আব্দুল মালেক
আশির দশকের মধ্যভাগে আমি যখন বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সে আমেরিকা ঘুরতে এসেছিলাম, তখনো নিউইয়র্ক নগরী থেকে একটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হওয়ার বিষয়টি ছিল অকল্পনীয়। প্রবাসী বাংলাদেশিরা সে সময় ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে কুইন্সের এস্টোরিয়া, ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড, ব্রঙ্কসের পার্ক চেস্টার প্রভৃতি এলাকায় খণ্ড খণ্ডভাবে বসবাস করতেন। যাদের বেশিরভাগই নন-ইমিগ্র্যান্ট মানুষ- যাদেও অনেকেই বসবাস করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর ধরে স্বজন-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে।
পরবর্তী সময়ে ভাগ্যের চাকায় বাঁধা পড়ে নব্বইয়ের প্রারম্ভে দেশ থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে হুট করে যখন চলে এলাম সেই আধো চেনা নগরে। তখন দৃশ্যপটের পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে।
এ কথাটা বারবার বলতে হবে- নিউইয়র্ক হলো সেই নগর, যেখানে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনকালে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের গানে গানে আমেরিকাবাসীর সাথে বাংলাদেশিদের মধ্যে রচিত হয়েছিল এক রাখীবন্ধন। স্বাধীনতা অর্জনের পর মানুষ ভাগ্য গড়ার জন্য গিয়েছিল দেশে-দেশে, কিন্তু মূল আকর্ষণটা রয়ে গিয়েছিল আমেরিকার প্রতি, আপনজনের মতো।
আমি যখন এ দেশে প্রথম ইমিগ্র্যান্ট হিসাবে আসি, সময়টি ছিল আমাদের নবীন কমিউনিটির গোড়াপত্তনের সূচনাকাল। নিউইয়র্কে তখন এদেশীয়দের আমাদের চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করতো- ইন্ডিয়ান? এরকম সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের অধীনে পরিচালিত ওপি ও পরে ডিভি লটারির কল্যাণে বিজয়ীরা বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশ থেকে এ দেশে আসতে শুরু করে।
স্থায়ীভাবে আমার আমেরিকা আসার পর দেশের সাংবাদিক মহলে কত বন্ধু-বান্ধব রয়েছে, শুনলাম তাদের অনেকেই আমার জন্য দুঃশ্চিন্তায় ফানা ফানা হয়ে যাচ্ছে! বন্ধুবর মোহিতুল ইসলাম রঞ্জু এক চিঠিতে জানালো- ‘কেউ একজন নাকি স্বচক্ষে দেখেছে, আপনি নিউইয়র্কের রাস্তায় বাদাম বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন?’ এক সময় শোনা যেতো লন্ডন-আমেরিকায় বাঙালিরা নাকি বাসন ধোয়ার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো, কিন্তু রাস্তায় বাদাম বিক্রি? অবশ্য ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা বটে! কিন্তু ততোদিনে আমি কাজ পেয়ে গেছি ‘সাপ্তাহিক আমার দেশ’ নামে কমিউনিটি থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায়। সময়টি ছিল ১৯৯২ সাল। এতে অবদান ছিল বাংলাদেশের কৃর্তীমান ফটো সাংবাদিক শামসুল ইসলাম আলমাজি ভাই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহপাঠী বন্ধু বিমলের। দুঃখের সাথে জানাই, এঁরা দু’জনই আজ প্রয়াত।
ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হয়েছিলাম। সেই প্যাশন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয়বার মাস্টার্স করি সাংবাদিকতা বিভাগে। পরবর্তীতে সরকারি পদে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে মন্ত্রণালয়ে যোগদান করার পর থেকে বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে শেষ চাকরিটি পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়ার সাথেই যুক্ত ছিল।
সে কারণ প্রবাসে এসে বাংলা সংবাদপত্রে কাজ পাওয়ার বিষয়টি হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত আনন্দের। আমি সেই পত্রিকায় নানা কাজের ফাঁকে খেটে খাওয়া সাধারণ প্রবাসীদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে লিখতাম ‘জীবন সংগ্রাম’ শিরোনামে একটি করে ফিচার।
সেইসব লেখালেখির সূত্র ধরেই ঠিকানার সম্পাদক ও মালিক এম এম শাহীন এক রাতে আমাকে ফোন করেছিলেন। কথার মাঝে সে রাতে তিনি আমাকে তার পত্রিকায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানালেন।
এম এম শাহীন সম্পর্কে বললে বলতে হয়, তিনি জার্মানি থেকে এ পদশে এসেছিলেন যখন, তখন কমিউনিটি হাঁটি হাঁটি পায়ে তার যাত্রা শুরু করেছে। শাহীন সাহেব রাজনীতির মানুষ না হয়েও স্বভাবজাতভাবে দক্ষ ছিলেন মানুষকে সংগঠিত করার বিষয়ে। তিনি এই লক্ষ্যে যুক্ত হয়েছিলেন আমেরিকার প্রাচীনতম বাঙালি সংগঠন বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকায়। পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যার নাম ছিল ‘লীগ অব পাকিস্তান’। একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে জনমত গঠনে সংগঠনটির ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। ১৯৮৮ সালে নিউইয়র্কে প্রথম অস্থায়ী শহীদ মিনার গড়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই লীগ অব আমেরিকার তৎকালীন সভাপতি প্রফেসর ইলিয়াস কবীর ও সাধারণ সম্পাদক এম এম শাহীন।
শুনে আশ্চর্য্যবোধ করেছিলাম- সেই শহীদ মিনারটি গড়া হয়েছিল শাহীন ভাইয়ের লং আইল্যান্ড সিটির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্কাই লাইন রেস্টুরেন্টে! তারপর সেটি স্থাপন করা হয় রেস্টুরেন্টর অদূরে জন এফ ম্যারি পার্কে। তীব্র কনকনে শীতে ২১-এর প্রথম প্রহরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করেছিলেন প্রবাসীরা। মাথা নত না করার সংকল্প নিয়ে মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকেই শাহীন ভাই ঠিকানা প্রকাশের দিন ধার্য্য করেছিলেন।‘৮৮ সালে লং আইল্যান্ড সিটির যে পার্কে তিনি প্রবাসে প্রথম শহীদ মিনার গড়ার নেতৃত¦ দিয়েছিলেন তার সংলগ্ন সড়কেই স্থাপন করেন ঠিকানা কার্যালয়। প্রসঙ্গক্রমে আরো বলি, সেই সময় সংগঠনের সংখ্যা ছিল আর একটি মাত্র, নাম বাংলাদেশ সোসাইটি। আঞ্চলিক সংগঠনের সংখ্যাও ছিল দু‘একটি। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই জালালাবাদ এসোসিয়েশন।তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা।
এম এম শাহীন স্মৃতিচারণ করে আমাকে বলেছিলেন, সাংবাদিকতা জীবনে কোনদিন যুক্ত না থাকলেও বিচ্ছিন্ন ক্রমবর্ধমান কমিউনিটিকে একটি সুতোয় মালা গাঁথার অভিপ্রায়ে পত্রিকা প্রকাশের ভাবনায় আলোড়িত হয়েছিলেন। তিনি আরো ভেবেছিলেন, এই পত্রিকাটির মাধ্যমে করবেন শিল্প ও সাহিত্যের সেবা। এখানেই শেষ নয়, তারই উদ্যোগে প্রথম গঠিত হয় নিউইয়র্ক প্রেস ক্লাব। এস্টোরিয়ার স্টোর ফিফটি ওয়ানে এর কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। তিনিই ছিলেন এই প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি।
আমার হাতে ঠিকানার দায়িত্বভার তুলে দিয়ে তিনি নতুন এক দিগন্তের সন্ধানে যাত্রা করলেন স্বদেশ ভূমিতে। সেখানেও আশ্চর্য্যরে মত রাজনীতির ক্ষেত্রেও পেয়ে গেলেন অসাধারণ সাফল্য। নির্বাচিত হলেন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য।
শাহীন ভাই আমার কাঁধে যখন ঠিকানার দায়িত্বভার তুলে দেন, তখন তা সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেওয়া ছিল অত্যন্ত দুরূহ ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়। কারণ আমাদের কমিউনিটি তখনো অতি ক্ষুদ্র হওয়ার কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার একেবারেই ছিল না। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পত্রিকা পৃষ্ঠপোষকতার প্রধানতম সুযোগটিও ছিল অত্যন্ত সিমিত। অর্থ উপার্জনের একমাত্র ভরসা পত্রিকা বিক্রি।
ঠিকানায় আমার কর্মজীবন ছিল এক দশকেরও বেশি। এই সময় দলমত নির্বিশেষে সব প্রবাসীর মুখপত্র হিসাবে পত্রিকা প্রতিষ্ঠাই ছিল আমার মুখ্য ব্রত। সেই ঈপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে সহকর্মীরাও ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। মেধা ও মননশীলতার সম্মিলিত প্রয়াসে নবীন কমিউনিটি বিনির্মাণে এই পত্রিকা যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করেছিল, তা আজ ইতিহাস।
পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে বাংলাদেশসহ লং আইল্যান্ড সিটির তৎকালীন সেই অফিসে নিত্যই আসতেন রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, গায়ক-গায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্রীড়াবিদসহ সব পেশা ও নেশার মানুষরা। মজার কথা বাংলাদেশ থেকে প্রবাসে পাড়ি দেয়া কিছু কিছু সাংবাদিকও ঠিকানায় আসতেন চাকরির তদবিরে। অবশ্য এদের মধ্যে সাফল্য লাভ করতে পেরেছিলেন কেউ কেউ।
লেখক : সাংবদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।