স্পোর্টস রিপোর্ট : মারিয়া মান্ডা। অনেকটা অবহেলিত সমাজ থেকে উঠে আসা একটা গর্বিত নাম। বয়স ১৬ ছুঁই ছুঁই। সমাজ, পরিবার, পারিপার্শ্বিকতার নানা কঠোর-কঠিন বাধা পেরিয়ে মারিয়া প্রস্ফূটিত-আলোকিত স্বমহিমায়। ফুটবল পায়ে ভেঙে চলেছেন অনেক বাধার পাহাড়। মারিয়া প্রতিষ্ঠিত এক লড়াকু যোদ্ধা। আন্তর্জাতিক পরিমÐলে লাল-সবুজ পতাকাকে তিনি চিনিয়েছেন অন্যরূপে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক নিজের এগিয়ে চলার গল্প বলেছেন সুদীপ্ত আহমদ আনন্দকে। তার অংশবিশেষ এবারের সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকারে।
২০১২ সালে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ দিয়ে শুরু আপনার ফুটবল। খেলাটা আপনার জীবনে এনেছে আমূল পরিবর্তন। এই বদলে যাওয়া জীবনের গল্পটা শুনতে চাই। ফুটবলার হওয়ার আগে জীবনটা অন্য রকম ছিল। কারণ আমার পরিবারের অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। কিন্তু ফুটবল খেলার কারণে আমার জীবনে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। প্রথমে যখন খেলা শুরু করেছিলাম তখন অনেক রকম সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে। এখন তেমন কোনো সমস্যা নেই। বেশ ভালো আছি। গ্রামের সবাই এখন আমাকে চেনে, সবাই সমর্থন করে।
শুরুতে যখন খেলা শুরু করলেন তখন তো সেভাবে আলোচনায় ছিলেন না। গ্রামের মানুষও হয়তো মেয়েদের মাঠে খেলাটাকে ভালো চোখে দেখত না। এখন তারা কী বলেন?
আমার পরিবারের অবস্থায়ও পরিবর্তন এসেছে। তা ছাড়া আমাদের গ্রামে আগে বিদ্যুৎ ছিল না। আমরা ফুটবল খেলে আমাদের গ্রামকে পরিচিত করেছি সারা দেশের কাছে। দেশের গÐি ছাড়িয়ে আমাদের উঠে আসার গল্প আন্তর্জাতিক পরিমÐলে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের ঘরে ঘরে এখন বিদ্যুৎ আছে। গ্রামের মানুষ তাই আমাদের অনেক স্নেহ করেন। গ্রামে গেলে পথেঘাটে দেখা হলে এসে কথা বলেন, জানতে চান কেমন আছি। একটা সময় তারাই আমাদের খেলাকে বাঁকা চোখে দেখতেন। এখন তারাই আমাদের অনেক সমর্থন দেন।
আপনাদের বড় করতে আপনার মায়ের অনেক অবদান। মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। ফুটবলার হওয়ার আগে আপনিও মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। এখন তো সেই দিনগুলো অতীত?
মাকে অনেকবার বলেছি আর তোমার কাজ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মা বাসায় বসে থাকতে চান না। বলে, সারাজীবন কাজ করে অভ্যস্ত। এখন ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে না। তাই এখনো কাজ করতে যান আমাদের নিষেধ সত্তে¡ও। আমি যা আয় করি তা মায়ের হাতে তুলে দিই। এখন আর তার কাজ করার প্রয়োজন নেই। বাফুফে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন দেয়। এ ছাড়া আমি তো বাংলাদেশ আনসারে যোগ দিয়েছি। ওখান থেকেও মাসিক ৫ হাজার টাকা ভাতা পাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে অর্থ পুরস্কার দিয়েছেন সেটা জমি রাখার জন্য মায়ের কাছে দিয়েছি। আর আগেই বাড়িঘর কিছু মেরামত করেছি।
দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনাদের প্রায়ই ডেকে নেন। উৎসাহ দেন। অর্থ পুরস্কার দেন, সময় কাটান। ফুটবলার না হলে তো কখনো এ রকমটা হতো না।
অনেকে কত চেষ্টা করেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। কিন্তু তিনি এত ভালো মানুষ যে, আমাদের ছোট ছোট সাফল্যেই অনেক খুশি হন। আমাদের ডেকে নিয়ে অনেক আদর করেন। হাত ধরে কথা বলেন। এ রকমটা তিন থেকে চারবার হয়েছে। আগে ওনাকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করতাম। কিন্তু একবার তিনি আমাদের ডেকে বলেন, তোমরা সবাই আমার নাতি-নাতনির বয়সী। এখন থেকে তোমরা আমাকে দাদি অথবা নানুভাই ডাকবা। আমি খুব খুশি হব। সেই থেকে তাকে আমরা নানু বলে সম্বোধন করি। উনি বলেন তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা পাশে আছি। দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এত স্নেহ করেন, উৎসাহ দেন, তখন শুধু দেশের কথা মাথায় নিয়ে মাঠে নামি। সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করি দেশকে ভালো কিছু এনে দিতে। তিনি আমাদের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
সিনিয়র লেভেলে খুব বেশি খেলার সুযোগ নেই। ঘরোয়া অবকাঠামোও এখনো গড়ে ওঠেনি। ছেলেরা ঘরোয়া ফুটবল খেলে অনেক টাকা আয় করেন। মেয়েদের তো সেই সুযোগ নেই।
আমাদের লিগের ব্যবস্থা করা হলে অনেক ভালো হতো। ক্লাবভিত্তিক খেলা হলে সেখানে খেললে আমাদের খেলারও যেমন উন্নতি হতো তেমনি আমরা স্থায়ী
একটা উপার্জনের সুযোগ পেতাম। আমার বিশাস বাফুফে আমাদের সেই সুযোগ করে দেবে।
ফুটবল মারিয়াকে পরিচিত করেছে গোটা দেশে। সেই মারিয়া বড় হচ্ছে। নিজেকে সামনে কোথায় দেখতে চান?
আমি আসলে এখন শুধু আমার বর্তমানটা নিয়েই ভাবছি। বর্তমানে ভালো খেলছি। নিজেকে আরও শানিয়ে নিতে চাই। বর্তমানে যেভাবে খেলছি সেভাবে খেলতে থাকলে ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি ভাবতে হবে না। আর ভবিষ্যতের ভাবনা মাথায় নিয়ে বর্তমানের পারফরম্যান্সকে খারাপ করতে চাই না।