প্রার্থী আধিক্যে সংকটে আ’লীগ

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও এলডিপিসহ বিভিন্ন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থী রয়েছেন অন্তত ১০ জন। আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য চারজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক বর্তমান ড. হাছান মাহমুদ। আগামী নির্বাচনেও নৌকার মাঝি হওয়ার লক্ষ্যে জোর প্রচার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন এই নেতা।

অন্য দিকে বিএনপিতে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের সদস্যরা। তাদের মধ্যে রয়েছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর স্ত্রী ফরহাত কাদের চৌধুরী ও ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী। তবে তাদের বহিরাগত হিসেবে আখ্যায়িত করে স্থানীয় কাউকেই প্রার্থী করাতে তৎপর রয়েছে বিএনপির এক পক্ষ।

আওয়ামী লীগে ড. হাছান মাহমুদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মনোনয়ন পেতে আটঘাট বেঁধে মাঠে রয়েছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সহসভাপতি ওসমান গণি চৌধুরী, উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী শাহ এবং আবুধাবী প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতা ইফতেখার হোসেন বাবুল।

সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে নির্বাচনী মাঠে তৎপর রয়েছেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা বিএনপির একাংশের আহ্বায়ক অধ্যাপক কুতুব উদ্দিন বাহার, যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আহমেদ হাসনাত। তারা বিএনপির আসলাম চৌধুরী সমর্থিত গ্রুপের অনুসারী। গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর গ্রুপ থেকে মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন উপজেলা বিএনপির অপরাংশের আহ্বায়ক শওকত আলী নুর ও সদস্য সচিব অধ্যাপক মোহাম্মদ মহসিন।

রাঙ্গুনিয়া থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম। লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি) থেকে প্রার্থী হতে মরিয়া হয়ে আছেন পার্টির উত্তর জেলার সভাপতি নুরুল আলম। এ ছাড়াও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন ইসলামী ঐক্যজোট একাংশের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মুফতি মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ।

গত নির্বাচনে রাঙ্গুনিয়া থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ড. হাছান মাহমুদ। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও হেভিওয়েট প্রার্থী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করেন তিনি। ওই মেয়াদে বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন হাসান মাহমুদ। এ আসনে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে নির্বাচিত হন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় জোটের মনোনয়নে নির্বাচিত হন কমিউনিস্ট পার্টির মোহাম্মদ ইউসুফ। জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনে ১৯৮৬ সালে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং ১৯৮৮ সালে নজরুল ইসলাম নির্বাচিত হন।নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, রাঙ্গুনিয়ায় এককভাবে কোনো রাজনৈতিক দলেরই দীর্ঘ আধিপত্য ছিল না। তবে সর্বশেষ দুই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হওয়ায় তারা অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন।

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, বিএনপির সাবেক এমপি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদ-ে দ-িত হওয়ার পর স্থানীয় বিএনপিতে নেতৃত্ব শূন্যতার পাশাপাশি নৈতিক পরাজয়ও ঘটেছে। স্থানীয় বিএনপি একাধিক গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পাল্টাপাল্টি কমিটি গঠন করে রেখেছে। গত ৯ বছরে তারা সাংগঠনিক কোনো কর্মসূচিও ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করতে পারেনি। অন্য দিকে ড. হাছান মাহমুদ বর্তমান মন্ত্রিসভায় স্থান না পেলেও বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদে রয়েছেন। তিনি এমপি হওয়ার পর নির্বাচনী এলাকায় আড়াই হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করেছেন। পাইপলাইনে রয়েছে আরও ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকার প্রকল্প।

এ প্রসঙ্গে ড হাছান মাহমুদ বলেন, রাঙ্গুনিয়ায় গত দুই মেয়াদে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা স্বাধীনতার পর কখনোই হয়নি। উন্নয়ন ও শান্তির স্বার্থে রাঙ্গুনিয়ার মানুষ তাই নৌকার ওপর আবারও আস্থা রাখবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সুযোগ দিলে তিনি রাঙ্গুনিয়ায় নৌকা প্রতীকের হ্যাটট্রিক বিজয় উপহার দেবেন। বর্তমান এই এমপি জানান, রাঙ্গুনিয়ার প্রতিটি ঘরে তিনি উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিয়েছেন। দুই হাজার লোকের চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের প্রথম শেখ রাসেল এভিয়ারি পার্ক ও ক্যাবল কারের উন্নয়নে আরও ১৩০ কোটি টাকার প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও অর্থায়নে রাঙ্গুনিয়ার প্রতিটি ইউনিয়নে দরিদ্র কৃষকদের একটি করে পাওয়ার টিলার ও ১৫০টি রিকশা ভ্যানও দিয়েছেন তিনি। চার হাজার পরিবারকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেওয়া হয়েছে টিন। আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন মাধ্যমের সহায়তায় ১৫টি মসজিদ ভবন নির্মিত হয়েছে।

এ বি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওসমান গণি চৌধুরী বলেন, তার বাবা ওবায়দুর রহমান চৌধুরী রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সহসভাপতি ছিলেন। তার বড় ভাই এম সাদেক চৌধুরী ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সামান্য ভোটে হারেন। তাও দলের কিছু লোকের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের বেলায় তাদের পরিবারের ঐতিহ্যের ওপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আস্থা রাখবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী শাহ বলেন, সাবেক মন্ত্রী হিসেবে রাঙ্গুনিয়াতে মনোনয়ন পাওয়ার কথা বর্তমান এমপি ড. হাছান মাহমুদের। তবে কোনো কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আস্থা রাখলে তিনি নিজেও নির্বাচন করতে প্রস্তুত রয়েছেন। তার মতে, রাঙ্গুনিয়ায় কার অবস্থান কেমন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সেসবের খবর ভালোভাবেই জানেন। তা ছাড়া মাঠপর্যায়ে জরিপ করেই তিনি দলীয় মনোনয়ন ঠিক করবেন।

ইফতেখার হোসেন বাবুল আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেলে বিজয়ী হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। এ দিকে রাঙ্গুনিয়ার হারানো আসন পুনরুদ্ধার করতে চাইছে বিএনপি। তাদের মতে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ায় ২০০৮ সালে এ আসনে বিজয়ী হয়েছে নৌকা। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশই নেয়নি। বিএনপির কেন্দ্রীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে হামলা, স্থানীয় আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করে রাখাসহ বর্তমান এমপির সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকা-ে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। সন্ত্রাসী ও খুনের মামলার আসামিদের সঙ্গে ড. হাছান মাহমুদের সুসম্পর্ক থাকায় রাঙ্গুনিয়াতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় খারাপ। বিএনপির বিশ্বাস, নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে আগামী নির্বাচনে রাঙ্গুনিয়াবাসী এসবের জবাব দেবে।

এ প্রসঙ্গে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, রাঙ্গুনিয়ায় তাদের পরিবারের বিজয়ের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। রাঙ্গুনিয়ার মাটি বিএনপির ঘাঁটি। তাদের পরিবারের প্রতিও আলাদা ভালোবাসা আছে জনগণের। নির্বাচন যদি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়, তবে কেউ এ আসনে ধানের শীষের বিজয় ঠেকাতে পারবে না।

রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপি থেকে আরও অনেকেই মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। স্থানীয় রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে থাকা এমন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মনে করেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবার এখানকার দলীয় ক্ষেত্রে বহিরাগত। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হলে রাঙ্গুনিয়াতে ঘরের ছেলের ওপরই আস্থা রাখতে হবে বলে মনে করছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে মনোনয়নপ্রত্যাশী শওকত আলী নুর বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে রাঙ্গুনিয়ায় জয় পাবে বিএনপি। এ আসনে আওয়ামী লীগকে হারাতে হলে দরকার হবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের ইমেজ। তিনি বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক কিছুই বিবেচনা করবেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কোনো কারণে তার ওপর আস্থা রাখা হলে তিনি নির্বাচন করতে প্রস্তুত রয়েছেন।

তবে ভিন্নমত পোষণ করে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আহমেদ হাসনাত বলেন, ভোটাররা আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের জবাব দিতে মুখিয়ে আছে। তবে এ আসনে বহিরাগত কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে ঘরের ছেলেকে প্রার্থী করলে এগিয়ে থাকবে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আস্থা রাখলে নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানান তিনি।অধ্যাপক কুতুব উদ্দিন বাহার বলেন, রাঙ্গুনিয়ায় উন্নয়নের নামে হরিলুট হয়েছে। বিরোধী মতকে নিঃশেষ করতে সব অস্ত্রই ব্যবহার করেছেন বর্তমান এমপি। জনগণ ভোট দেওয়ার সুযোগ পেলে এসব অপকর্মের জবাব দেবে। তিনি বলেন, দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চাইলে নির্বাচন করার প্রস্তুতি রয়েছে তার।

অধ্যাপক মোহাম্মদ মহসিন বলেন, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবারের যে কাউকে সাদরে গ্রহণ করবে রাঙ্গুনিয়াবাসী। কোনো কারণে তারা নির্বাচন না করলে বিকল্প নির্ধারণ করবেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেই ক্ষেত্রে তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত রয়েছেন।

রাঙ্গুনিয়া থেকে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন চাইবেন সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম। এ লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তিনি। জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী এই নেতা মনে করেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ব্যানারে নির্বাচন হলে তার এই প্রত্যাশার সত্যতা শতভাগ নিশ্চিত হতে পারে। অবশ্য তা না হলেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন তিনি।

এলডিপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী নুরুল আলম বলেন, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে আছে এলডিপি। আর আগামী নির্বাচনে জোটে প্রার্থিতার জন্য তাদের দলের পক্ষ থেকে যে প্রার্থী তালিকা দেওয়া হয়েছে, তাতে এ আসনে তার নাম আছে। তাই তিনিও নির্বাচনী তৎপরতা শুরু করেছেন।