প্রধানমন্ত্রীর ত্রিদেশীয় সফরে কী পেল বাংলাদেশ?

নূরুল ইসলাম : জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে ১৫ দিনের সফর শেষে লন্ডন থেকে গত ৯ মে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ মহাদেশের তিনটি প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকে অত্যন্ত ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ হিসেবে দেখছেন আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতি বিশ্লেষকেরা। তারা বলছেন, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর এ সফর বাংলাদেশের জন্য অনন্য কূটনৈতিক অর্জন। বিশেষ করে, প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের আগে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা’ ঘোষণা এবং টোকিওতে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে এই রূপরেখা ইতিবাচকভাবে উঠে আসার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বড় কূটনৈতিক সাফল্য। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-জাপান ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক ‘কৌশলগত অংশীদারত্বে’ উন্নীত হয়েছে। ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক অংশীদারত্বের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ এবং বিশ্বব্যাংক-প্রধানের কণ্ঠে ‘গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভূয়সী প্রশংসা’র বিষয়টি এ সফরকে আরও বেশি সাফল্যমণ্ডিত করেছে। কারণ, এর মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে গত প্রায় এক দশকের দৃশ্যত শীতল সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় ও উষ্ণতায় উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাজ্য সফরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের যে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা-ও মাইলফলক হয়ে থাকবে।
অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিকেরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ২০৩০-৩১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হওয়ার ও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার যে রূপকল্প বাস্তবায়ন করছে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রিদেশীয় সফর তাতে ব্যাপক ও ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে। এই সফরের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্কটা আবার চাঙা করে নিলেন।
শেখ হাসিনার সফরে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক এবং একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাপান তার সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে জাপানের চেয়ে বেশি সহায়তা পেয়েছে। শেখ হাসিনার জাপানে সরকারি সফর বাংলাদেশ ও জাপানের একটি যৌথ বিবৃতিতে সমাপ্ত হয়েছে, যেখানে দুই দেশ তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে।
বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যান। বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাংকের মধ্যে অংশীদারত্বের ৫০ বছর উদযাপন করা হয়েছিল, যখন বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের সদস্য হয়েছিল। শেখ হাসিনা এমনকি বিশ্বব্যাংকের প্রধানের সঙ্গে দেখা করার আগে, ব্যাংকটি বাংলাদেশে পাঁচটি প্রকল্পে তহবিলের জন্য ২.২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করার সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ অবশেষে তার উন্নয়ন বাজেট তহবিলের জন্য ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পাবে। শেখ হাসিনা এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস যৌথভাবে অংশীদারত্বের ৫০ বছর উদযাপনের জন্য একটি ফটো প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে, যখন শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর একটি বড় ফ্রেমযুক্ত ছবি দেন, যেখান থেকে ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক প্রত্যাহার করে নেয় এই অজুহাতে যে তারা প্রকল্পে দুর্নীতির সন্দেহ করেছিল, যা পরে প্রকাশ পায় রয়্যাল কানাডিয়ান ফেডারেল কোর্ট দ্বারা একটি প্রতারণার মিথ্যা মামলা হিসেবে। শেখ হাসিনা বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়াই পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তা এখন বাস্তবে। ছবির উপস্থাপনা বাংলাদেশের সংকল্প, আত্মনির্ভরশীলতা এবং প্রবৃদ্ধির প্রতি নিবেদনের পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাহসী নেতৃত্বের প্রতিনিধিত্ব করে।
এবারের সফরের শেষ পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যান যুক্তরাজ্যে। সেখানে যুক্তরাজ্যের রাজা চার্লসের আড়ম্বরপূর্ণ অভিষেক অনুষ্ঠানে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশ নেন। এ সফরের সময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন ঋষি সুনাক। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একজন সফল অর্থনৈতিক নেতা হিসেবে অভিহিত করেন এবং যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বের জন্যও অনুপ্রেরণা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এ অঞ্চলের উন্নয়নের রোল মডেল আখ্যায়িত করেন এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, ভূমিহীন ও গৃহহীন বাংলাদেশের জনগণকে সরকারি খরচে বাড়ি দেওয়া, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তার গৌরবময় ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। সুনাক বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। ঋষি সুনাকের এই বক্তব্যও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের স্বীকৃতি হিসেবেই বিবেচনা করা যায়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফর আগের অন্যান্য সফরের তুলনায় আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কারণ এ সফরটিতে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি রাষ্ট্র সফর করেছেন। জাপান এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষ দেশ এবং যুক্তরাজ্য ইউরোপের অন্যতম বড় অর্থনীতির দেশ। একটি সফরে এশিয়া, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের তিনটি শীর্ষ অর্থনীতির দেশে যাওয়া এবং প্রতিটি দেশেই প্রধানমন্ত্রীর সফল বৈঠক বর্তমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক বড় কূটনৈতিক অর্জন। ইউক্রেন পরিস্থিতিতে বিশ্ব রাজনীতিতে যখন একধরনের অস্থিরতা চলছে, সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে সফর করেছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশে আর কয়েক মাস পরেই জাতীয় নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফর তাই জাতীয় রাজনীতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।