প্রসঙ্গ : মৃত্যুশয্যা

মুনিয়া মাহমুদ :

মানুষ যখন মৃত্যুশয্যায় থাকে, তখন অনেক কিছু ইশারায় খেতে চায়। যেমন আমার মাকে দিয়ে শুরু করি। তিনি টেম্পা জেনারেল হাসপাতালে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ সালে ইন্তেকাল করেন। তখন আমি ঢাকায় ছিলাম। তার এক বছর পর আমি আমেরিকায় আসি। আম্মার কথা শুনেছিলাম, তিনি হাত দিয়ে পেট দেখাতেন আর ইশারায় বোঝাতেন ডাল-ভাত খাবেন। তখন তার মুখে-নাকে টিউব। তখন আমি ছিলাম না, তাই এই অবস্থায় যে পাশে থাকে, তার যে কী পরিমাণ কষ্ট লাগে, তা না দেখলে বোঝা যায় না।

আমার সবচেয়ে আদরের ছোট ভাই পাত্তু ১৩ এপ্রিল ২০১৮-তে ইন্তেকাল করে। ও শেষ সময় ডাব খেতে চেয়েছিল। যখন ডাব আসে, তখন সে আর নাই। ডাবের পানি মুখ গড়িয়ে পড়ে যায়।
আব্বার কথা মনে আছে। তিনি মারা যান ১৯৮৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর। তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পেইং বেডে। কেবিনে আমরা ওনাকে নিয়েছিলাম। ডাক্তার সেখানে কম ভিজিট করে বলে পেইং বেডে নিয়ে এসেছি। ওনাকে আমরা বাসার খাবার খাওয়াতাম। মনে আছে, ১৬ ডিসেম্বর পুরো ওয়ার্ডে উৎসব উৎসব ভাব চলছে। কারণ আজ ভালো খাবার দেওয়া হবে। দুপুরে টুংটাং করতে করতে খাবার গাড়ি আসে। ওয়ার্ডে হইচই শুরু হয়। ওরা জানে, আমরা খাবার নেই না। তবে সেদিন আব্বা জেদ ধরেন, ওদের খাবার খাবেন। তখন আমি ছিলাম আব্বার সঙ্গে। ছোট ছোট দুই টুকরা মাংসের সঙ্গে ঘিয়ে ভাজা ভাত। তবে ঝোল দিয়েছে ভালোই। আব্বা এক টুকরা মাংস মুখে দিয়ে বের করে দেন। এক চামচ ভাত খান। বলেন, আর খাব না। মাংস মুখে দিয়ে আমার মনে হলো একটা পাথর মুখে দিয়েছি। এর কয়েক দিন পর আব্বা চলে যান।

আমার মেজো বোনের ছেলে জনি হার্টের সমস্যার কারণে হাসপাতালে ছিল। একদিন মাকে ফোন করে বলে, তার স্যুপ খেতে ইচ্ছা করছে। মা স্যুপ পাঠায় একজনকে দিয়ে, কারণ মা’ও সুস্থ নয়। হাঁটতে পারে না। স্যুপ মুখে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বমি করতে করতে জনি মারা যায় ২৫ জানুয়ারি ২০১৭ সালে।

আমার পরিবারে (স্বামীর পরিবার ছাড়া) মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। সবার কথা এখানে লিখব না। ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি আমি অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হই। তখন করোনা প্রায় শুরু হচ্ছে।
মার্চে আমার জ্ঞান ফিরলেও আমার পুরো শরীর প্যারালাইজড। আমি দুর্বলতার কারণে কথা বলতে পারি না। ছোট ভাই নান্টুকে (সম্প্রতি গত হয়েছে) দেখলেই ইশারায় বোঝাতাম, ডালের পানি খাব। ও আমার মুখের কাছে কান দিয়ে শুনত। এদিকে ডাক্তারের নিষেধ আমাকে পানি এবং কিছুই মুখে দেওয়া যাবে না। পানির জন্য মনে হচ্ছিল আমি মরুভূমিতে আছি। পানির জন্য হাহাকার করত মন। আমার জেদাজেদিতে একদিন সত্যিই ডালের পানি অল্প করে খাওয়াল নান্টু নার্সের চোখ ফাঁকি দিয়ে। নুরুদ্দিন আমার স্বামী, আমার মুখে অল্প করে পানি দিত। কারণ পানি ফুসফুসে চলে যেতে পারে, তাই খুব অল্প দিত। তারপর আমার জিদ উঠল চা খাব। যেই আসে তাকে অস্থির করে ছাড়ি। এরপর একদিন চা নিয়ে আসে আমার আত্মার ভাই মুনির। আমি জানি না, তখন সেন্সে ছিলাম না। চা ঠান্ডা না করেই মুখে দিই। আমার জিহ্বা পুড়ে যায়। আমি কিন্তু সেটা বুঝি না। ডাক্তাররা বুঝে পায় না কেন আমার জিহ্বার এই অবস্থা! সাপের জিহ্বার মতো কালো জিহ্বা। ছবিও আছে। আমার কথা বলতে গেলে অনেক লম্বা হয়ে যাবে। পরে লিখব।

সবশেষে লিখছি আমার প্রাণের ছোট ভাই নান্টুর কথা। গত ডিসেম্বরের শেষে হঠাৎ ওর ক্যানসার ধরা পড়ে। আমি তো পাগলের মতো হাসপাতালে ছুটে যাই। জানতে পারি, ওর নন-হজকিন্স বি সেল লিম্ফোমা। একধরনের ব্লাড ক্যানসার। লিম্ফ নোড থেকেও হতে পারে বা বোনম্যারো থেকে। এটা শরীরের ইমুইন সিস্টেম নষ্ট করে দেয়। প্রথমে ওর পেট পানিতে ফুলে যায়। তখন ও কিছুই খেতে পারে না। মুখে টেস্ট থাকে না। ওরা পেট থেকে পানি বের করলে ওর মুখে রুচি আসে। তখন সে নানা রকম রান্না করা জিনিস খেতে চায়। আমি চিকেন স্যুপ মিস দিই না। ওটা প্রতিদিন খায়। ওর খুব প্রিয় ম্যাকডোনালসের বড় সাইজ কোক। সেটাও একদিন আমার ভাগনে আনে ওর জন্য। আমাকে বলে, খুব শান্তি পেয়েছি কোক খেয়ে। তারপর যা চাইত আমি রান্না করে দিতাম। ওর আরও বন্ধুবান্ধব খাবার নিয়ে আসত। ও সারা জীবন পরোটা খেতে খুব পছন্দ করত। হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলে আমাদের বাসায় থাকত, কারণ ওর স্ত্রী বাংলাদেশে। মনে আছে, একদিন পরোটা খেতে চাইলে আমার ছেলে আয়ান পরোটা ও খাসির পায়া নিয়ে আসে। আমরা একসঙ্গে খুব তৃপ্তিভরে খাই।

একদিন নান্টু আমাকে বলে, তুই কি সব দিস! আমার মাংস খেতে ভালো লাগে না। ‍তুই লাউ, পালং শাক, ভেন্ডি আরো যা পাস কালকে নিয়ে আসবি। যে জীবনেও সবজি ভালোবাসে না, তার এই আবদার শুনে আমি নিজে বাজারে গিয়ে যা পাই নিয়ে এলাম। আমার আবার সমস্যা আছে, রাতে সাধারণত আমার ঘুম আসে না। যা-ই হোক, সারা রাত ধরে ছয় রকমের সবজি রান্না করে পরদিন পাঠালাম। পরে আমাকে ফোন করে বলে, তুই কি পাগল? আমাকে এত সবজি দিয়েছিস কেন? দিবি একটা-দুইটা! আমি বলি, তুই যা বলেছিস তা-ই দিয়েছি। খেতে না পারলে ফেলে দিস। ও বকা দেয়, কারণ ও জানে আমি অনেক অসুস্থ।

এটাই ছিল নান্টুর জন্য আমার শেষ রান্না। পরে সে কোমায় চলে যায়। কোমায় গেলেও একটু একটু সেন্স থাকত। এক রাতে আমি ছিলাম ওর সঙ্গে। আমি দেখি, সে কেমন জানি ছটফট করছে। আমি কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলি কী হয়েছে? পানি খাবি? ও মাথা নাড়ে। আমি ওকে বলি, তোকে আমি লুকিয়ে একটু পানি দেব। নার্স দেখলে আমাকে বের করে দেবে। নান্টু মাথা নাড়ে। ওর মুখের টিউবের পাশ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি দিই। তারপর দেখি আবার চায়। তারপর আরেকবার দিয়ে বলি, আর দেওয়া যাবে না। ইশারায় পা দেখায়। বলি, পা ব্যথা? মাথা নাড়ায়। আমি ওর পা টিপি, হাত টিপি। সে সারা রাত আমাকে বসতে দেয় না। ডান হাত তুলে এবং আমি হাত ধরলেই আমার হাত চেপে ধরে। আমি ওর কানের কাছে বলি, আমার কোমর ব্যথা করছে। একটু বসি। সে না-বোধক মাথা নাড়ে। তখন আমি ওর কানের কাছে বলি, আমি চেয়ারে বসি। তুই হাত তুললে আমি আসব। চেয়ারে গিয়ে বসতে না বসতেই হাত তোলে। বেলভিউ ইমার্জেন্সিতে সকাল ছয়টা থেকে আটটার শিফট চেঞ্জিংয়ের জন্য কাউকে থাকতে দেয় না। তখন ওয়েটিং রুমে থাকতে হয়। তবে আমি সাতটার সময় যাই ওয়েটিং রুমে।

আমি নান্টুকে অনেকবার মুখে একটু একটু পানি দিয়েছি, কারণ আমি জানতাম ওই কয়েক ফোঁটা পানির মূল্য কী? পানি খাওয়ার জন্য তখন মনে হয় জান বেরিয়ে যায়। তবে বিরাট আফসোস, ওর মৃত্যুর সময় আমি ওর মুখে পানি দিতে পারি না। ৬ এপ্রিল আমার বুক শূন্য করে ও চলে যায়।

-নিউইয়র্ক, ২৬ এপ্রিল ২০২৩