসরত এই কবি দেশ-প্রবাসের বিভিন্ন পত্রিকা, লিটল ম্যাগ, ওয়েব ম্যাগ-এ অক্লান্ত লিখে চলেছেন। কবিতার পাশাপাশি গল্প ও কথাসাহিত্যে এবং অনুবাদকর্মে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন, পেয়েছেন বোদ্ধামহলের সপ্রশংস হৃদ্যতা। প্রবাসজীবনের শত ব্যস্ততার ফাঁকে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন। তিনি দর্শকপ্রিয় টাইম টিভি থেকে প্রচারিত ‘শিল্প ও সাহিত্য’ অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তমিজ উদ্ দীন লোদীর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : কখনো নিঃসঙ্গ নই (১৯৮৫); এক কণা সাহসী আগুন (১৯৯২); নানা রঙের প্যারাশুট (১৯৯৭); চাঁদভস্ম (২০০৪); আমাদের কোনো প্লাতেরো ছিল না (২০১২); অনিবার্য পিপাসার কাছে (২০১৬); নির্বাচিত কবিতা (২০১৭); আনন্দময় নৈরাশ্য ও ইস্পাত মানুষেরা (২০১৭); দৃশ্যকল্প ও কতিপয় রাতের রমণী (২০১৮)। গল্পগ্রন্থ : হ্রেষাধ্বনির বাঁকদল (২০০৩); নিরুদ্দিষ্টের জলাবর্ত (২০০৫); হাডসন স্ট্রিটের সুন্দরী এবং (২০১১); নির্বাচিত গল্প (২০২০) অনুবাদ : শতাব্দীর সেরা আমেরিকার নির্বাচিত গল্প (২০১৮)।
কবি তমিজ উদ্ দীন লোদী এগিয়ে যাবেন যতিহীন সাহিত্যযাত্রায়, অনাগত দিনগুলোতে আরো উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবেন-শোভিত হবে তার পথঘাট শিল্পসুষমায়, উচ্চকিত হবে জীবনের গান, মানবতার গান-সপ্রতিভ হয়ে উঠবে সাহিত্যের নানা রং-এ প্রত্যাশা।