গোপালগঞ্জ : তিনি বড় ব্যবসায়ী, এলাকায় প্রভাবশালী। পয়সাওয়ালা। বছর তিনেক আগে একজনের কাছ থেকে বাজারের কিছু জমি কেনেন। তার পর বাজারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি দোকানের ২-৩ শতাংশ জায়গা কেনেন। এর বদৌলতেই পর্যায়ক্রমে ওই বজারের ৫৩টি পরিবারের দোকানপাট ও বসতবাড়ির জায়গা জোর করে দখলে নেন।
এখন মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ করে প্রাচীর তুলে দিয়েছেন। এতে আটটি পরিবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। চলাচলের আর কোনো পথ না থাকায় বাধ্য হয়েই পরিবারের সদস্যরা দেয়ালের সঙ্গে মই স্থাপন করে তাই বেয়ে চলাচল করছেন। মূলত তাদের জায়গা ‘পানির দামে’ কিনে নিতে এ ‘ফাঁদ’ পেতেছেন প্রভাবশালী নুর ইসলাম শেখ।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার এ প্রভাবশালীর দেওয়ালে আটটি পরিবার দুই বছর ধরে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে স্কুলগামী শিশু, বৃদ্ধসহ প্রতিদিনের কাজকর্ম করতে যাওয়া সদস্যরা। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেই প্রভাবশালীর পক্ষ থেকে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের মারধর ও চাঁদাবাজি মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
চতুর্থ শ্রেণির শির্ক্ষাথী জিৎ বিশ্বাস, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র অরূপ সমাদ্দার, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র কমল কান্তি জয়ধর, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী দেবশ্রী বিশ্বাস, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র দেবরতন বিশ্বাস বলে, মই বেয়ে প্রাচীর পার হয়ে স্কুলে যেতে-আসতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। স্কুল থেকে ফিরে প্রাচীর পার হয়ে আর মাঠে খেলতে যেতে ইচ্ছে করে না। বাড়ির মধ্যে আটকা থাকতে হয়। অনেকবার মই থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি। হাত-পা ভেঙে গেছে।
দু’বছর ধরে তাদের এমন বন্দিজীবন চলছে। চলার পথে প্রাচীর দিয়ে ওদের শৈশবকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। দ্রুত প্রাচীর অপসারণ করে আমাদের মুক্ত স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে।
কোটালীপাড়ার কান্দি ইউনিয়নের নয়াকান্দি গ্রামের তরুর বাজারের বিধবা চিপমনি বিশ্বাস, আরতি বিশ্বাস, ব্যবসায়ী সুবোধ সমাদ্দার, সুখরঞ্জন জয়ধর, খগেন বিশ্বাস, শান্তি জয়ধর, আক্কাস শেখ বলেন, নুর ইসলাম শেখের বাড়ি পাশের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার করফা গ্রামে। তিন বছর আগে তিনি তরুর বাজারের বীরেন বিশ্বাসের কাছ থেকে কিছু জমি কেনেন।
তার পর তরুর বাজারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি দোকানের ২/৩ শতাংশ জায়গা কেনেন। এরপর পর্যায়ক্রমে তিনি নয়াকান্দি তরুর বজারের ৫৩টি পরিবারের দোকানপাট ও বসতবাড়ির জায়গা জোর করে দখলে নেন। একপর্যায়ে তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারি জমি দখল করেন। এখন মানুষের চলাচলের পথ বন্ধ করে প্রাচীর তুলে দিয়েছেন। এতে আটটি পরিবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখন তাদের জায়গা ‘পানির দামে’ কিনে নিতে এ প্রভাবশালী ‘ফাঁদ’ পেতেছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত ৬১ পরিবার ও ব্যবসায়ী দ্রুত জমি ফেরত পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। পাশাপাশি নুর ইসলাম শেখের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগী শাজাহান ব্যাপারি বলেন, আমরাসহ আটটি পরিবারের লোকজন প্রভাবশালীর প্রাচীরে দুই মাস ধরে অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে। আমাদের সম্পত্তি পানির দামে কিনে নিতেই উনি এ দুর্ভোগের ফাঁদ পেতেছেন। এসব পরিবারের স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের মই দিয়ে দেওয়াল পার হয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যরাও মই বেয়ে চলাচল করছেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলেই দেওয়া হয় হুমকি। ভয় দেখানো হয় চাঁদাবাজি মামলার। ফলে কেউ প্রভাবশালীর ভয়ে মুখ খোলে না।
বিধবা আলোমতি বিশ্বাস বলেন, তরুর বাজারে আমাদের একটি দোকানঘর ছিল। এ দোকানে আমার ছেলে ব্যবসা করত। যা আয় হতো তা দিয়ে আমাদের সংসার চলত। ঘরটি নুরুল ইসলাম শেখ ভেঙে দিয়ে জায়গা দখলে নিয়েছে। ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। এখন খেয়ে না-খেয়ে আমাদের দিন কাটে।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত নুর ইসলাম শেখের বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে তার ভাই ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই নুর ইসলাম শেখের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমরা কারো জমি দখল করিনি। জমি ও দোকানঘরের জায়গা আমার ভাই কিনেছেন। তিনি তার জায়গায় প্রাচীর তুলেছেন। অনেকের বাড়ি থেকে বের হওয়ার জায়গা নেই। তারা মই বেয়ে প্রাচীর পার হচ্ছেন। এতে আমরা বাধা দিচ্ছি না। পায়ে হাঁটা পথ আমাদের জায়গার মধ্যে পড়েছে, তাই বন্ধ করে দিয়েছি। এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গার পাশে আমাদের জায়গা রয়েছে। এ কারণে পাউবোর জায়গাও আমরা ভোগদখল করছি।
কান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উত্তম কুমার বাড়ৈ বলেন, নুর ইসলাম শেখ জোর করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সরকারি ও নয়াকান্দি গ্রামের বিভিন্ন ব্যক্তির জমি জোর করে দখল করেছেন এমন অভিযোগ আমি শুনেছি। সেখানে সে প্রাচীর নির্মাণ করে আটটি পরিবারের চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করছে। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মাহফুজুর রহমান বলেন, জনসাধারণের চলাচলের পথ বন্ধ করার কোনো বিধান নেই। তাদের চলাচলের পথ অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। বিষয়টি আমি অবগত হয়ে প্রয়োজনে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টিকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবো।