শফিক জামিল
সহজ একটা উদাহরণের মাধ্যমে শুরু করি :
ধরুন, আপনার একটা মোটর গাড়ি আছে, সে গাড়ি চালান আপনি নিজে মানে আপনি হলেন চালক;
তাই আপনাকে ছাড়া যেমন গাড়ি চলবে না আবার জ্বালানি ছাড়াও গাড়ি চলবে না।
ঠিক তেমনি মানুষের আত্মা হলো গাড়ির চালকের মতো এবং দেহ হলো মোটর গাড়ি। আপনার দেহ গাড়ি চালাতে জ্বালানি লাগবে, তা হলো অক্সিজেন ও খাদ্য- জ্বালানি একই সাথে আপনাকে শক্তি বা জীবনীশক্তি দিয়ে সচল ও কর্মক্ষম রাখে এবং জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে- তাই অক্সিজেন ও খাদ্য গ্রহণ ব্যতিরেকে মানুষ বাঁচতে পারে না।
একটি মোটর গাড়ি সচল ও কর্মক্ষম রাখতে হলে আমাদের প্রধানত : যেসব জিনিস লাগে তা হলো :
১. গাড়ির বডি ২. ইঞ্জিনসমূহ ৩. কার্যসূচি (Program) ৪. চালক (Driver) ৫. খাদ্য (Fuel) ৬. গ্রহণ বর্জন প্রণালী (Input output system) ৭. চাবি বা যা দিয়ে চালু করা হয় (Starter)।
ঠিক তেমনি মানুষও প্রধানত : এই কয়টি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত :
১. মানুষের দেহ গাড়ির বডির মতো, ২ ও ৩. মানুষের দেহের ভেতর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হলো গাড়ির ইঞ্জিনের মতো- যা প্রোগ্রাম করা এবং প্রত্যেক অঙ্গগুলোর প্রোগ্রামের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ ও সমন্বয় আছে; ৪. মানুষের আত্মা হলো তাই যা গাড়ির চালক করে থাকে; ৫. অক্সিজেন ও খাদ্য যেমন মানুষের শক্তির জোগান দেয় প্রাণ/জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে, তেমনি জ্বালানি গাড়িকে সচল ও কর্মক্ষম রাখে, জ্বালানি (Fuel) ছাড়া গাড়ি অচল; ৬. মানুষ মুখ ও নাকের মাধ্যমে খাদ্য গ্রহণ (Input) করে এবং প্রস্রাব পায়খানার মাধ্যমে বর্জ্য ত্যাগ (Output) করে যেমন গাড়ির তেল টাংকির ভেতর জ্বালানি নেয় এবং সাইলেন্সার পাইপের মাধ্যমে বর্জ্য ত্যাগ করে; ৭. মাতৃগর্ভে মানুষের সব কিছু তৈরি হওয়ার পর সৃষ্টিকর্তা চাবি (Stater) দিয়ে চালু করে দিয়েছেন, চালু অবস্থায় মানুষ মায়ের পেট থেকে দুনিয়ায় আসে, যেমন আমরা গাড়ি চাবি দিয়ে চালু (Start) করি।
মানুষের গঠন, প্রাণ ও আত্মা সম্পর্কে নিম্নের উদাহরণগুলো বিষয়টি আরো স্পষ্ট করবে :
১৯৫১ সালের ২৯ জানুয়ারি আমেরিকার বাল্টিমোরের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রোগাক্রান্ত হয়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ভর্তি হন তার নাম ছিল হেনরিয়েটা ল্যাকস। পরীক্ষায় ধরা পরলো তার জরায়ুতে কান্সার হয়েছে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী জন গে গবেষণার জন্য ওই মহিলার কান্সার আক্রান্ত কোষের দু’টি নমুনা সংগ্রহ করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো অন্যান্য কান্সার আক্রান্ত কোষ গবেষণাগারে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত জীবন্ত থাকত; কিন্তু হেনরিয়েটা ল্যাকসের সংগ্রহিত কোষ বিভাজিত হয়ে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে এবং আজোবধি তা টিকে আছে। হেনরিয়েটার ল্যাকসের নামের প্রথম ও শেষ অংশ হতে এর কোষের নামকরণ করা হয়েছে, ‘হেলা কোষ’ (Hela cell)। এই হেলা কোষ জীব বিজ্ঞানে অবিস্মরণীয় বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। আমরা জানি মরণোত্তর অঙ্গদান করা যায়- হার্ট, কিডনি, ফুসফুস, যকৃৎ, চক্ষু ইত্যাদি। একজন সুস্থ ব্যক্তির মৃত্যুর পরপরই তার অঙ্গ বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে তা অসুস্থ রোগির দেহে প্রতিস্থাপন করলে তা পূর্বের মতো কাজ করে এবং অসুস্থ রোগী অন্যের অঙ্গ নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠে। মানুষের মৃত্যুর পর ৩০ মিনিট বা আরো কিছু বেশি সময়ের মধ্যে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর প্রাণ সচল থাকে, সে সময়ের মধ্যে তা সংগ্রহ করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করলে তা প্রায় সপ্তাহাধিক পর্যন্ত সজীব থাকে।
উপরের আলোচনায় মাধ্যমে প্রাণ ও আত্মার পার্থক্য আমরা বুঝতে সক্ষম হবো; মানুষের দেহের প্রত্যেক অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রাণ/জীবন আছে, যেমন উদাহরণ হিসেবে পেলাম হেলা কোষ এবং মরণোত্তর অঙ্গদানের মাধ্যমে। প্রাণ/জীবন বেঁচে থাকে মৃত্যুর পরও বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং তা জীবন্ত থাকে তার ভিতর বিদ্যুৎ প্রবাহ চলমান থাকার কারণেই এবং আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি প্রত্যেকটি অঙ্গ আলাদাভাবে প্রোগ্রাম করা তাই দানকৃত অঙ্গ একই কাজ করে যা পূর্বে করেছিল যেমন চক্ষু দেখার কাজই করে, কিডনি কিডনির কাজ করে মানে দেহ পরিষ্কারের কাজ করে।
মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন কোষের দ্বারা গঠিত যা মানুষের প্রাণ/জীবনের মৌলিক একক। আমরা নাকের শ্বাস ও মুখের দ্বারা খাদ্য গ্রহন করি- যা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দেহ কোষের জীবন সচল জীবন্ত রাখতে কাজ করে এবং বিদ্যুৎ প্রবাহের মাধ্যমে তা সরবরাহ করা হয়ে থাকে- যা ওয়েট সেল (Wet cell) ব্যাটারির সাথে তুলনীয় এবং মানবদেহের ভেতর এই ওয়েট সেল ব্যাটারির মতো বিদ্যুৎ প্রবাহকেই আমরা আত্মা বলতে পারি। সচারচর আমরা দেখি পাওয়ার হাউজে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়ে তা তারের মাধ্যমে আবাসিক বাড়িগুলো এবং অফিস আদালত কারখানাতে সরবরাহ করা হয়;
ঠিক তেমনি মানবদেহের হার্ট নামক পাওয়ার হাউজে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়ে বিভিন্ন রক্তনালীর মাধ্যমে তা সারা শরীরে সরবরাহ হয়ে থাকে।
প্রথম পর্বে আমরা জেনেছি আত্মার একটা অশরীরী অবয়ব আছে- যা আমরা দেখি না যেমন আমরা জ্বিন জাতিকে দেখি না, ফেরেশতাদের দেখি না; কিন্তু তাদের একটা অবয়ব আছে; তেমনি মানুষের আত্মার একটা অশরীরী অবয়ব আছে- যা যার যার দেহাকৃতির মতোই। ওয়েট সেল বা ড্রাই সেল ব্যাটারির প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট আকৃতি, শক্তি, কার্যক্ষমতা, স্থায়িত্ব নির্ধারিত আছে তেমনি আত্মা ও দেহাকৃতির মধ্যেই মানুষের শক্তি কার্যক্ষমতা, জীবন মরণ নির্ধারণ করা আছে।
আত্মা ছাড়া কোনো প্রাণই নিজ হতে সচল বা কার্যক্রম চালাতে পারে না; তাই আত্মার সাথে তুলনীয় এই দৃশ্যমান বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে কোনো কিছুই নেই। মানুষ যে রোবট তৈরি করেছে- তা মানুষের নির্দেশেই চালু হয়।
তাই কুরআনের ওই আয়াতটি এখানে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য : সূরা বনী ইসরাঈলের ৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, রূহ হলো- আমার পালনকর্তার নির্দেশ ঘটিত। এ বিষয়ে তোমাদেরকে সামান্য জ্ঞানই দেওয়া হয়েছে’। তবে এটুকু বলা যায়, আমরা রোবটকে সচল হওয়ার জন্য নির্দেশ করলে যেমন সে চালু হয় এবং যখন তা বন্ধ করার নির্দেশ দেয় তখন তা অচল হয়। আর একটি কথা হলো- আত্মা ও প্রাণ মানুষের দেহে পরিপূরক ও সমন্বিতভাবে কাজ করে থাকে- একটার অবর্তমানে অন্যটি অক্ষম প্রতিপণ্য হয়।
আত্মা ও প্রাণ নিয়ে দু’টি পর্বে যে আলোচনা করলাম তাতে আশা করি আপনারা এদের মধ্যে পার্থক্য ও সম্পর্ক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন এবং এ যাবৎকালে যত সংশয় বা জিজ্ঞাসা ছিল এ নিয়ে তার অধিকাংশের একটা পরিষ্কার উত্তর পেয়েছেন ইনশা আল্লাহ।
পরিশেষে কুরআনের একটি বক্তব্যের মাধ্যমে আমার লেখার ইতি টানবো। সূরা মূলকে দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ উল্লেখ করেছেন, ‘তিনিই সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যেন পরীক্ষা করতে পারেন তোমাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম এবং তিনি পরাক্রম ক্ষমতাবান ও পুনঃ পুনঃ ক্ষমাশীল।
সমাপ্ত।
নিউইয়র্ক।