প্রসঙ্গ : লিগ্যালাইজেশন অফ মারিজুয়ানা এবং হেইট ক্রাইম

বাহারুল আলম

যারা টিভিতে নিয়মিত খবর দেখেন, তারা নিশ্চয়ই সম্প্রতি এই ঘটনার ভিডিওটি দেখে থাকবেন। ম্যানহ্যাটানের একটি বড় আবাসিক ভবনের সামনে দিয়ে হেঁেট যাওয়ার সময় একজন এশিয়ান-আমেরিকান মহিলাকে জনৈক ব্যক্তি ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার বুকে ও পেটে লাথি মারছে। ৬৫ বছর বয়সী ঐ মহিলাকে এভাবে হেনস্থা হবার দৃশ্য দেখে সারাদেশবাসী রীতিমতো হতবাক ও স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। জানা যায়, ৩৮ বছর বয়সী ব্র্যান্ডন ইলিয়ট ঐ মহিলাকে হেনস্থা করে। তথ্য মতে, ইলিয়ট ১৯ বছর বয়সে তার নিজের মাকে হত্যা করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। পরে প্যারলে মুক্তি পেয়ে সে ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী এক হোমলেস শেল্টারে বসবাস করছিল। আশার কথা, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ অপরাধীকে ত্বরিৎ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে এশিয়ান-আমেরিকান নারী-পুরুষের (চীনা, জাপানি, কোরিয়ান, ফিলিপিনো ইত্যাদি) বিরুদ্ধে হেইট ক্রাইমের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তথ্যমতে, এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত এ ধরণের ঘটনার সংখ্যা ৩৩ ছাড়িয়ে গেছে। অথচ গত বছরের পুরোটা সময়জুড়ে এ সংখ্যা ছিল ১১। সাবওয়ে, রাস্তাঘাট ও দোকানপাটে আজকাল এ ধরণের ঘটনা প্রায়শই ঘটতে দেখা যাচ্ছে। উপরে বর্ণিত ঘটনার পার্শ্ববর্তী এক ভবনে অবস্থনরত ৩ ব্যক্তি ঐ ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও তারা মহিলার সাহায্যে এগিয়ে আসেনি, যা ছিল অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ঘটনার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে নিউইয়র্কের পুলিশ কমিশনার ডারমট শে জানান যে, নিউইয়র্ক পুলিশ এ ধরণের হেইট ক্রাইম কখনোই সহ্য ও মেনে নেবে না। এ ঘটনা নিউইয়র্কবাসীর সব মূল্যবোধের পরিপন্থী বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তথ্যমতে, হেইট ক্রাইম অভিযুক্ত হলে ইলিয়টের ২৫ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এই ঘটনার আগে গত ১৫ মার্চ জর্জিয়ার আটলান্টা শহরে এশিয়ান-আমেরিকান মালিকানাধীন ৩টি বিউটি পার্লারে জনৈক বন্দুকধারী ৮জনকে গুলি করে হত্যা করে, যার মধ্যে ৬জনই ছিলেন এশিয়ান-আমেরিকান।

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র বিল ডি ব্লাজিও ম্যানহাটানের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ঘটনাটিকে বীভৎস বলে বর্ণনা করেন। আক্রান্ত মহিলার সাহায্যে কেউ এগিয়ে না আসাকেও তিনি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করেন। তিনি সবাইকে ৯/১১ পরবর্তী মন্ত্র- See something, say something স্মরণ করিয়ে দিয়ে হেইট ক্রাইম প্রতিরোধে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

শুধু এশিয়ান-আমেরিকান নয়, নিকট অতীতে মুসলমান ও ইহুদিদের বিরুদ্ধেও অনুরূপ বহু হেইট ক্রাইমের ঘটনা ঘটেছে। বর্তমান ঘটনাগুলোকে কেউ কেউ সেই ঘৃণ্য ধারাবাহিকতার অংশ হিসাবে দেখছেন।

অব্যাহতভাবে এসব নির্মম ঘটনার কারণে এশিয়ান-আমেরিকানদের মধ্যে প্রবল ভয়-ভীতি বিরাজ করছে বলে জানা যায়। হতাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকায় বহু এশিয়ান-আমেরিকান এখন কাজে-কর্মে যেতে ভয় পাচ্ছেন। নেহায়েত জরুরি না হলে তারা ঘর থেকে বের হতে দু’বার চিন্তা করছেন, যা স্বাধীন ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের সঙ্গে মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়।

এ ধরণের হেইট ক্রাইম বৃদ্ধির জন্য কেউ কেউ কোনো কোনো রাজনীতিকের বিদ্বেষমূলক কথাবার্তাকে দায়ী করছেন। নিকট অতীতে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনাভাইরাসকে চায়না, কুংফু ভাইরাস ইত্যাদি নামে অভিহিত করে মানুষের মধ্যে চীনা নাগরিকদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উসকে দিয়েছেন, যে কারণে এশিয়ান-আমেরিকানদের দেখামাত্র কেউ কেউ You don’t belong here, go back China জাতীয় বাক্য উচ্চারণ করতে সাহস পাচ্ছে।

নিউইয়র্ক পুলিশের একটি হেইট ক্রাইম টাস্কফোর্স রয়েছে। চলমান সহিংসতার প্রেক্ষাপটে এই ফোর্সকে আরো সক্রিয় করা দরকার। তাছাড়া হেইট ক্রাইমপ্রবণ এশিয়ান-আমেরিকান, মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে পুলিশের টহলদারি বৃদ্ধি ও সাদা পোশাকে বহু সংখ্যক পুলিশ নিয়োগ জরুরি বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।

বর্তমানে আমরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনেক প্রগতি অর্জন করেছি। বৈষম্য, যৌনতা (সেক্সিজম), মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা আগের যেকোনো সময়ে তুলনায় অনেক হ্রাস পেয়েছে। এখন আমরা অনেক বেশি অধিকারও ভোগ করছি। অর্ধেক পৃথিবী বর্তমানে ইন্টারনেটের সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছে। চরম দারিদ্র্যের হারও অনেক কমে গেছে। শিশু মৃত্যুর হার খুব কম এবং মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে। আগের যেকোনো সময়ের চাইতে আমাদের সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি। করোনাভাইরাসসহ বহু রোগের ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়েছে।
এতোসব ভালো খবরের মাঝে কিছু খারাপ খবরও আছে। তথ্য মতে, বয়স নির্বিশেষে আমেরিকায় একটি বিরাট অংশের মানুষের মধ্যে হতাশা, দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপের স্তর (Stress level) হালে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা কেবল বেশি সংখ্যায় হতাশার শিকার হচ্ছেন না, অনেক কম বয়সেও তারা এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিগত বহু বছর ধরে নারী-পুরুষ উভয়ে তাদের নিজ নিজ জীবন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। মানসিক চাপের স্তর বৃদ্ধি পাওয়াকে অনেক এর মূল কারণ বলে মনে করেন। ওষুধের ওভারডোজ, মাদকাশক্তি বর্তমানে আগের সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।

তথ্য মতে, প্রায় অর্ধেক আমেরিকানের মধ্যে নিঃসঙ্গতার বোধ বিদ্যমান, যারা তাদের জীবনে আত্মীয়-পরিজন ও নিকটজনের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার অভাবও গুরুতর পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে খুব কম সংখ্যক মানুষ তাদের সরকার, মিডিয়া এবং একে অপরের উপর নিরঙ্কুশ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপনে সক্ষম।

২০১৯ সালের প্রথম দিকে গবেষকরা মানুষদের এই মর্মে প্রশ্ন করেন যে, গত ৬ মাস সময়ে তারা তাদের সমস্যার বিষয়ে কতজন মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। উত্তরে তারা ৩/৪ জনের কথা উল্লেখ করেন, কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যাটা শূন্য বলে জানা যায়। পাশাপাশি চরমপন্থার বৃদ্ধি ও বন্দুকের সহজলভ্যতার বিষয়টিতো রয়েছেই।

এদিকে সম্প্রতি নিউইয়র্ক স্টেটে বিনোদনমূলক। মারিজুয়ানা বা গাঁজা সেবন বৈধ করে আইন পাস হয়েছে। এখন থেকে ২১ বছরের উপরে যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বিনোদনের জন্য বিনা বাধায় গাঁজা সেবন করতে সক্ষম হবেন। এর আগে আরো ১৪টি স্টেটে গাঁজা সেবনকে বৈধ করে আইন প্রণীত হয়। এর ফলে অর্থ সংকটে পতিত নিউইয়র্কের রাজস্ব আয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।

গাঁজা সেবনকে বৈধকরণ আইন নিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। গাঁজা সেবনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ছাড়াও এটা সমাজে কী ধরণের অস্থিরতা বা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে।

ইতোমধ্যে তরুণ ও ছাত্র সমাজের মধ্যে ড্রাগ আসক্তি একটি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মধ্যে গাঁজা সেবনের বৈধতা দান তাদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা ও অপরাধ প্রবণতার জন্ম দিতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। ছাত্র-তরুণদের মস্তিষ্ক গঠনের সময়ে গাঁজা সেবন কী ধরণের বিরূপ প্রভাব রাখতে পারে, সে বিষয়ে বহু মহলে প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে বিশেষ করে অভিভাবকদের তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা (Conversation) শুরু করা আশু জরুরি বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।

-কলামিস্ট।