প্রবাসীদের অবদানে ত্বরান্বিত হোক উন্নয়ন

ড. এ কে আবদুল মোমেন

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। দেশে পেট (পিইটি) বা পলিথিলিন জাতীয় দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। পেট রেজিন থেকে তৈরি হচ্ছে পলিয়েস্টার কাপড়ও। তবে এত দিন ‘পেট’ বোতল ও দ্রব্যসামগ্রীর কাঁচামাল পেট রেজিন আমদানিনির্ভর ছিল। আমদানিনির্ভরতা কমাতে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ সঞ্চয়ের লক্ষ্যে এবার দেশেই শুরু হয়েছে পেট রেজিন উৎপাদন প্রক্রিয়া। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ পেট রেজিনভিত্তিক কারখানা করেছে বাংলাদেশ পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (বিপিসিএল)।
পেট রেজিন দিয়ে খাবার পানি ও কোমল পানীয়ের বোতল তৈরি করা হয়। এ ছাড়া অন্য দ্রব্যসামগ্রীও এ পেট রেজিন থেকে তৈরি করা হয়। বাংলাদেশ প্রতি বছর ১ লাখ ৪২ হাজার টন রেজিন আমদানি করে, যা চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা হয়। এ কারখানা নিয়ে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাদেম মাহমুদ ইউসুফের বক্তব্য হলো, বিপিসিএল বাংলাদেশের বর্জ্য থেকে পণ্যের নতুন কাঁচামাল বের করার ধারণাকে কাজে লাগাতে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করছে। এ কারখানায় প্লাস্টিকের ব্যবহৃত বোতলসহ বিভিন্ন সামগ্রী পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা হবে। বর্তমানে কারখানাটির উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক ৫০০ টন। কয়েক বছরের মধ্যেই তা ২৫ হাজার টনে উন্নীত হবে। কারখানায় বর্তমানে দেড়শ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। দেশে বর্তমানে তিন লাখ বর্জ্য সংগ্রাহক রয়েছে। খাদেমের লক্ষ্য এ সংগ্রাহকদের জীবনযাত্রা উন্নত করা, যার মাধ্যমে শিশুশ্রমও হয়তোবা নির্মূল করা সম্ভব হবে।
যতদূর জানি, ভদ্রলোকের ব্যাকগ্রাউন্ড মূলত ইলেকিট্রক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। চাকরির শুরুতে তিনি ছিলেন চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এএমডিতে। পরে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান তিনি। সেখানে ন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টরে কাজ শুরু করেন। এরপর বেশ কয়েকটি স্টার্টআপেও কাজের অভিজ্ঞতা হয় তার। এর কিছুদিন পর দেশে ফিরে আসেন তিনি। এখানে নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ শুরু করেন। এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন আলাপ-কমিউনিকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। শুরুতে তাদের লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ব্যাংককে একটি নেটওয়ার্কে যুক্ত করা। একে একে বিভিন্ন ব্যাংক সেবাটি গ্রহণও শুরু করল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসেন খাদেম মাহমুদ ইউসুফ। তার মতো অবশ্য অনেকেই দেশে ফিরে আসেন। বিদেশের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, উচ্চশিক্ষা, পেশাগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে দেশেই ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছেন। আমার পরিচিত, চেনাজানা আরো অনেক উদ্যোক্তা, পেশাজীবী বা ব্যবসায়ী রয়েছেন; যারা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। কিন্তু দেশে ফিরে দেশের টানে তাদের শিক্ষা বা দক্ষতা কাজে লাগিয়ে এখানেও বাণিজ্যিক বা সেবা কার্যক্রম শুরু করেছেন। এর মাধ্যমে দেশে সৃষ্টি হচ্ছে নিত্যনতুন কর্মসংস্থান, প্রসারিত হচ্ছে পর্যটন শিল্পও। অনেকেই এখানে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল নির্মাণ করছেন। বিদেশের বাজারে আমাদের পণ্যের নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। রফতানি আয় বাড়ছে দ্রুতগতিতে। এটি আমাদের অর্থনীতিকে যেমন সমৃদ্ধ করছে, তেমনি এটি অবশ্যম্ভাবীভাবে দরকারিও।
কেননা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মতে, আমাদের দরকার হবে ৪ কোটি ৯৮ হাজার ৫০ লাখ কোটি টাকা। এত অর্থ কোথা থেকে আসবে? এ জন্য উদ্ভাবনী পথ খুঁজতে হবে। চীন, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আমরা দেখেছি, সেসব দেশের মানুষ, যারা বিভিন্ন দেশে প্রবাসী হয়েছে, তারাই কিন্তু দেশের উন্নয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে। তাদের মাধ্যমেই সেসব দেশের বড় বিনিয়োগ এসেছে। গণচীনে ৬৬ শতাংশ বিনিয়োগ এসেছে তাদের দেশের প্রবাসীদের মাধ্যমে। সাম্প্রতিককালে ভারতেও এটি হচ্ছে। ভারত পরিকল্পিতভাবেই এটি শুরু করেছে। বিদেশে অবস্থানরত নন-রেসিডেন্সিয়াল ভারতীয়দের জন্য সে দেশের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধার দ্বার খোলা। বিদেশে তাদের দূতাবাসগুলো নন-রেসিডেন্ট ভারতীয়দের সেবা প্রদানে খুবই আন্তরিক ও পারদর্শী। অর্থাৎ দেশের উন্নয়নেই সে দেশের প্রবাসীরা অবদান রাখছে। দেরিতে হলেও অবশ্য আমরাও তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করতে শুরু করেছি।
আমাদের জনসংখ্যার ১ কোটি ১৬ লাখেরও বেশি বিদেশে কাজ করছে। এদের মধ্যে এক ধরনের লোক আছে যারা দেশে ফিরে আসবে, অন্য আরেক ধরনের লোক আছে যারা সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়েছে। তবে তাদের বড় অংশই দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত হতে চায়, দেশের সাধারণ অসহায় মানুষের উপকারে আসতে চায়। এ বিরাটসংখ্যক প্রবাসীকে উন্নয়নের স্রোতধারায় নিয়ে আসতে প্রতি বছর ৩০ ডিসেম্বর ‘প্রবাসী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে প্রবাসীরা ঢাকাসহ তা বিভিন্ন দেশে পালন করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তাতে নীতিগত সম্মতি আছে। তবে সরকার এখনো প্রবাসী দিবস ঘোষণা করেনি। উল্লেখ্য, যদিও বাঙালিরা ’৫২ সাল থেকে শহীদ দিবস বা ১৯৭৫ সাল থেকে শোকদিবস পালন করে আসছে, তবে এ সম্পর্কে সরকারি ঘোষণা বহু বছর পরে এসেছে। তবে সুখের বিষয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এটির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের। টাস্কফোর্স কীভাবে প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে। কিভাবে প্রবাসীরা দেশ উন্নয়নে সম্পৃক্ত হতে পারে, তার দুটো প্রস্তাব এসেছে। একটি হচ্ছে ‘পাই’ এবং অন্যটা ‘রাইপেন’। পাইয়ের অর্থ হলো, ফিলানথ্রপি-ইনভেস্টমেন্ট-একচেঞ্জ। রাইপেন হলো, আর রেমিট্যান্স, আই ইনভেস্টমেন্ট, পি ফিলানথ্রপি, ই একচেঞ্জ এবং এন নেটওয়ার্কিং। বস্তুত রাইপেন বিশ্লেষণ করলে যেমনটি দাঁড়ায় তা হলো, ‘আর’-এ রেমিট্যান্স। প্রতি বছর ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে কিন্তু সেটি উপযুক্তভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না নানা কারণে। আমাদের প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ, এর একটি বড় অংশ বলতে গেলে অলস পড়ে থাকে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ও রিজার্ভের অর্থ কাজে লাগাতে একটি সেল করার কথা ভাবা হচ্ছে।
এসব অর্থ কাজে লাগিয়ে আমরা বড় বড় প্রজেক্ট করতে পারি, গভীর সমুদ্রবন্দরও হতে পারে। এতে কারো প্রতি মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না। এরপর ‘আই’ অর্থ ইনভেস্টমেন্ট। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অনেক ওকালতি করেছি, দেন-দরবার করতে হয়েছে অনেক। বিশেষত ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কেউ কেউ নির্বাচনের ব্যাপারে জানতে চাইলেন, তখন অনেক তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে হয়েছে। পরে তারা দেশের সামগ্রিক অবস্থা অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। আমাদের এখানে ইনভেস্টমেন্ট সেল করতে হবে, সবকিছু সহজ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এতে এক দিকে বিনিয়োগকারীরা লাভবান হবেন, দেশ লাভবান হবে এখানে এনার্জি কস্ট কম, লেবার কস্ট কম, মোটের ওপর লাভবান হবে দেশ। প্রবাসীদের সম্পৃক্ত করা হবে এখানে। দেশের বাইরে থাকাকালীন প্রবাসী অনেকের সঙ্গেই হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর অনেক অনেক প্রবাসী স্বদেশের উন্নয়নের জন্য বহুমুখী বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসে। তবে তার অধিকাংশই কার্যকর হয় না। সুতরাং তাদের প্রস্তাবগুলো ফ্যাসিলেট করার জন্য বিনিয়োগ সেল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এরপর পি-তে ফিলানথ্রপি। বিদেশিরা দাতব্যমূলক কাজে সহায়তা করে থাকেন। কিন্তু দেখা যায়, এখানেও অনেক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকে। সে জটিলতাগুলোও দূর করতে হবে আমাদের। সাহায্য আসার পদে পদে বাধা পড়ে, এগুলো দূরীকরণে উদ্যোগ নিতে হবে। ই-তে দাঁড়ায় একচেঞ্জ অব এক্সপেরিয়েন্স অ্যান্ড এক্সপার্টাইজ। অর্থাৎ অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞানবিনিময়। বিদেশে আমাদের বহু অভিজ্ঞ প্রবাসী আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন ধরা যাক, ডাক্তার বা শিক্ষক। একজন ডাক্তার বা শিক্ষক যখন দেশে আসেন, আমরা যদি তাকে অনুরোধ করি, আপনি এক সপ্তাহ বিনামূল্যে সেবা দিন। তিনি কিন্তু সেটি দেবেন। কিন্তু দেখা যায়, তিনি কখন আসেন, সে খবরই আমাদের হাতে নেই। বহু বড় বাঙালি আছেন, যারা সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন বিদেশে। তারা সেবা ও প্রশিক্ষণ দিতে পারেন আমাদের। তাদের জ্ঞান কাজে লাগানোর জন্য একটি সেল হতে পারে। এন-এর অর্থ হচ্ছে নেটওয়ার্কিং। এখন অনেক বাঙালি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বড় বড় রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত। এ দেশে বিভিন্ন ধরনের সংকট যখন দেখা দেয়, তা সমাধানেও তারা কাজ করতে পারেন; যা আমাদের জন্য বড় ধরনের সহায়ক হতে পারে। যেমন ধরা যাক রোহিঙ্গা ইস্যু। আমাদের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আমাদের দেশের হয়ে লবিং করতে পারেন রোহিঙ্গা সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাওয়ার জন্য। তারা সেখানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আস্থা অর্জন করেছেন, তারা একটি সুপারিশ করলে সেটি কাজে আসবে। তা ছাড়া অনেক বাঙালি এখন বহুজাতিক নানা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ বা দায়িত্বশীল পদে আসীন। তারা যদি দেশে বিনিয়োগ বা সেবামূলক কর্মসূচিতে বিনিয়োগের জন্য ওই প্রতিষ্ঠানে সুপারিশ করেন, তা খুব কাজে দেবে। যা দেবে না ১০টি বড় রোড শো করলে বা মন্ত্রী-এমপিদের ১০টি সফরেও। সুতরাং আমাদের এগুলো সংগঠিত রূপে করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া করছে, ভারত, হন্ডুরাসের মতো রাষ্ট্রও করছে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব?
আরেকটি উদাহরণ দিতে চাই। সিলেটের এক ভদ্রলোক জে-আইসি-সুইট-লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী ফকরুল ইসলাম চৌধুরী, সেই সেকেন্ডারি লেভেল শেষ করেই তিনি পাড়ি জমিয়েছেন লন্ডনে। এর পর থেকে সেখানেই বসবাস। ভদ্রলোকের পরিবারের সদস্যরাও যুক্তরাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি বড় ব্যবসায়ী। সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য, মরক্কো, ইউরোপসহ নানা দেশেই রয়েছে তার ব্যবসায়িক কার্যক্রম। বাংলাদেশেও তিনি ব্যবসা কার্যক্রম শুরু করেন কয়েক বছর হলো। প্রচলিত ধারণা থেকে বের হয়ে এসে এক্কেবারে গ্রামের মধ্যে গার্মেন্ট কারখানা স্থাপন করেছেন, যেখানে কাজ করছেন ১ হাজার ২০০-এরও বেশি শ্রমিক। বড় সুবিধা হলো, এসব শ্রমিকের জন্য আলাদা থাকার জায়গা দরকার হচ্ছে না। বাড়ি থেকে সকালে এসে কারখানায় কাজ করছেন। দিন শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। বাড়তি খরচ ছাড়াই থেকে যাচ্ছে আয়ের পুরোটাই। এতে ওই অঞ্চলের নারীদের আয় বাড়ছে, হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন।
এ ফকরুল সাহেবের ইচ্ছে তিনি সিলেটে ব্যক্তি উদ্যোগে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবেন। যে সময় তিনি উদ্যোগ নিলেন, সে সময় নিয়মানুযায়ী অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় ৫০ একর জমির দরকার হয়। সেখানে তার ছিল ৫৪ একর। কিন্তু এরপর শুরু হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা। ঠুকে দেয়া হয় তুচ্ছ কিছু অজুহাতে মামলাও। ভদ্রলোক থেমে যান না। পুরো উদ্যমী হয়ে কাজ করতে থাকেন। নিয়মিত হাজিরা দেন আদালতে, দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত থাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহে। সেই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি এখনো, তবে কাজ চলছে। এখন অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় জমির পরিমাণ বাড়িয়ে করা হয়েছে ন্যূনতম ১০০ একর। তবে তিনি বলেছেন, তাকে অনুমতি দেয়া হলে বাকি জমিও তিনি কিনে ফেলবেন। এ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে এখানে অন্তত আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। স্বদেশে ফেরার পর থেকে প্রতিদিন অনেকে চাকরির জন্য তদবির করতে বলেন। যারা এ ভদ্রলোককে বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করছেন, এদের কেউ কেউ তাদের আত্মীয়স্বজনদের জন্যও যোগাযোগ করেছেন। তবে তারা যদি এ ভদ্রলোককে হয়রানি না করে কাজটি করে দেন, তখন একটা-দুটো চাকরি নয়, বহু চাকরির ব্যবস্থা হবে এ সামান্য বিষয়টি অনেকেই বুঝে আনতে পারেন না। মূলত ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা অধিদপ্তরের অনুমতি, ট্রেড লাইসেন্স জোগাড়সহ এসব জটিলতা কমলে ফকরুল সাহেবদের মতো আরো প্রবাসী এ দেশে এসে বিনিয়োগ করতে পারতেন। তবে সুখের বিষয়, বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও অনেকে এরই মধ্যে হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট ও শিল্প-কারখানা তৈরি করেছেন।
বিদেশ থেকে এসে প্রবাসীদের জন্য বিনিয়োগ করার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রয়ে গেছে এখনো। উৎপাদক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে আমদানি-রফতানির অনুমোদন, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির অনুমতি, মূসক নিবন্ধন, বিদেশি বিনিয়োগের বিভিন্ন লাইসেন্স, শিল্প প্লট ও গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংযোগ নেয়ার প্রক্রিয়া, খাতওয়ারি বিভিন্ন পণ্যের লাইসেন্স, পরিবেশ বিভাগের ছাড়পত্র এসব কাগজপত্র করতে বহু ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। এ অফিস থেকে সে অফিসে দৌড়াদৌড়ি, লবিং, ক্ষমতাবানদের থেকে রেফারেন্স, আবার কোথাও বা বখশিশের নামে অযাচিত অর্থ ব্যয়ের মতো ঝামেলাও রয়ে গেছে। যদিও এসব ঝামেলা মোকাবেলায় সরকারি যথেষ্ট উদ্যোগ রয়েছে। তবে কিছু অসৎ কর্মকর্তার কারণে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। তবে ইদানীং দুটো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একটি হচ্ছে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ এবং অন্যটি ‘প্রবাসী টাস্কফোর্স’; যা নিয়ন্ত্রিত হবে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মাধ্যমে।
যে টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে, সেটি ফলপ্রসূ হবে বলে আমরা আশাবাদী। আমি নিজেও এ টাস্কফোর্সের সদস্য। আমি আশাবাদী শিগগিরই আরো ফলপ্রসূ কিছু হবে। আসলে আমাদের দুটি বড় সম্পদ রয়েছে, একটি হলো ‘পানি’, আর অন্যটি আমাদের ‘জনসম্পদ’। এ রাইপেন কর্মসূচি সফল হলে দেশের উন্নয়নকাজে বরাদ্দের জন্য বিদেশি দাতা দেশগুলোর মর্জির দিকে আর তাকিয়ে থাকতে হবে না। প্রবাসীরা দেশের উন্নয়নে সত্যিকার অর্থেই সহযোগিতা করতে পারেন। পৃথিবীর দেশে দেশে এটি হয়ে আসছে। যেহেতু বিদেশি সাহায্য দিন দিন কমে আসছে, সেজন্য নব নব উদ্যোগ বা সৃষ্টিশীল উৎস খুঁজতে হবে আমাদের। নিজেদের উন্নয়নে নিজেদের মানুষদের কাজে লাগাতে পারলে অল্প খরচেই আমরা আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল হতে পারি। এ ক্ষেত্রে সরকার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, আমাদের দায়িত্ব হবে সে উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশে-বিদেশে যারা যেখানেই আছি, দেশের সমৃদ্ধির জন্য নিজ থেকে দায়িত্ব পালন করা উচিত আমাদের। এটি করতে পারলে নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারব। এগিয়ে যাবে আমাদের অর্থনীতি, পূরণ হবে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা, যার মাধ্যমে পূর্ণ রূপ পাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।
লেখক : জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান