বাহারুল আলম :
২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অধিকাংশ মানুষ মনে করেছিলেন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী মিসেস হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান প্রার্থী, রিয়েলিটি টিভি স্টার, রাজনীতিতে নবাগত কোটিপতি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ডোনাল্ড জন ট্রাম্পকে অতি সহজেই পরাজিত করে প্রথম মার্কিন মহিলা প্রেসিডেন্ট হবার গৌরব অর্জন করবেন। কিন্তু সেটা হয়নি। আমেরিকা ফার্স্ট তথা মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন (Make America Great Again Maga) স্লোগান আন্দোলনের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন আদায় করে নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে বিজয়ী হয়ে আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ট্রাম্পের প্রতিটি জনসমাবেশে যে বিপুল সংখ্যক মানুষের জমায়েত হয়, তা ছিল মার্কিন ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ট্রাম্প যেভাবে মানুষকে তার নীতি-আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন, তাতে শেষ পর্যন্ত হিলারির পরাজয় অবধারিত হয়ে যায়। ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প বাইডেনের কাছে পরাজিত হলেও তিনি কমবেশি ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিকের সমর্থন লাভে সক্ষম হন। একজন পরাজিত প্রার্থীর এতো বিপুল সংখ্যক ভোট-প্রাপ্তির ঘটনাও ছিল একটি বিরল বিষয়। এহেন ব্যাপক জনসমর্থনের সুবাদে নানা কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও ট্রাম্প হয়ে যান রিপাবলিকান পার্টির অবিসংবাদিত নেতা। তার কথা ও অবস্থানের বিরোধিতা ও সমালোচনা করা রিপাবলিকান নেতাদের জন্য অনেকটাই অকল্পনীয় বা রাজনৈতিক সুইসাইডের সমতুল্য হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিককালে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী মনোনয়নে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ নিয়ে সিনেটে রিপাবলিকান দল নেতা মিচ ম্যাককনেলের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। তার পরিণামে মিচ ম্যাককনেল ট্রাম্পের রোষানলে পতিত হন। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় লিজ চেনীসহ আরো কয়েকজন রিপাবলিকান নেতা নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন।
উপরে বর্ণিত পরিস্থিতি দেখে ডেমোক্র্যাটদের এটা বুঝতে বাকি থাকে না যে, মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্প একটা বড় ফ্যাক্টর বনে গেছেন এবং রাজনীতিতে তার উপস্থিতি আগামীতে নির্বাচনে তাদের বিজয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা বা থ্রেট হয়ে দাঁড়াবে।
এ উপলব্ধি থেকে ডেমোক্র্যাটরা তাদের রাজনৈতিক মূল টার্গেট করেন ট্রাম্পকে, যার মূল লক্ষ্যই হলো- তাকে যে কোনোভাবে অপদস্থ (Malign) করে রাজনীতিতে তাকে ব্রাত্য বা নিষিদ্ধ করা। এ উদ্দেশ্য ডেমোক্র্যাটরা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তার বিরুদ্ধে কংগ্রেস দু-দুবার অভিশংসন প্রক্রিয়া চালায়, যদিও মার্কিন সিনেটে প্রয়োজনীয় সমর্থন পেতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের কাক্সিক্ষত উদ্দেশ্য অর্জনে অসমর্থ হয়। তাছাড়া ক্যাপিটল ভবন হামলা নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের ৬ জানুয়ারি কমিটির শুনানী ও ট্রাম্পের ফ্লোরিডার বাসভবনে পুলিশি রেইডও একই উদ্দেশ্যে পরিচালিত বলে কেউ কেউ মনে করেন।
আগামী ৮ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মধ্যবর্তী নির্বাচন ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটি অগ্নিপরীক্ষা হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। ইউরোপে চলমান যুদ্ধ, তাইওয়ান দখলের জন্য চীনের সম্ভাব্য হামলা, রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি, বর্ডার ক্রাইসিস, ক্রাইম পরিস্থিতি, গ্যাসসহ সব নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, স্টক মার্কেটের অব্যাহত দরপতনের প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার কারণে জনমনে বিরাজমান অসন্তোষের জেরে নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের ব্যাপক বিপর্যয় হবে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। অন্যদিকে এসব ইস্যু নিয়ে রিপাবলিকান নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে ট্রাম্প বর্তমানে সোচ্চার হয়েছেন। দেশের বিভিন্নস্থানে আয়োজিত জনসভায় তিনি বাইডেনের গত দুই বছরের শাসনের কথিত ব্যর্থতা তুলে ধরে ডেমোক্র্যাটিক শাসন থেকে থেকে মুক্তির জন্য রিপাবলিকান প্রার্থীদের ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
সমাবেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক (প্রায় ১৫/২০ হাজার) মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, ট্রাম্পের ‘মাগা’ আন্দোলনে মোমেন্টাম (Momentum) সৃষ্টি হয়েছে, যা ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে সৃষ্ট অস্বস্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
বর্ণিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ ডেমোক্র্যাটিক নেতাদেরকে তাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে ট্রাম্পবিরোধী প্রচার-প্রচারণা ব্যাপকভাবে জোরদার করতে দেখা যায়। তারা ট্রাম্প ও তার মাগা আন্দোলনকে গণতন্ত্র, দেশ ও জনগণের জন্য বড় হুমকি ও বিপজ্জনক হিসাবে আখ্যায়িত করেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ফিলাডেলফিয়ায় এক জনসমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাইডেন বলেন, ‘Too much of what’s happening in our country today is not normal. Donald Trump and his MAGA republicans represent an extremism that threatens the very foundations of our rcpublic’।
অনেকে তার এহেন বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও, অনেকে এ ধরনের বক্তব্য মার্কিন জনগণের মধ্যে বিভাজনকে আরো প্রসারিত করবে বলেও মনে করেন। বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধান কীভাবে হতে পারে ও বিদ্যমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কোন পথে, সেটা নিয়ে কোনো কথা না বলে কেবল ট্রাম্প, তার সহকর্মী ও মাগা আন্দোলনকে Malign করার প্রচেষ্টা ডেমোক্র্যাটদের জন্য নির্বাচনে কতোটা সহায়ক হবে- তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সাম্প্রতিককালে বাইডেনের ৭৫০ বিলিয়ন ডলারের ট্যাক্স, হেলথ ও ইনফ্লেসন রিডাকসন বিল কংগ্রেসে পাস হওয়া, গ্যাসের মূল্য কিছুটা হ্রাস পাওয়া এবং গর্ভপাত আইন বাতিলের কারণে বহু সংখ্যক মহিলাকে রিপাবলিকান পার্টিবিরোধী মনোভাব ব্যক্ত করতে দেখা যায়। যে কারণে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পক্ষে জনমতে কিছুটা হলেও উদ্দীপনা (Impetus) সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এ কারণে আসন্ন নির্বাচনে তাদের যে ধরনের ভরাডুবির আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেটা না হয়ে বরং দু’দলের প্রার্থীদের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
লেখক : কলামিস্ট।