বাহারুল আলম
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তিনদিন পর, ৭ নভেম্বর, দুপুরে অবশেষে সব অনিশ্চয়তা ও জল্পনা-কল্পনায় অবসান ঘটিয়ে সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়। পেনসেলভিনিয়া রাজ্যের ২০টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট এদিন তার ঘরে জমা হওয়ায় তার প্রাপ্ত ভোটসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ২৯৩। ট্রাম্প পান ২১৩ ভোট। প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় ২৭০টি ভোটের। এবারের নির্বাচনে মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেছে, সে রকমটি এর আগে কখনো লক্ষ্য করা যায়নি।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে মার্কিন ইতিহাসে এবারই প্রথম ডাকযোগে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ভোটকেন্দ্রে অতিরিক্ত ভিড় পরিহারপূর্বক সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মানুষ যাতে ভোট দিতে পারে, সে উদ্দেশ্যে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ডাকযোগে ভোট, মেইল ইন ব্যালট, ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য ব্লু স্টেটে ইউনিভার্সাল মেইল-ইন-ব্যালট অপারেশনের আওতায় সংশ্লিষ্ট স্টেটের সব ভোটারের কাছে আগাম ব্যালট পেপার পাঠানো হয়। এতে করে বহু ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ঝক্কি থেকে রেহাই পান। যারা আগে কখনো ভোট দেননি, তারাও এ ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে এবার ভোট প্রদানে সক্ষম হন। তাছাড়া বহু স্টেটে আর্লি ভোটদানের জন্য বহু ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এর ফলে ৩ নভেম্বর ভোটের নির্ধারিত দিনের পূর্বেই বহু মানুষ ভোটদানে সক্ষম হন। আমি নিজেও আমার বাসস্থানের নিকটবর্তী এক ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ২৪ অক্টোবর ভোট দেই। স্বাভাবিকভাবেই এসব কারণে এবারে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এতো বিপুল সংখ্যক ভোট গণনার কাজ সংশ্লিষ্ট স্টেটের বোর্ড অব ইলেকশন্সের জন্য এক বিরাট কর্মযজ্ঞ হয়ে দাঁড়ায়। যে কারণে নির্বাচনের দুদিন পরেও বেশ কয়েকটি স্টেটে ভোট গণনার কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন করা যায়নি। এতে করে এসব স্টেটের ভোটের ফল পেতে বিলম্বের কারণে কোন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন, তা ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের রাতে নির্বাচনে বিজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বা ক্রিটিক্যাল কয়েকটি স্টেটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ভোটের হিসাবে এগিয়ে থাকতে দেখা যায়। এসব স্টেট হলো- মিশিগান, উইসকনসিন, জর্জিয়া, পেনসেলভিনিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা ও অ্যারিজিনো। ফলাফলের এ অবস্থা দেখে ট্রাম্প মধ্যরাতের কিছু পর হোয়াইট হাউজের ইস্ট রুমে এসে নিজ পরিবারের সদস্য ও কিছুসংখ্যক সমর্থকের এক সমাবেশ নিজেকে নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হওয়ার ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে তখন পর্যন্ত গণনা হয়নি এমন বিপুলসংখ্যক ভোট গণনা বন্ধের দাবি জানিয়ে তাকে বিজয়ী ঘোষণার আহ্বান জানান। এ ধরণের ভোট গণনার মাধ্যমে তার নির্বাচনী বিজয়কে চুরির চেষ্টা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ভোট গণনা বন্ধের জন্য তার দাবি মানা না হলে তিনি সুপ্রিমকোর্টে যাওয়ার হুমকি দেন। সুপ্রিমকোর্টে রিপাবলিকান সমর্থক বিচারপতির সংখ্যাধিক্য থাকলেও ভোট গণনা বন্ধে ট্রাম্প তাদের সমর্থন পাবেন, সেটা জোর করে বলা যায় না। ভোটের মতো মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অবদমনে কোনো বিচারপতি সায় দেবেন বলে মনে হয় না।
অপরদিকে বাইডেন এক বিবৃতিতে প্রতিটি ভোট গণনার উপর জোর দেন এবং সব ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করবেন না বলে জানান। ভোট গণনা অব্যাহত থাকা অব্যাহত পরে দেখা যায় বাইডেন নর্থ ক্যারোলাইন ছাড়া অন্য সব স্টেটে ভোটের হিসাবে এগিয়ে গেছেন। অবস্থা খারাপ দেখে ট্রাম্পের আইনজীবীরা মিশিগানে ভোট পুনর্গনার আবেদন নিয়ে আদালতে যান। জর্জিয়া, পেনসেলভিনিয়া ও অ্যারিজোনাতেও অনুরূপ আবেদন জানানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সাধারণত দু’জন প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান ১% বা তার কম হলে ভোট পুনর্গণার নিয়ম রয়েছে। তবে এসব ক্ষেত্রে ভোটের ব্যবধান কয়েক হাজার হওয়ায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফলের ইতরবিশেষ হবে বলে মনে হয় না।
নির্বাচনের বেশ কয়েকদিন পূর্ব থেকে ট্রাম্প যে বিপুল উদ্যামে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেন, তা দেখে অনেকের মধ্যে ধারণা জন্মে যে, ট্রাম্প হয়তো নির্বাচনে জয়ী হয়েও যেতে পারেন। তার প্রতিটি জনসভায় ২০/৩০ হাজার মানুষ যোগ দেয়, যাদের অধিকাংশ মাস্ক পড়েননি এবং সভাস্থলে সামাজিক দূরত্ববিধি পালনেরতো কোনো বালাই-ই ছিল না।
অপরদিকে বাইডেন বেশ কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর নির্বাচনের কয়েকদিন পূর্বে সক্রিয় হন। যদিও তার সমাবেশগুলোতে কোভিড পরিস্থিতির কারণে লোক সমাগম সীমিত রাখা হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা বাইডেনের সমর্থনে একাধিক সভায় বক্তব্য রাখেন। জনসভার আকার নয়, বরং প্রার্থীর প্রজ্ঞা ও ইস্যুই যে নির্বাচনের বিজয়ী হওয়ার মূল নিয়ামক, এবারের নির্বাচন সেটাই প্রমাণ করেছে।
কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিতি মোকাবেলায় ট্রাম্পের সীমাহীন ব্যর্থতা ও এর পরিণতিতে বিপুল মানুষের মৃত্যু ও ভোগান্তি তার নেতৃত্বর কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ট্রাম্পের খামখেয়ালীপনার জন্য কেবল মার্কিন নাগরিকই নন, তিনি নিজেসহ তার স্ত্রী-পুত্র এবং হোয়াইট হাউজের কমবেশি ৩৫জন কর্মকর্তা-কর্মচারি কোভিড-আক্রান্ত হয়েছেন, যার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছেন হোয়াইট হাউজের চিফ অব স্টাফ মার্কমেডোজ। এর আগে অন্যান্যের মধ্যে প্রেস সেক্রেটারি কেলি মাকানেনি ও উপদেষ্টা কেলি অ্যান কনওয়ে কোভিড আক্রান্ত হন। নির্বাচনের আগের কয়েকদিনে প্রতিদিন গড়ে ৮০ হাজারের বেশি মানুষ কোভিড আক্রান্ত হলেও ট্রাম্প যেভাবে কোভিড পরিস্থিতি অনেকটাই সামলে এনেছেন বলে দাবি করেন, তা বহু মানুষের কাছে নির্জলা অসত্য তথা পরিহাসমূলক বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুকে তিনি যে রকম সহজভাবে নেন, সেটাও মানুষের ভালো লাগেনি। মানুষের মৃত্যুকে তিনি যা হবার তাই হয়েছে (ইট ইজ হোয়াট ইট ইজ) বলে উল্লেখ করেন। তিনি ডা. ফাউসি, ডা. ডেব্রা বার্কসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ইডিয়ট ইত্যাদি বলে গালাগাল করেন এবং বহু সম্মানীয় ব্যক্তি, যারা সমালোচনা করে বক্তব্য দেন তাদেরকে, তিনি যাচ্ছেতাই ভাষায় খিস্তিখেউর করেন, যা একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য অত্যন্ত অশোভনীয় ও অমর্যাদাকর বলে অনেকের কাছে প্রতীয়মান হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামতকে (মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা) উপেক্ষার কারণে কোভিড-আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় বলে অনেকে মনে করেন। ট্রাম্প সঠিক পদক্ষেপ নিলে মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে এক/দেড় লাখ কম হতো বলে বহু বিশেষজ্ঞ মনে করেন। কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার পরও তিনি এক্ষেত্রে খুব ভালো কাজ করেছেন বলে বাগাড়ম্বর করেন। কাজে-কর্মে সাফল্য দেখাতে ব্যর্থ হলেও নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরে তার চেষ্টা মানুষের ভালো লাগেনি। তাছাড়া আমেরিকার রেস রিলেশন্স নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান বহু মানুষের মধ্যে ব্যাপক অস্বস্তির জন্ম দেয়। তিনি এক সমাবেশে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী সংগঠন প্রাউড বয়েজের (Proud Boys) কার্যক্রমের নিন্দা না করে বরং তাদেরকে আপাতত তাদের কর্মকাণ্ড সীমিত করে পরবর্তী নির্দেশের জন্য (Stand down & Stand by) অপেক্ষা করতে বলেন। তার এহেন বর্ণবাদী আচরণ বহু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মার্কিন নাগরিকের মনে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়।
তাছাড়া জনমত জরিপে তিনি যখন দেখেন যে, আমেরিকার শহরতলী অঞ্চলের (সাবার্বান) মহিলারা তাকে আর আগের মতো সমর্থন করছেন না, তখন তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, তাদের উচিৎ তাকে সমর্থন করা, কেননা তিনি তাদের স্বামীদের চাকরিতে ফেরৎ পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন।
তার এ বক্তব্য হীতে বিপরীত হয় এবং নারী ভোটারদের বিপুল অংশের সমর্থন থেকে তিনি বঞ্চিত হন। আমেরিকায় মোট ভোটারের ১১ শতাংশ হলো কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার। ট্রাম্প এসব ভোটারের মাত্র ৭ শতাংশের সমর্থন পান, বাইডেন পান ৯৩ শতাংশ।
ট্রাম্প নির্বাচিত হলে মানুষের স্বাস্থ্য সুবিধার ক্ষেত্রে প্রি-এগজিস্টিং কন্ডিশন কভারেজ সুবিধা বিলুপ্ত হতে পারে বলে মানুষের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়। সোশ্যাল সিকিউরিটি সুবিধাও কমিয়ে দেয়া হতে পারে- মর্মে তাদের মনে আশঙ্কার জন্ম হয়।
সোশ্যাল সিকিউরিটি ফান্ডের অর্থের মূল উৎস হলো পে-রোল ট্যাক্স থেকে প্রাপ্ত অর্থ। ট্রাম্পের পে-রোল ট্যাক্স কর্তন বন্ধের নীতির কারণে এই অর্থের যোগান কীভাবে করা হবে- সে নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দেয়। অপরদিকে বাইডেন নির্বাচিত হলে তিনি ফ্রি মেডিকেয়ার, অবৈধ নাগরিকদের ঢালাও নাগরিকত্ব প্রদান ও তথাকথিত গ্রিন নিউ ডিলের মাধ্যমে দেশকে কমিউনিজম ও সোশ্যালিজমের দিকে নিয়ে যাবেন বলে মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। যদিও তারা তার এ বক্তব্যকে তেমন গুরুত্ব দেননি।
ট্রাম্প বাইডেনকে গ্রিক মিথোলজির ট্রোজান হর্সের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, বাইডেনকে সামনে রেখে আসলে এলিজাবেথ ওয়ারেন-কমলা হ্যারিস, আলোকজান্দ্রিয়া কর্টেস, ন্যান্সি পোলোসি ও বার্নি স্যান্ডার্সের মতো অতি বাম ও সমাজতন্ত্রীরাই দেশ পরিচালনা করবেন, যা দেশকে এক গভীর সংকটে নিপতিত করবে। ট্রাম্পের এ বক্তব্যও মানুষ তেমনভাবে গ্রহণ করেনি। অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষের বেকারত্ব ট্রাম্পের পরাজয়কে নিশ্চিত করে তোলে।
প্রেসিডেন্ট পদে পরাজয় হলেও মার্কিন সিনেটে রিপাবলিকানদের আধিপত্য বজায় থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সক্ষম হবেন, তা মনে করার কারণ নেই। কারণ সিনেটের অনুমোদন ছাড়া অনেক কিছুই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। শাসনের শেষ বছরে ওবামা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে মেরিক গারল্যান্ডকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, কিন্তু সিনেটের সমর্থন না পাওয়ায় তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হতে পারেননি। মার্কিন গণতন্ত্রের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের এ এক অন্যান্য রূপ।
নির্বাচনে বাইডেনের বিজয়ে গণতন্ত্র জয়ী হয়েছে। জয় হয়েছে জবাবদিহিতার। কাজে-কর্মে সফলতা না দেখিয়ে নিজেকে বড় বলে ব্রাভাডো জাহির করে যে নির্বাচনী বৈতরণী পার পাওয়া যায় না, এবারের নির্বাচন সেটাই প্রমাণ করেছে। প্রমাণ করেছে নিজে বেকুব বলে অন্য সবাইকেও সে রকমটি ভাবা কোনো কাজের কাজ নয়।
মার্কিন নির্বাচনে বিদেশি হস্তক্ষেপের বিষয়টি একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যু। এটা জানা সত্ত্বেও নির্বাচনের দুদিন পূর্বে অ্যারিজোনার এক নির্বাচনী সভায় ট্রাম্প কর্তৃক বৃটিশ কট্টর ডানপন্থী নেতা নাইজেল ফারাজকে মঞ্চে তুলে তার সমর্থনে ভাষণ দিতে দেয়ার ঘটনায় অ্যারিজোনাসহ আমেরিকার বহু মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়।
সবশেষে বলি, ট্রাম্প মুখে যাই বলুন, তিনি যেহেতু একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন, সেজন্য ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে তিনি যে আবার প্রার্থী হবেন না, সেটা হলফ করে বলা যায় না।