নিজস্ব প্রতিনিধি : সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েই তারা তাদের মনোভাব ও আকাক্সক্ষার কথা জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, সরকারপ্রধান বিদেশিদের বক্তব্য শুনেছেন এবং তাদের আশ্বস্ত করেছেন।
সরকারের দিক থেকে সাংবিধানিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বাংলাদেশের বিদেশি রাষ্ট্রদূত এবং মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপদেষ্টা বাংলাদেশের নির্বাচন সম্পর্কে যেভাবে আগ্রহ, উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা স্বাভাবিক কূটনৈতিক আচরণ নয়। সরকারের প্রতি তাদের আস্থা, বিশ্বাসের অভাবই এতে প্রতিফলিত হয়েছে। যদিও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্য পর্যায়ে তারা সরাসরি তাদের এ ধরনের মনোভাবের কথা প্রকাশ করেননি। সম্ভবত কূটনৈতিক শিষ্টাচারের কারণে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনী প্রত্যাশার কথা প্রকাশ করেছেন। তাও বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপরিউক্ত কথা বলেছেন বলে কূটনৈতিক মহল মনে করেন। বিগত দুই সংসদ নির্বাচন যে প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা নিয়ে কূটনীতিকদের মধ্যেও গভীর প্রশ্ন রয়েছে। কোনো কোনো কূটনীতিক সব রকম কূটনৈতিক নিয়ম-রীতি, শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে গত সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সংশয়-সন্দেহের কথা সরকারের কাছে তুলে ধরে।
প্রশ্ন উঠেছে, সব দলের অংশগ্রহণে এবং ব্যাপক সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিতে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে সেই নির্বাচন কি বিদেশিদের গ্রহণযোগ্যতা পাবে? গ্রহণযোগ্যতা না পেলে নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের পক্ষে নির্বিঘ্নে সরকার পরিচালনা কি সম্ভব হবে? ইউরোপীয় ইউনিয়ন যতটা জোরালোভাবে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চেয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেভাবে করেনি। অত্যন্ত প্রভাবশালী নিকট প্রতিবেশী ভারত এ ব্যাপারে দৃশ্যমানভাবেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রায় অভিন্ন। বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের অবস্থানের বিপক্ষে অবস্থান নেবে না। বিস্ময়করভাবে চীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। তবে ব্যাপক সংখ্যক রাজনৈতিক দল ও ভোটারের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন ভারত ও চীন কামনা করে। নীতিগত ও ঐতিহাসিকভাবে চীন প্রকাশ্যে কথা বলার বিপক্ষে। তবে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের প্রতি সমর্থন, সহানুভূতির কথা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে চীন অবগত করেছে।
দেশে-বিদেশে কূটনৈতিকভাবে বিএনপি ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে আসছে। উদ্দেশ্য আগেভাগেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা। সরকারি মহল মনে করেন, তাদের কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম সম্পর্কে সজাগ থেকেই সরকার তার পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হচ্ছে। রাজধানীসহ মহানগরগুলোতে শতভাগ অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু ঢাকার বাইরের ভোটকেন্দ্রগুলোতে সরকারি দলের প্রভাব থাকবে। পুলিশ প্রশাসন ও জেলা-উপজেলা প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন সরকারেরই পক্ষে। বিদেশিরা অনেক কিছু জানতেই পারবে না। বিএনপি ও তার সহযোগীরা যাতে উল্লেখযোগ্য কোনো অভিযোগ আনতে না পারে, নানা কৌশলে সে ব্যবস্থাও করা হবে।
বিএনপি বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপির বক্তব্য অনুযায়ী তাদের এ দাবির পেছনে যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া সমার্থক বলেই তারা মনে করেন এবং বিদেশিদের কাছেও তা তুলে ধরছেন। কিন্তু একটি সার্বভৌম দেশের সংবিধানের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার সুযোগ নেই বিশ্বের মহাশক্তিধর কোনো রাষ্ট্রেরও। একটা দল নির্বাচনে না এলে গোটা নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা হারাবেÑএ দাবিও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এই বাস্তবতায় এবং বাংলাদেশকে ঘিরে স্বার্থ থাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত নমনীয়তার নীতি অবলম্বন করছে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব দুই দেশের বাণিজ্যিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এবং বিদেশি কোনো কোনো প্রভাবশালী মহলের তৎপরতা সম্পর্কেও সরকারকে বিশেষভাবে অবহিত করেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়। সরকারি মহল বিএনপি ও তার বিদেশি মিত্ররা যাতে আগামী নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে, সে লক্ষ্যে কাজ করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতদের নেতৃত্বে কূটনীতিকরা ইতিপূর্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট গ্রহণের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনাররা সরেজমিন সবকিছু তাদের অবগত করেন। কূটনীতিকরা ইভিএমে ভোট গ্রহণের ব্যাপারে কোনো সংশয়-শঙ্কা প্রকাশ করেননি। মূলত বিএনপির অব্যাহত অনুরোধে তারা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে এ নিয়ে কথা বলেন। নির্বাচন কমিশনার সংশয়-শঙ্কা প্রকাশকারী দলকে বিশেষজ্ঞ টিম পাঠিয়ে সরেজমিন পরখ করার প্রস্তাব দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে বিদেশিদের নির্লিপ্ততা বিএনপিকে দারুণভাবে হতাশ করে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন অবশ্য স্বল্পসংখ্যক আসনে ইভিএম ব্যবহার, এমনকি ইভিএম আদৌ ব্যবহার না করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইভিএম-স্বল্পতা ও মেশিন বিনষ্ট থাকার কারণে। বিএনপি তারপর বিদেশিদের দুয়ারে ধরনা দেয় সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকতেই হবে এমন কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। ব্যাপক সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি ও ভোটদান করতেই হবে এ বিধানও নেই। সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় এ ব্যাপারে সরকারের করণীয় নেই। বিদেশি কূটনীতিকদের এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই।
বিএনপি সর্বাত্মক চেষ্টা করছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘকে কোনোভাবে সম্পৃক্ত করতে। বিশেষ করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে সরকারের ওপর কার্যকর প্রভাব রাখতে। কিন্তু জাতিসংঘ কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে, বিশেষ করে সাংবিধানিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, করেও না। তবে ভোটার সাধারণের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন তারাও প্রত্যাশা করে। এ ব্যাপারে সরকারের যথাযথ পর্যায়ে তাদের মনোভাবের কথা জানানো হয়েছে। এ ব্যাপারে সম্ভাব্য ভূমিকা রাখতে তাদের অনাগ্রহ নেই।