- * তদন্তের নামে ঝুলে থাকে দ্বৈত নাগরিকত্বের আবেদন
- * সহজে মেলে না জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মসনদ
- * স্বার্থরক্ষায় আইন নেই, আছে খড়গ ও হয়রানি
- * দেশে বিনিয়োগ করে ফেঁসে গেছেন বহু প্রবাসী
ঠিকানা রিপোর্ট : বাংলাদেশে প্রবাসীদের জন্য প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় আছে। সেই মন্ত্রণালয়ে একজন মন্ত্রী এবং একজন সচিব আছেন। ৬৪ জেলায় ওয়েজ আর্নার কল্যাণ বোর্ড আছে। দেশে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকও আছে। প্রবাসীদের জন্য কাগজে-কলমে এত কিছু থাকার পরও বাস্তবে কিছুই নেই। আছে শুধু প্রবাসীদের জন্য সব সরকারের মায়াকান্না। ৫১ বছর আগে দেশ স্বাধীন হয়েছে। দীর্ঘ এই সময়ে বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন প্রবাসী হয়ে। তারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সমৃদ্ধ করছেন। বিনিময়ে প্রবাসীরা সরকারের কাছ থেকে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’র স্বীকৃতি পাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে প্রবাসীরা রাষ্ট্রের কাছে অবহেলিতই থেকে যাচ্ছেন। ভাগ্যের অন্বেষণে বিদেশি নাগরিকত্ব নেওয়ায় হারাচ্ছেন মাতৃভূমির নাগরিকত্ব। এ নিয়ে তাদের বুকে রক্তক্ষরণ হয়। আবার দ্বৈত নাগরিকত্ব গ্রহণের সুযোগ থাকলেও তদন্তের নামে তা ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর। যারা অনেক আগে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, কিন্তু নাগরিকত্ব নেননি তারা পাচ্ছেন না জাতীয় পরিচয়পত্র, সহজে মিলছে না জন্মসনদ। বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কোনো কাজই হয় না। অথচ প্রবাসীরা দ্বারে দ্বারে ঘুরে হয়রানি হচ্ছেন এসব পেতে। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তারা নিজেদের প্রবাসীবান্ধব দাবি করলেও দেশে প্রবাসীদের স্বার্থবিরোধী যত আইন আছে, সেগুলোকে জিইয়ে রাখছেন। আর এসব আইনের খড়গে পদে পদে হয়রানি হচ্ছেন প্রবাসীরা। ন্যুনতম নাগরিক সুবিধা পাচ্ছেন না, বরং দেশে থাকা প্রবাসীদের সম্পত্তি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। প্রবাসীবান্ধব আইন না থাকায় আদালতে ঝুলে থাকছে সম্পত্তি দখলের মামলাগুলো।
নিউইয়র্ক প্রবাসী জাহিদুর রহমান ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়েছেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চলে যায়। তবে পুনরায় নাগরিকত্বের আবেদনের সুযোগ থাকলেও দীর্ঘ তদন্ত প্রক্রিয়ায় তা ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর। অথচ প্রবাসীদের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে দ্বৈত নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি সহজ করা যেত। কিন্তু তা না করে আইনটি কৌশলে জটিল করে রাখা হয়েছে। একজন প্রবাসী দ্বৈত নাগরিকত্বের আবেদন করলে সরকারের তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন লাগে। অথচ বৈধভাবে বিদেশে যাওয়া একজন বাংলাদেশি পরবর্তীতে আইনের মারপ্যাচে পড়ে নাগরিকত্ব ফিরে পাচ্ছেন না।
ভূক্তভোগীরা বলছেন, যিনি মাতৃভূমিতে জন্ম নিয়েছেন, তিনি কেন নাগরিকত্ব হারাবেন। অন্য দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলে মাতৃভূমির নাগরিকত্ব হারানোর আইনটি সংশোধন করলেই এই জটিলতা থাকার কথা নয়। কেউ দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকলে এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিলে সেক্ষেত্রে ভিন্ন আইন করা যেতে পারে।
তাদের মতে, বাংলাদেশিদের কেউ বিদেশি নাগরিকত্ব নিলেও তার পাসপোর্টে জন্মস্থান হিসাবে বাংলাদেশ লেখা থাকে। অথচ জন্মভূমির নাগরিকত্ব তিনি হারাচ্ছেন। ২০১৬ সালে মন্ত্রিসভা কমিটি নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করলেও সেখানে যে ২৮টি ধারা রয়েছে তা প্রবাসীবান্ধব নয়, বরং তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিশেষ করে দ্বৈত নাগরিকরা জাতীয় সংসদের সদস্য পদে নির্বাচন, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন, বিচারকসহ প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মে নিয়োগ লাভ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারবেন না। অর্থাৎ এই আইনে একজন প্রবাসীকে নানাভাবে আটকানো হয়েছে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব¡ পরিত্যাগকারীদের কেউ পুনরায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণের আবেদন করলে সরকার সে আবেদনের যৌক্তিকতা বিবেচনা করতে পারবে। এই বিবেচনা আর অপেক্ষা যেন শেষ হবার নয়।
নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের মাধ্যমে প্রবাসীরা দ্বৈত নাগরিকত্বের আবেদন করেছেন। ওপরমহলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে অনেকে খুব দ্রুত দ্বৈত নাগরিকত্বের সনদ পাচ্ছেন। কিন্তু অধিকাংশ প্রবাসী বছরের পর বছর তদন্তের নামে ঝুলে থাকছেন। এ ব্যাপারে নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনুস্যলেটের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। তারা কোনো আপডেট দিতে পারছে না।
এ ব্যাপারে নিউইয়র্ক কনুস্যলেটের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা ঠিকানাকে বলেন, দ্বৈত নাগরিকত্বের জন্য কনস্যুলেটের হাতে কোনো ক্ষমতা নেই। আমরা আবেদনটি গ্রহণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেই। সেখান থেকে সার্টিফিকেট পেলে আবেদনকারীকে দেই। এটি সম্পূর্ণভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। কনস্যুলেট শুধুই মাধ্যম মাত্র।
নাদিম আহমেদ নামে একজন ভূক্তভোগী জানান, প্রায় ২০ বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে। রাজধানী ঢাকায় তার পৈত্রিক ভিটা রয়েছে। পিতার মৃত্যুর পর ওয়ারিশদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় তিনি কিছুই করতে পারছেন না। বাড়ি করতে গিয়ে রাজউকের অনাপত্তিপত্র লাগে। বিদ্যুত, পানি ও গ্যস সংযোগের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক। আবার জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করতে দ্বৈত নাগরিকত্ব বাধ্যতামূলক। এটা দীর্ঘ এক প্রক্রিয়া।
প্রবাসীদের শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে বাংলাদেশ বছরে গড়ে দেড় হাজার কোটির বেশি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাচ্ছে। তাদের প্রত্যক্ষ অবদানেই দেশের অর্থনীতিতে আজকের এই অগ্রযাত্রা। তাদের কারণেই পরিবার এবং সমাজেও বিচ্ছুরিত হচ্ছে স্বচ্ছলতার আলোর ঝলক। কিন্তু স্বজন এবং দেশ তাদের কী দিচ্ছে? বরং এই ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই যখন দারুণ ব্যাকুলতায় দেশের মাটিতে পা রাখছেন, তখন শিকার হচ্ছেন বহুমাত্রিক নিগ্রহের। বিশেষত: তাদের সম্পত্তি স্বজন-প্রতিবেশীদের দ্বারা বেহাত হয়ে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হচ্ছে মিথ্যা মামলা। এছাড়া তারা দেশে অবস্থানকালে অন্তত ৭ ধরনের সাধারণ সঙ্কটে পড়ে বহুমাত্রিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে- পাসপোর্ট অফিসের দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি। মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ডেলিভারি পেতে ভোগান্তি। ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও বিমানযাত্রায় ভোগান্তি। ভূমি অফিসের দুর্নীতি ও হয়রানি। জরিপ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, হয়রানি। জায়গা-জমি, বাসাবাড়ি, স্থাবর সম্পত্তির নামজারি, ক্রয়-বিক্রয় ও হস্তান্তরে দালালদের দৌরাত্ম্য। পাওয়ার অব অ্যাটর্নির নামে ভুয়া রেকর্ডপত্র দ্বারা প্রতারিত হওয়া। সন্তানের বিয়ে-শাদীর প্রশ্নে স্বজনপাড়া-প্রতিবেশীদের চক্রান্ত, বাড়ির কেয়ারটেকার-ম্যানেজার দ্বারা নানামুখী প্রতারণা শিকার হওয়া এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসার ভূতুরে বিল প্রাপ্তি, সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি ও হয়রানি।
এসব কারণে স্বল্পদিনের জন্য দেশে অবস্থান করলেও তাদের জীবন হয়ে উঠছে অতিষ্ঠ। অরক্ষিত, অনিরাপদ, কখনও কখনও দারুণরকম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে নিজ দেশে অবস্থান। তাদের অধিকার ও স্বার্থরক্ষা এবং নিরাপত্তা বিধানে নেই, কার্যকর কোনো কর্তৃপক্ষ। দৃশ্যমান নয় বিশেষ কোনো উদ্যোগও। সরকারি যে উদ্যোগের কথা প্রচারিত হয়, তা শুধু কেতাবে আছে- কাজে নেই।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবাসীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার তথা রাষ্ট্রের। দেশে অবস্থানকালে প্রবাসীদের জীবন নির্বিঘ্ন, স্বস্তিদায়ক করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্ব কতটা প্রতিপালিত হচ্ছে? বরং প্রবাসীদের নানাভাবে দেশে হয়রানি করা হচ্ছে।
সম্প্রতি দেশে বিনিয়োগ করে বিপদে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক প্রবাসী বাংলাদেশি। মিথ্যা মামলায় তাকে জেল খাটতে হয়েছে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাতজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীকে একটি মামলায় গ্রেফতার করে আটদিন কারাগারে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে তাদের প্রতিষ্ঠিত একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বার্ষিক সাধারণ সভা বা এজিএম-এ যোগ দিতে ঢাকায় গেলে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে বীমার টাকা না পেয়ে চারজন গ্রাহক মামলা করলে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। কিন্তু বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই সাতজনকে হয়রানি করার জন্যই এ মামলা দায়ের করা হয়েছে। তারা মনে করছেন, এর ফলে ভবিষ্যতে ব্রিটেন প্রবাসীরা বাংলাদেশে এসে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত হতে পারে।
ভূক্তভোগী প্রবাসীদের অভিযোগ- দেশে প্রবাসীদের কোনো গুরুত্ব নেই, আছে অবহেলা। দেশের অনেকে বলে থাকেন যে প্রবাসীরা দেশ ছেড়েছে দেশের প্রতি তাদের মায়া, দেশের প্রতি তাদের টান নেই বলে। অথচ প্রবাসী হয়েছে ভাগ্য বদলাতে। এটা কেউ স্বীকার করে না দেশে কর্মসংস্থানের অভাবেই তারা দেশ ছেড়েছেন। দেশের মানুষজনদের ভালো রাখার জন্য তারা দেশ ছেড়েছেন। দেশ ছাড়ার সময় অনেকে প্রতারক ও দালালের মাধ্যমে সর্বস্বান্ত হন। দালালের মাধ্যমে বিদেশে পৌঁছে জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এ ব্যাপারে অভিযোগ করলে রিক্রুটিং এজেন্সি বা দালালরা বহাল তবিয়তেই থাকে। দুর্ভোগের শিকার হন কেবলই প্রবাসীরা। কেউ জানে না প্রবাসীরা এসব সঙ্কট থেকে কবে মুক্তি পাবেন।