প্রসঙ্গ : অ্যাবাউট বুক্স

বাহারুল আলম :

১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে বাংলা ভাষায় সর্বাধিক প্রচারিত, বস্তুনিষ্ঠ ও জনপ্রিয় পত্রিকা ‘ঠিকানা’র প্রকাশনা শুরু হয়। ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস, ভাষা শহীদের মাস, বইয়ের মাস। ঠিকানা প্রকাশের জন্য সঙ্গত কারণেই এই মাসের ২১ ফেব্রুয়ারির মতো একটি বিশেষ ও মহৎ দিনকে বেছে নেয়া হয়। নিঃসন্দেহে এটি ছিল একটি সুদূরপ্রসারী ও অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত (Prudent) সিদ্ধান্ত। অন্যান্য অনেক মহতী উদ্যোগের মতো ঠিকানার প্রকাশনাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে বহু চড়াই-উৎরাই পেরোতে হয়েছে। কিন্তু কোনো বাধা-বিঘ্নই এর প্রকাশকে বাস্তবরূপ দিতে ও অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে ঠিকানার কর্ণধার ও প্রাণপুরুষ এম এম শাহীন এবং তার সুযোগ্য ও দৃঢ়সংকল্প কয়েকজন সাথীকে তাদের অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথ থেকে নিবৃত্ত করতে সক্ষম হয়নি। তাদের সেই দুঃসাহসী অক্লান্ত পরিশ্রম ও ব্যাপক প্রচেষ্টার (Titanic effort) ফল- ঠিকানা আজ ছোট চারাগাছ থেকে কালের পরিক্রমায় মহীরূহে পরিণত হয়েছে। ঠিকানার বর্ষপূর্তির এই শুভক্ষণে এম এম শাহীনসহ পত্রিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য রইলো অভিনন্দন ও অশেষ শুভেচ্ছা। ঠিকানা দীর্ঘজীবী হোক।
ফেব্রুয়ারি মাস যেহেতু বইয়ের মাস, তাই বই নিয়ে কিছু লিখবো বলে মনস্থির করি। লেখার বিষয়বস্তু নিয়ে যখন ভাবছি, ঠিক সে সময় গত ১২ জানুয়ারি ফোন পেলাম ঠিকানার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি এম এম শাহীনের। কুশলাদি বিনিময়ের পর এটা-সেটা নিয়ে কথাবার্তার পর তিনি বর্ষপূর্তি সংখ্যার জন্য কিছু লেখার জন্য অনুরোধ জানালে ইনশাল্লাহ লিখবো বলে তাকে আশ্বাস দিলাম।

পত্রিকান্তরে আমেরিকান লাইব্রেরি সোসাইটির দেয়া তথ্যমতে জানা যায়, ২০২১ সালে প্রায় দু’হাজার বইকে নানা কারণে বিভিন্ন মহল থেকে চ্যালেঞ্জ বা আপত্তির মুখে পড়তে হয়। দুই দশক আগে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের মতে, এই স্বল্প সময়ের মধ্যে এতো অধিক সংখ্যক বইয়ের বিষয়ে আপত্তি উঠতে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। আমেরিকান লাইব্রেরি সমিতি তার জন্মলগ্ন থেকে বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত বইয়ের বিষয়ে খোঁজখবর করে থাকে।

অতীতে বিভিন্ন সময়ে কখনো ধর্মদ্রোহিতা, কখনো অশ্লীলতা ইত্যাদি কারণে বইয়ের বিষয়ে আপত্তি তুলে তা নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়েছে। আমার জানা মতে, অতীতে নিষিদ্ধ ঘোষিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হলোÑ লোলিটা (ভøাদিমির নবোকভ), স্যাটানিক ভার্সেস (সালমান রুশদি), জেন্ডার কুইয়ার (মায়া কোবারি), টু কিল অ্যা মকিং বার্ড (হার্পার লি), দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল (মার্গারেট অ্যাটউড), দ্য কাউট রানার (খালেদ হোসেনি), লজ্জা (তসলিমা নাসরিন), নারী (হুমায়ুন আজাদ), সত্যের সন্ধানে (আরজ আলী মাতুব্বর) ইত্যাদি।

সাম্প্রতিককালে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা মহলে জেন্ডার ইস্যু আইডেন্টিটি এবং ক্রিটিক্যাল রেইস থিউরি (CRT) নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হতে লক্ষ্য করা যায়। মহল বিশেষ জেন্ডার বিষয়ক বইকে যৌন শিক্ষা এবং সিআরটিকে এক সম্প্রদায়কে অপর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার প্রয়াসমূলক বলে বর্ণনা করে স্কুল-কলেজের কমবয়সী তরুণ শিক্ষার্থীদের এসব বিষয়ে পাঠদান থেকে বিরত থাকার দাবি তুলেছেন।
সিআরটি এক সম্প্রদায়কে (শ্বেতাঙ্গ) অত্যাচারী এবং অপর সম্প্রদায়কে (কৃষ্ণাঙ্গ) অত্যাচারিত হিসেবে উপস্থাপন করছে অভিযোগ করে তারা এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ককে বিষিয়ে না তুলে বরং একাডেমিক তথা পড়াশোনা, অংক এবং কম্পিউটার শিক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব ও জোর দেয়ার পরামর্শ দেন।

যেকোনো বিষয়ে কারও বক্তব্যের সঙ্গে অন্য কারও মতের অমিল বা ভিন্নতা থাকতেই পারে। তাই বলে কারও বক্তব্যকে টুঁটি চেপে ধরা হবে, সেটা কোনোমতেই কাম্য হতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে বৃটিশ-ভারতীয় লেখক সালমান রুশদির মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘A book is a version of the World. If you don’t like it, ignore it, or offer your own version in return. অর্থাৎ, বই হচ্ছে পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি, তোমার যদি কোনো বই পছন্দ না হয়, তাহলে তাকে এড়িয়ে যাও, নয়তো সেই বইয়ের বক্তব্যের বিপরীতে তোমার পাল্টা বক্তব্য উপস্থাপন করো।’
যে সমাজে মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা নেই, সেই সমাজ বদ্ধ জলাশয়ের মতো নোংরা, স্থবির ও হতদরিদ্র। মননশীল, পরিপক্ব উন্নত সমাজের জন্য মতপ্রকাশ ও চিন্তার স্বাধীনতা থাকা অপরিহার্য।

ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয়, সুযোগ দেয়া হলে মেধাবী ও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যক্তিরা শ্রেষ্ঠ সরকার ও উত্তম শাসন ব্যবস্থা উপহার দিতে সক্ষম। রানি প্রথম এলিজাবেথ, যার হাত ধরে বৃটেন গৌরবের উচ্চ শিখরে আরোহণ করে, তিনি জ্ঞান ও শিক্ষার গুরুত্ব ও মূল্য সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল ছিলেন। তার চিন্তাধারাকে অনুরসরণ করে ইংল্যান্ড মেধাবী ও চৌকস ব্যক্তিদের ক্ষমতার উচ্চ পর্যায়ে স্থান দেয়, যাদের তাদের মধ্যে যে বিষয়ে মিল ছিল, সেটা হলোÑ তারা দুজনেই ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রে সুপন্ডিত ছিলেন। বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিনের পাঠাগারে বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, শেক্সপিয়ার, ইউক্লিড, হোমারের ইলিয়াডসহ আরও যেসব বই ছিল, যা কারও পক্ষে এক জীবনে পড়ে শেষ করা সম্ভব নয়।

বইয়ের বিরুদ্ধে অবস্থানগ্রহণকারীদের সবাই যে নির্বোধ বা অর্বাচীন ছিলেন তা নয়, কিছু কিছু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিও ঐ কাতারে সামিল ছিলেন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইজেন হাওয়ার, যিনি একসময়ে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘We want men of Action, not words, certainly not Harvard words.’
আরেকজনের উক্তি, ‘I have no use of intellectuals.’
সবশেষে বলি, আসুন আমরা সবাই বেশি বেশি বই পড়ি এবং বই নিয়ে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হই।

লেখক : কলামিস্ট।