মোহাম্মদ জামান খোকন
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্যদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিবনগর সরকারের পরিচালনায় মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ করেছি। আওয়ামী লীগের ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। আজ থেকে ৬৯ বছর আগে, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শামছুল হক ছিলেন দলের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। প্রায় ১৯০ বছর ব্রিটিশদের অধীনে থাকার পর এক সময় এ উপমহাদেশের নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারেন যে আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজন। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্, একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীÑ সকল নেতাই এ সংগ্রামে জড়িত ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র হবে। এ কে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাবে উল্লেখ করেছিলেন যে মুসলমানদের জন্য দুটি রাষ্ট্র হবে, একটি হবে বঙ্গিস্থান অপরটি পাকিস্তান। হিন্দুদের রাষ্ট্রের নাম ভারতই থেকে যাবে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিনন্নাহর কূটনৈতিক চালে ১২০০ মাইল দূরত্বে দুটি ভূখ- একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়- নামকরণ হয় পাকিস্তান। এভাবেই ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান স্বাধীনতা দিবস পালন করে ১৪ আগস্ট, ভারত করে ১৫ আগস্ট।
ভারতের কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ অবশ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে পাকিস্তানের দু অংশের মধ্যে পূর্ব অংশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব বাংলা ২৫ বছর পর আলাদা হয়ে যাবে। যাহোক, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্বাংশের বাঙালিরা বুঝতে শুরু করেন আসলে পাকিস্তান তথা পশ্চিমাংশের মুসলমানরা আমাদেরকে তাদের ‘প্রজা’ হিসাবেই গণ্য করছে। তখন পূর্বাংশের লোকেরা অর্থাৎ নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারেন যে মুসলিম লীগ আমাদের ভাওতা দিয়েছে! তাই তারা সিদ্ধান্ত নেন- আমাদের ন্যায্য দাবি, আমাদের জন্য আলাদা পার্টির প্রয়োজন। পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন যথাক্রমে শেখ মজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক, একে রফিকুল হোসেন। যদিও প্রথমে দলটির নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, কিন্তু ১৯৫৩ সালে কাউন্সিল অধিবেশনে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এটি করা হয়।
পাকিস্তানি শাসনামলে প্রথমেই আসে ভাষার ওপর আঘাত। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এ দেশের ছাত্রসমাজ বুকের রক্ত দিয়ে তা প্রতিহত করে। পরবর্তীতে পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকেও জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য হয়। তারপরে আসে ৫৪ সালের নির্বাচন। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দল নিয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টের জয় হয়। পাকিস্তান সরকার সেই ফ্রন্ট গঠিত মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। একসময় মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বের হতে ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) গঠন করেন। মাওলানা আবদুল রশীদ তর্কবাগিশ এর সভাপতি হন। কিছুদিন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে একসময় শেখ মুজিব সভাপতির দায়িত্ব নেন। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রথমে ছয় দফার আন্দোলন শুরু হয়। এক পর্যালে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পর ১৯৬৮ সালে উন্নয়নের এক দশক পালন করেন এবং শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝুলানোর আয়োজন করেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দেন এবং আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করেন। তার উত্তরসুরী ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আইয়ুব খান মানে মানে বিদায় নেন। মসনদে বসেই ইয়াহিয়া খান সারা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন এবং সকল রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ করে দেন। কারামুক্তির পর তৎকালীন রেইসকোর্স ময়দানে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি আয়োজিত এক জনসভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেই থেকে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হন।
সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে এক বক্তৃতায় ১৯৭০ সালের জানুয়ারি থেকে দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা ও ’৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সারা পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সারাদেশে নির্বাচনী জনসভা করতে থাকেন। এ সময় ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ লোক পানিতে ভেসে যায়। সে খবর প্রথমে প্রচারিত হয় বিবিসি থেকে। এতেই বোঝা যায় যে, পাকিস্তান সরকার আমাদের কত অবহেলার চোখে দেখেন। অনেক রাজনৈতিক দল নির্বাচন পিছানোর দাবি জানায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড় থাকেন। শেষ পর্যন্ত দুর্গত এলাকায় পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সারা পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯ আসনের মধ্যে অওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুবের পদলোহী ভুট্টোর পিপলস পার্টী ৮০ টি আসনে জয়ী হয়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, তাই আবারো তাদের ষড়যন্ত্রেও নতুন খেলা শুরু হয়। ভুট্টো বেঁকে বসেন, তাদেরও ক্ষমতার ভাগ দিতে হবে। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকেন। ইয়াহিয়া খান ঢাকা সফর করে বিমানবন্দরে ফেরত যাওয়ার পথে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের ‘ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের ১ মার্চ এক বেতার ঘোষণায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সারাদেশে তখন একটাই স্লোগান ওঠে- ‘বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানো হয়। পল্টন ময়দানে একাত্তরের ৩রা মার্চের জনসভায় স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠ করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার কথা বললেন। অবশেষে আসে সেই ৭ই মার্চ। সেই জনসভায় তিনি একাই বক্তা ছিলেন। ১৯ মিনিটের বসেই বক্তৃতায় তিনি পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে আমাদের প্রতি কিভাবে বৈষম্য করা হয়, সব তুলে ধরেন ও মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা ঘোষণা করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনি যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী না হন, সে জন্য ৪ দফা দাবি পাকিস্তান সরকারের কাছে দেন। শেষ করেন এই বলে ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা।’ এরপরে এক পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, ভুট্টো সবাই ঢাকায় আসেন এবং আলোচনার নামে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও কালক্ষেপণ করেন। শেষ পর্যন্ত আলোচনা ব্যর্থ হয়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পূর্বেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তা তিনি ওয়ারল্যাস মারফত চট্টগ্রামে শ্রমিক লীগ নেতা হান্নান সাহেবের কাছে পৌঁছে দেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কর্মীদের সহায়তায় স্বাধীনতার উক্ত ঘোষণঅ প্রচার করা হয়। পরবর্তীতে বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ পটিয়া থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াকে নিয়ে আসেন। ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ঘোষণাপত্র পাঠ করা এক কথা নয়। জিয়াউর রহমানের ঘোষণা কুমিল্লা থেকে আমরাও শুনেছি। পরবর্তীতে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন সাহেবের নেতৃত্ব ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি, বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী, মোশতাক আহমেদ পরাষ্ট্রমন্ত্রী, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান মন্ত্রীসভার সদস্য হন।
লক্ষ্যণীয়, বর্তমানে অনেক স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা প্রশ্ন তোলেন, কেনো ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি? সেদিন যদি তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তবে উপস্থিত সকলকে জালিয়ান বাগ হত্যাকান্ডের মত অনুরূপ হত্যাকান্ডের নির্মম শিকার হতে হত। জনসভায় অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ জনতার একজনও ঘরে ফিরে যেতে পারতেন না। বোমা মেরে সেখানেই সবাইকে হত্যা করা হতো। আবার ২৫ মার্চের রাতে বন্ধবন্ধুর ৩২ নং বাড়িতে অবস্থান করা নিয়েও হাল আমলের কোন কোন জ্ঞানবিদগ্ধ নেতা নানা প্রশ্ন তুলে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চান। উত্তরটি একেবারে সাদামাটা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সর্বস্তরের জনগণের নেতা। তিনি জনগণকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে কাপুরুষের মত পালাতে চান নি। বরং বীরের মত মৃত্যুকে আলিঙ্গনের জন্যই সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন! জনগণের প্রতি ভালবাসা ছিলো বলেই তিনি পালাননি। তিনি যে কর্মীবাহিনী ও নেতা তৈরি করেছিলেন, তাদের প্রতি তার আস্থা ছিল। তার অনুপস্থিতিতে তারা আন্দোলন চালাতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই আমরা ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা লাভ করেছি। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে সাহায্য চেয়েছেন। এমএজি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করেছেন। কারণ তিনি জানতেন, ওসমানী সাহেব সেই বৃটিশ আমলের সৈনিক। সর্বোপরি তাজউদ্দিন সাহেব দেশের সাধারণ জনগণ, তথা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পরিবার নিয়ে থাকেন নি। যে দপ্তরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছিলো, সেখানেই তিনি থেকেছেন। সব সময় তিনি এখানেই ছিলেন। মাত্র একদিন সোহেল তাজের অসুখ হওয়াতে দেখতে গিয়েছিলেন। যাহোক, মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে জনগণ, ভারতের জনগণ সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে । যদিও আমাদের জাতিরজনক পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন।
অবশেষে এক সময় ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শোনা গেল তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দেবেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটেন ও ভারত হয়ে তার স্বাধীন বাংলায় ফিরে আসেন। এসেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। সারা বিশ্বের কাছে সাহায্য ও স্বীকৃতি দিতে আহ্বান জানান। বিধ্বস্ত দেশ। আস্তে আস্তে পূণর্গঠন করতে থাকেন। রাস্তাঘাট-পুল সবকিছুই ভাঙা। তারপরেও তিনি দেশ চালাতে থাকেন। ৭৩ সালে নির্বাচন দেন, সংবিধান দেন। যা পাকিস্তানের ছিলো না। ভারত থেকে ফিরে আসা এক কোটি লোককে ঘরবাড়ি বানানোর জন্য সাহায্য দেন। কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধীরা কিছুদিন পালিয়ে ছিল। শেষে ৭৩ ও ৭৪ সালের দিকে সিরাজ শিকদারের দল দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে থাকে। ছাত্রলীগের একটি অংশ, বর ও শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে বের হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে সারাদেশে মারামারি ইত্যাদি শুরু করে। আমেরিকা খাদ্য সরবরাহ না করায় এবং দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফসল না করতে না পারায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এরই মধ্যে পাকিস্তান ফেরত কিছু সৈন্য এবং সেই খুনি মোশতাক, যে ভারতের মাটিতে বসেই মুজিনগর সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, সবাই একজোট হয়। একসময় সেই মোশতাক, যে ছিল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার সময় ২ নম্বর যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করিয়ে ১ নম্বর হয়েছে, অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই খুনিও ৩ মাসের মাথায় বিদায় নিতে বাধ্য হয়। তারপরে খালেদ মোশাররফ অভ্যুত্থান করে। সেও নিজের পদ নিয়েই ব্যস্ত ছিল। জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। সেদিকে তার কোন খেয়ালই ছিল না। নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। এদিকে কর্নেল তাহের তার অনুগত সৈন্যদের দিয়ে ব্যস্ত ছিল ক্ষমতা গ্রহণের জন্য। অন্যদিকে জিয়ার অনুসারীরা নামকা ওয়াস্তে জিয়াকে বন্দী নাটক করে তাহেরকে খালেদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। তাহেরের অনুগত সৈন্যরা খালেদের অনুগতদের হত্যা করে খালেদসহ তার দুজন সহযোগীকে। কিন্তু বেতার ভবন দখল করে রাখে জিয়ার অনুসারীরা, তাহের আর বেতার কেন্দ্রে যেতে পারেন নি। জিয়াউর রহমানের অনুগতরা বেতার কেন্দ্র দখল করে এবং বেতারে জিয়াউর রহমান বক্তৃতা করেন। তাহেরের সেই বিপ্লব সেখানেই শেষ হয়ে যায়। একসময় তাকে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেন। যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দেন। রাজাকার শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করেন। যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে আসার অনুমতি দেন। এক সময় জিয়াউর রহমানও সামরিক অভ্যুত্থান নিহত হয়। পরবর্তীতে কিছুদিন মরহুম জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল ক্ষমতায় থাকলেও আরেক পাকিস্তান ফেরত সেনা কর্মকর্তা এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা দখল করে। নয় বছর শাসন করার পর এরশাদও বিদায় নেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে নির্বাচনে জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল ক্ষমতায় যায়। তারা পরবর্তীতে মাগুরার নির্বাচনে কারচুপির জন্য অভিযুক্ত হয়। এক সময় তত্ত্বাবধায় সরকারের জন্য আন্দোলন হয়। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দল ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তারপরে যে কালো আইন জিয়াউর রহমান জারি করেছিলেন ‘ইনডেমিনিটি বিল’ তা বাতিল করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু হয়। সাজাও হয়, কিন্তু কার্যকর করা হয়নি। পরবর্তী মেয়াদে আবার বিএনপি ক্ষমতায় যায়। যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে তালবাহানা শুরু হয়। এক সময় দেখা গেল প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়। পরবর্তীতে সেনা সমর্থিত সরকার হয়। সেই সরকারের অধীনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় রায় কার্যকর করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। রায়ও কার্যকর করা হয়। যে গোলাম আযমকে মরহুম জিয়াউর রহমান দেশে আসতে অনুমতি দেন, তিনিও শেষ পর্যন্ত জেলে মৃত্যুবরণ করেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সবসময় মুখ ভেংচিয়ে কথা বলত, তারও শাস্তি হয়। মায়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমানার সমাধান হয়। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি বাস্তবায়িত হয়।
শেখ হাসিনার আমলেই ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষায় মর্যাদা লাভ করে। যার প্রস্তাবক ছিলেন কানাডাপ্রবাসী আমার কুমিল্লা হাইস্কুলের সহপাঠী রফিকুল ইসলাম। শেখ হাসিনার আমলেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করেন। বক্তৃতায় বলেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বাবার নেতৃত্বে মুক্তিযদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বক্তৃতা, নিউইয়র্ক পত্রিকা বলেছিল রাজনৈতিক কবিতা, সেই ভাষণও ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীতে গরিব দেশের জন্য ‘রোলমডেল।’ আমরা আজ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
যে পার্টির মাধ্যমে সংগ্রাম করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আবার ফিরে এসেছে। আসুন আমরা মাওলানা ভাসানী, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, শামসুল হক, হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দী সবাইকে স্মরণ করি ও তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনা করি। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতিক জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুক্তিযুদ্ধের জনক বঙ্গতাজ তাজউদ্দিনসহ সব রাজনৈতিক নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। সব মুক্তিযোদ্ধা ভাইবোনেরা, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন দেশ পেয়েছি, তাঁদেরকে শ্রদ্ধা জানাই। যারা মারা গেছেন, সৃষ্টিকর্তা যেন পরপারে শান্তিতে রাখেন, এ দোয়া করি। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, সব হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত ও শাস্তির ব্যবস্থা করুন। তাদের আত্মা আমাদের অভিশাপ দিচ্ছে। আপনি সুস্থ থাকুন। সৃষ্টিকর্তা তুমি আমাদের সহায়। আমীন।
-পোকিপসী, নিউইয়র্ক।