প্রিন্ট কপির গুরুত্ব আজীবন থাকবে

নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী :

কালের পরিক্রমায় সংবাদপত্র প্রকাশ ও পড়ার মাধ্যমের ক্ষেত্রে নতুন নতুন পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে একসময় কেবল প্রিন্ট মাধ্যমে সংবাদপত্র পড়ার সুযোগ থাকলেও কয়েক বছর ধরে ডিজিটাল মাধ্যমে অনলাইনের সুবাদে এটি ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, মোবাইল ডিভাইস, আইপ্যাডসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পড়ার সুযোগ হয়েছে। এখন বিভিন্ন সংবাদপত্র তাদের নিজস্ব অ্যাপও চালু করেছে। দিন যত যাচ্ছে ততই এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ অনলাইন নিউজ পোর্টাল করার পাশাপাশি ই-পেপার ও ই-ভার্সন চালু করেছে। এখন আবার কোনো কোনো পত্রিকা অনলাইন সংস্করণের ভেতরেই ভিজ্যুয়ালি খবরও প্রকাশ ও প্রচার করছে। এত কিছু দেওয়ার পরও একজন পাঠকের প্রতিদিন ভোরে সংবাদপত্র হাতে নিয়ে পড়ার যে চাহিদা ও আগ্রহ, তা রয়েই গেছে। যারা সংবাদপত্রের একনিষ্ঠ পাঠক ও ভক্ত, তারা সব মিডিয়াতে খবর পড়লেও এবং টেলিভিশনে নিউজ বা সংবাদ দেখলেও সংবাদপত্র পড়ার আকাক্সক্ষা তাদের রয়েই যায়। সে কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রগুলো অনলাইন ভার্সন করলেও তাদের প্রিন্ট ভার্সন চালু রেখেছে। এ কারণে এটা স্পষ্ট, সংবাদ প্রকাশে নতুন নতুন মাধ্যম যোগ হলেও প্রিন্ট কপির গুরুত্ব রয়ে গেছে এবং তা থাকবে আজীবন।

বাংলাদেশে সংবাদপত্র ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। বেশির ভাগ পত্রিকা অনলাইন সংস্করণ করেছে। সবকিছুর পরও একটি বিশেষ অনুভূতি হচ্ছে সংবাদপত্র হাতে নিয়ে পড়া। অনলাইনে কোনো খবর মিস করার শঙ্কা থাকলেও পত্রিকা হাতে নিলে সেখানে সব হেডলাইন চোখে পড়ে। একটি সংবাদপত্রে মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার মতো অনেক খবর, ফিচার, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ছড়া, গবেষণাপত্র, বিজ্ঞাপনসহ বিভিন্ন কিছু থাকে। কোনো পাঠককে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, সংবাদপত্র তিনি কেন পড়েন? সোজা উত্তর সংবাদপত্র থেকে অনেক কিছু শেখার ও জানার আছে। জীবনের পরিকল্পনা করার ও পরিকল্পনা পরিবর্তন করারও যথেষ্ট উপাদান থাকে। এ কারণে সংবাদপত্র পড়ার গুরুত্ব অনেক। প্রিন্ট সংবাদপত্র কেবল একদিনের জন্য নয়, এটি আজীবনের।

কারণ, লাইব্রেরিতে এটি সংরক্ষণ করা হয়, যা আজীবন থেকে যায়। অনলাইন সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় প্রয়োজনীয় একটি খবরের লিঙ্ক চাইলে সব সময় ওপেন হয় না। আবার কোনো কোনো সময় অনলাইনের ওয়েবসাইটে সমস্যা হলে আগের সবকিছু ফেরত পাওয়া যায় না। ডিজিটালি অনেক সুবিধার পাশাপাশি এটি একটি অসুবিধাও বটে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই, একজন গবেষক চিন্তা করছেন তিনি একটি বিষয়ের ওপর গবেষণা করবেন। এই গবেষণার কাজে বই, প্রত্যক্ষদর্শী, কিংবা সংশ্লিষ্ট যেসব সংস্থা কিংবা ব্যক্তি আছেন, তারা জীবিত থাকলে সহায়তা পাবেন। কিন্তু কেউ যদি নাও থাকেন, এমন কোনো তথ্যও প্রয়োজন হলে সেটি শত শত বছরের পুরোনো সংবাদপত্রের সেই সময়কার কপিতে পাওয়া যায়। যা কেবল একজন নয়, যত মানুষের প্রয়োজন তারা গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে পারবেন বা পারছেন। আগামী দিনেও যখন ৫০ থেকে ১০০ বছর কিংবা এর বেশি দিন পর কোনো বিষয় নিয়ে গবেষণা হবে, সে বিষয়ে সংবাদপত্র একটি উপাদান হিসেবে বড় ভূমিকা রাখবে। কিন্তু এখনকার অনলাইন সংস্করণ ২০০ বছর থাকবে কি না সেটি এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

পাঠকেরা অনলাইন সংস্করণে অভ্যস্ত হচ্ছেন, এটা সত্য। কিন্তু এখনো এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা প্রিন্ট কপি পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তাদের বক্তব্য, অনলাইনে পেপার পড়লে পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ার যে শান্তি, তা পাওয়া যায় না। এ কারণে হাতে নিয়েই পত্রিকা পড়তে চাই। চা কিংবা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে সকালবেলা সংবাদপত্র পড়ার অনুভূতিটা প্রবাসেও পাওয়া যায়। ঠিকানার একজন গ্রাহক বলেন, সংবাদপত্র হাতে নিয়ে পড়ার মজাই আলাদা। বিদেশে বসেও বাংলা সংবাদপত্রের প্রিন্ট কপি পড়তে পারছি, এটি অনেক বড় বিষয়। ডাক বিভাগের কারণে মাঝে মাঝে ঠিকানা পত্রিকা দেরিতে পৌঁছালে অনেক গ্রাহক অস্থির হয়ে ওঠেন। তারা অফিসে ফোন করেন। এ ধরনের এক গ্রাহক বলেন, আমি শুক্রবার থেকে পেপারের জন্য অপেক্ষা করি।

বাসার নিচে গিয়ে বারবার খবর নিই পেপার এল কি না। এলে খুব ভালো লাগে। মনে হয়, অনেক মূল্যবান কিছু পেলাম। আর পত্রিকা না এলে মন খারাপ করে আবার বাসার ওপরে চলে যাই। ঠিকানা অফিসে ফোন করি। কেন দেরি হচ্ছে জানতে চাই। যদিও জানি, ডাক বিভাগ পৌঁছাতে দেরি করলে তাদের কিছু করার নেই, কিন্তু মন মানে না। আরও এক পাঠক বলেন, মায়ের জন্য ঠিকানা পত্রিকা নিতে চান তিনি। তার মা আউট স্টেটে থাকেন। বয়স্ক মানুষ, সব সময় ঘরেই থাকেন। দূরে কোথাও একা একা যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে নিত্যদিনের কাজের পর একাকী সময় কাটান। নিসঃঙ্গতা কাটানোর জন্য পেপার পড়ে সময় কাটাতে চান। অনলাইনে পেপার পড়ার সুবিধা আছে বলার পর তিনি অনলাইনে পেপার পড়তে রাজি নন। তিনি হার্ড কপি পড়তে চান। এ ব্যাপারে ওই গ্রাহক বলেন, আমার মায়ের জন্য পেপার নিচ্ছি, কারণ তিনি যাতে ভালো সময় কাটাতে পারেন। পত্রিকা পড়লে তিনি ভালো থাকেন। আরো এক পাঠক বলেন, আমি অনলাইনে পত্রিকা পড়ি কিন্তু আমার মা-বাবার প্রিন্ট পেপারই পছন্দ। এই পেপার পড়ে তারা শান্তি পান। এ ছাড়া অনেক গ্রাহক মনে করেন, ঠিকানা তাদেরকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে। ঠিকানার মাধ্যমে নানা খবর জানার পাশাপাশি এর বিজ্ঞাপন দেখে তারা প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সেবা নেওয়ার সুযোগ পান।

প্রবাসে যারা নতুন ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আসেন, তাদের জন্য এখানকার সংবাদপত্র একটি বড় ভূমিকা পালন করে। নিউইয়র্ক থেকে বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয়। এখানে প্রতি সপ্তাহে পত্রিকার প্রিন্ট কপি প্রকাশ করার কাজটি অনেক কঠিন, এর পরও সংবাদপত্র মালিকেরা তা করে যাচ্ছেন। পত্রিকা প্রকাশ করা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, অন্যদিকে বিজ্ঞাপনের বাজারও ছোট, বিজ্ঞাপনের প্রতিযোগিতাও রয়েছে। সব মিলিয়ে একটি সংবাদপত্রকে টিকিয়ে রাখতে কঠিন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। নিউইয়র্কের পত্রিকাগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে পুরোনো ও মানসম্মত পত্রিকা ঠিকানা। দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে ঠিকানা প্রবাসীদের নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ঠিকানার মাধ্যমে প্রবাসীরা জানতে পারছেন কোথায় বাসা ভাড়া বা রুম ভাড়া নেওয়া যাবে। চাকরির তথ্যও পাচ্ছেন পাঠক। নিজের পছন্দের ডাক্তার বাছাই করতে পারছেন। ঠিকানার বিজ্ঞাপন পড়ে সিপিএ কিংবা এনরোল এজেন্ট নিয়োগ করতে পারছেন। বাসা বদল করবেন লোক নেই, মুভার পেতে সহযোগিতা পাচ্ছেন।

আইনি সহায়তার জন্য আইনজীবী দরকার, সেটিও পাচ্ছেন। এ ছাড়া ডিএন টেস্ট করানো প্রয়োজন, কোথায় যাবেন জানা নই, তার খবরও আছে ঠিকানার পাতায়। ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে চান, বিভিন্ন বিষয়ের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন, তাও আছে। টিএলসি লাইসেন্স নিতে চাইছেন, সেই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনও আছে। নতুন এসে বাচ্চারা ইংরেজি কম জানার কারণে স্কুলে ও কলেজে খাপ খাইয়ে উঠতে পারছে না, পরীক্ষায় ভালো করা প্রয়োজন, সে জন্য টিউটোরিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনও আছে। বাড়ি কেনার জন্য রিয়েলটর কিংবা মর্টগেজ ব্যাংকার দরকার, তাও আছে। বাড়ি রেনোভেশন করা প্রয়োজন, তাও আছে। হোমকেয়ার দরকার, তাও আছে। সুপার মার্কেটে এখন বাজারে জিনিসের দাম কেমন, সেটাও জানা যাচ্ছে, ওমরা কিংবা হজে যাবেন অথবা দেশে যাওয়ার টিকিট কিনবেন, এজেন্সির নাম-ঠিকানাও রয়েছে। অর্থাৎ একটি ইমিগ্র্যান্ট পরিবারের বা এখানে যারাই আছেন তাদের প্রায় সব রকম প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানের তথ্য সরবরাহ করছে ঠিকানা।

এদিকে ডিসপ্লে বিজ্ঞাপন ছাড়াও ক্ল্যাসিফায়েড বিজ্ঞাপন আছে। ক্ল্যাসিফায়েড বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যার বাসাবাড়ি, রুম, রুমমেট দরকার, তা খুঁজে নিচ্ছেন। বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াও পাচ্ছেন। ভাড়াটিয়া যেমন নিজের থাকার জায়গা খুঁজে নিচ্ছেন, বাড়িওয়ালারাও বাড়িভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। অন্যদিকে কোনো প্রতিষ্ঠানের লোক আবশ্যক হলে ঠিকানায় বিজ্ঞাপন দিয়ে লোক খুঁজে পাচ্ছেন। এতে একদিকে যেমন বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা স্টাফ খুঁজে নিয়ে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটাচ্ছেন। কমিউনিটির ব্যবসাও বাড়ছে। অনেকেরই পাত্র-পাত্রী অবশ্যক, এটাও ঠিকানার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অনেকেই পেয়ে যাচ্ছেন।

সবচেয়ে বড় কথা হলো কেউ বাড়ি রিনোভেশন করতে চান, ইলেকট্রিক সিস্টেম, এয়ার কন্ডিশন সিস্টেম করতে চান, তাহলে সেটিও করতে পারেন। কেউ যদি মনে করেন, তিনি তার জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করার জন্য কোনো কোর্সের প্রশিক্ষণ নিতে চান, সেটারও খোঁজ পাচ্ছেন। ড্রাইভিং শেখা, আইটি ও কম্পউটারের বিভিন্ন বিষয়ে জানা, চিকিৎসক বা আইনজীবী প্রয়োজন, ল্যাব দরকার অর্থাৎ যত রকম যা কিছু দরকার, তার সবই ঠিকানা পত্রিকার মাধ্যমে খুঁজে পেতে পারেন। ঠিকানায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় কমিউনিটির সংবাদগুলো। কমিউনিটির নিত্যদিনের সব রকম প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার চেষ্টা করে পত্রিকাটি। পাশাপাশি দেশ-বিদেশের খবরও থাকে।

ঠিকানা প্রতি বুধবার বাজারে আসে। পত্রিকাটি সাত দিনের জন্য প্রকাশ করা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম দিনই শেষ হয়ে যায়। সেটি বিভিন্ন গ্রোসারি শপ, রেস্টুরেন্ট ও মসজিদে রাখা হয়। সেখান থেকে পাঠক সংগ্রহ করেন। ৩৩ পেরিয়ে ঠিকানা ৩৪-এ পদার্পণ করেছে। এ উপলক্ষে পাঠকসহ সবাইকে শুভেচ্ছা।

লেখক : সাংবাদিক ও ম্যানেজিং এডিটর, ঠিকানা।