
বাঙালিদের প্রবাসজীবন উৎসবে উৎসবে মুখরিত। চারদিকে উৎসবের আমেজ। প্রবাসজীবন কোনোভাবেই আর শুষ্ক-আনন্দহীন নয়। স্বজন-পরিজন ছেড়ে প্রবাসে থাকার হতাশায় আক্রান্ত নয়। তুলনা করে দেখলে হয়তো দেখা যাবে স্বদেশের চেয়েও প্রবাসে আনন্দ-আয়োজন অনেক বেশি। ছুটির দিন, স্কুল খোলার অজুহাতে শুধু শনি-রবিবার নয়, সপ্তাহের যেকোনো দিন, যেকোনো আয়োজন জমে ওঠে। দর্শক-খরাও খুব কমই দেখা যায়। ফেব্রুয়ারিতে ভাষা দিবস, এপ্রিলে বৈশাখী আয়োজন, রমজানে ইফতার পার্টির ধুম, মার্চ-ডিসেম্বরে স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবস উদ্্যাপন আর আছে পিকনিক।
এ ছাড়া সারা বছরই আছে নানা আয়োজন। লালন উৎসব, রবীন্দ্র উৎসব। নতুন আয়োজন। নতুন অনুভব। আনন্দের রং মনে মনে, পোশাকে-পরিচ্ছদে, হাসিতে, অভিব্যক্তিতে। চলনে-বলনে কেবলই খুশির বহিঃপ্রকাশ। লালনে-রবীন্দ্রনাথে যে প্রবাসজীবনেও এত অনুরাগ-ভালোবাসা, কখনো ভাবাই যায়নি। প্রতিটি বিষয়েÑসে গানে হোক আর সেমিনারে আলোচনায়-হলভর্তি দর্শক-শ্রোতা। মেলা নয়, তবু যেন সবারই ‘মেলায় যাইরে’ অবস্থা। শীতেÑহলে, অডিটোরিয়ামে; গরমে-বাইরে রাস্তায়, পার্কে।
গরম আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেছে পথমেলা। বরোতে বরোতে মেলা। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানা রঙের, নানা ধরনের পসরা সাজিয়ে পসারীরা বসবে। মঞ্চে শিল্পীদের গান হবে। সব নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধের ছোটাছুটি, হই-হুল্লোড়। শিশুদের বায়না। একটা হুলুস্থুল কারবার। চলবে শীত আসার আগ পর্যন্ত। পাশাপাশি চলবে বনভোজন। এক বছর আগে থেকেই পার্ক সব বুক করা থাকে। আগামী বছরের জন্য এ বছরই বুক করে রাখতে হবে। বিলম্ব হলে আর পার্ক পাওয়া যাবে না। প্রতি শনি-রবিবারে বিভিন্ন অঞ্চলের সংগঠনের একাধিক পিকনিক হবে। রোজার সময় ইফতার পার্টির ধুম পড়বে এতটাই যে ৩০ বা ২৯ রোজায় কুলাবে না! সে কারণে এখন সাহ্রির রেওয়াজও শুরু হয়েছে প্রবাসে।
এ রকম সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, আনন্দ-উৎসবের পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক উত্তেজনাও দেখা যায়, যা আমাদের সম্প্রীতি নষ্টের আশঙ্কা তৈরি করে। উত্তেজনা কখনো কখনো সংঘর্ষ, মারামারিতে রূপ নেয়। এ দেশে যা একান্তই অনাকাক্সিক্ষত। এতে এ দেশের মূল স্রোতোধারায় বাঙালি কমিউনিটির যে সুনাম গড়ে উঠেছে, সেই সুনামে কালিমা লাগে। একটা কথা তো আমরা সবাই জানি-একটা কমিউনিটির জন্য সুনাম অর্জন করা যত কঠিন, তা নষ্ট করতে মোটেও কোনো কষ্ট করতে হয় না। সবাই মিলে দীর্ঘদিন ভালো কাজ করে যে সুনাম গড়ে তুলতে হয়, তা দু-একটি খারাপ কাজের জন্যই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
এ রকমই বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এবং মর্যাদা বিনষ্ট হয়, এমন একটি ঘটনা ঘটে গেছে। রাজনীতির শক্তিতে একটি রাষ্ট্র এগিয়ে যায়, সে রাজনীতি যদি দেশ ও জনগণের কল্যাণে হয়। আর যদি না হয়, তাহলে দেশ যেমন পিছিয়ে যায়, জনগণের দুর্ভোগও বৃদ্ধি পায়, মর্যাদা ও ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়। গত ১ মে বিশ্বব্যাংকের সামনে আওয়ামী লীগ ‘জয় বাংলা’ সমাবেশ ডেকেছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের দাওয়াতে ওয়াশিংটন সফরে এসেছিলেন। উপলক্ষ বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে সম্পর্কের ৫০ বছর উদ্্যাপন। বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্ভাগ্য। গণতান্ত্রিক সহনশীলতা আমরা কোনো পরিস্থিতিতেই দেখাতে পারি না। আমরা কিছুই বুঝতে চাই না। সবকিছুতে প্রতিবাদ। সংঘর্ষ, ভাঙচুর।
আওয়ামী লীগের ‘জয় বাংলা’ সমাবেশের বিপরীতে বিএনপি ডাকল ‘বিক্ষোভ সমাবেশ’। যথারীতি ধাক্কাধাক্কি, তা থেকে হাতাহাতি। আহত হলেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান। পুলিশ ডাকাডাকি। গ্রেফতার। দুই দলের সংঘর্ষের সময় কারোরই মনে থাকে না দেশের মান-মর্যাদার কথা। তবে ওই যে কথায় বলে, ‘কারো সর্বনাশ, আর কারো পৌষ মাস।’ ড. সিদ্দিক আহত হয়েছেন, পুরস্কারও পেয়েছেন। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, নেত্রী শেখ হাসিনার ‘গুডবুকে’ তিনি ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছেন। তার ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামনে নির্বাচন রেখে তাকে অনেক দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। প্রবাস থেকে এই দায়িত্ব তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবেন অতীতের মতোই। তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু-কন্যা আমার ওপর আস্থা রেখে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা যথাযথভাবে পালন করব। একটু সুস্থ হলেই নেত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাব।’
যা হোক, উপসংহারে এ কথাটাই বলার আছে, আমরা প্রবাসে আনন্দ-উৎসবে, মিলেমিশে থাকতে চাই। রাজনীতি যার যার থাকবে, তাই বলে সম্প্রীতি নষ্ট করে অবশ্যই নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল কথাই সহনশীলতা। সে কথাটা যেন আমরা সব সময় মনে রেখে চলতে পারি।