প্রয়াত প্রবাসী মাহবুব আলী বুলুর বহুমাত্রিকতা

সালেম সুলেরী

অবশেষে পরপারের অতিথি হলেন মাহবুব আলী বুলু। স্বদেশ-প্রবাসের প্রিয়মুখ-সংগঠক ছিলেন। রাজনীতি, সামাজিক-বাণিজ্যিক ও সেতুবন্ধের সক্রিয়জন। ২০১৮-এর ২৮ এপ্রিল নিউইয়র্কে ওড়ালেন মৃত্যুপতাকা। পরদিন জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে ছিলো নামাজে জানাজা। অতঃপর বাংলাদেশের নীলফামারী অভিমুখে অন্তিম অভিযাত্রা। সেখানেই শেষ শয়ন- যেখানে জন্মেছিলেন ১৯৫২ তে।
জীবনকে বহুমাত্রিকতায় রাঙ্গিয়েছিলেন মাহবুব আলী বুলু। তারুণ্যে নীলফামারী পৌরসভার নির্বাচিত কমিশনার ছিলেন। পায়ে পায়ে জড়িয়ে ছিলো জাতীয় পার্টির রাজনীতি। নিউইয়র্ক প্রবাসী হন আশি দশকের উপান্তে। আমি বলতাম ‘নীলফামারী টু নিউইয়র্ক?’ তিনি বলতেন ‘না বাহে। হামরা নর্থবেঙ্গল টু নর্থ অ্যামেরিকা।’ অর্থাৎ উত্তরবঙ্গ থেকে উত্তর অ্যামেরিকায়।
কথার সাথে কাজের মিলও রেখেছিলেন। সুদূর প্রবাসে বসে অঞ্চলভিত্তিক সংগঠনও গড়েছেন। বৃহত্তর রংপুর জনকল্যাণ সমিতি, যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সংস্কৃতিসেবী মাহবুব আলী বুলু। প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নূর ইসলাম বর্ষণ। ২০০১ সালে দেখালেন সেতুবন্ধ সংস্কৃতির চমক। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত হলো ‘প্রথম আন্তর্জাতিক লোকসঙ্গীত সম্মেলন।’ আমি তখনও অ্যামেরিকা প্রবাসী হইনি। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে মিডিয়াঘনিষ্ঠ পেশাজীবন। যোগাযোগ করলেন জনাব বুলু, জনাব বর্ষণ। এছাড়া সাপ্তাহিক ঠিকানা প্রেসিডেন্ট সাঈদ-উর-রব। বাংলাদেশ ও ভারতের শিল্পী-কুশলীদের নিউইয়র্কে নেবেন। আমরা ‘মাটির-গন্ধমাখা’ গানের মানুষদের মিলিয়ে দিলাম। দু’বছর পর পর সেই লোকসঙ্গীত সম্মেলন এখনও হচ্ছে। আমার কবিতা দিয়েও একবার সাড়ম্বরে উদ্বোধন হয়েছিলো। ভবিষ্যত প্রজন্মের হাতে এখন এই লোকজ উৎসবের পতাকা। তবে সেই সূচনা কান্ডারী এখন স্মৃতির প্রতিপাদ্য।
বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির লোকজ ব্যক্তিত্বদের সমাদর ক’জন করে! আব্বাসউদ্দীন, জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল বা হাছনরাজা। লালন, শ্যামসুন্দর, শেফালী ঘোষ, রাধানাথ, আরকুম শাহ, হরলাল রায়…। বিস্মৃতপ্রায় মহীরুহবৃন্দ সমাদৃত হয়েছেন সুদূর প্রবাসপ্রান্তে। অনেক হৃদয়বান সংগঠকেরই মিলিত উদ্যোগÑ লোকসঙ্গীত সম্মেলন। তারই একটি স্মৃতিসমুজ্জল গ্রহের নাম মাহবুব আলী বুলু।
ছিলেন যেমন সজ্জন, তেমনই সেবক চরিত্রের। বাংলাদেশে জাতীয় পার্টির জন্ম ১৯৮৬-এর পয়লা জানুয়ারি। জনাব বুলু দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মী, সংগঠক। একযোগে একাধিক পদে কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদকও ছিলেন। বৃহত্তর রংপুরের নীলফামারী জেলার সভাপতিত্বও করেছেন। তবে সর্বাধিক পরিচিতি যুক্তরাষ্ট্র সভাপতি হিসেবে। মৃত্যুকাল পর্যন্ত একই পদে বহাল থেকে রেকর্ড গড়েছেন। না কর্মী সতীর্থরা অনাস্থা এনেছেন। না কেন্দ্রীয় কমিটি তাকে স্থলাভিষিক্ত করেছে। একটি শীর্ষ পদে এমন দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান বিরল ঘটনা। একজন ভালো মানুষের প্রতিকৃতি দিয়েই তিনি অসাধ্যকে জয় করেন।
২০১৩ সালের একটি ঘটনা বিবৃত করি। জাপা-প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অ্যামেরিকা সফর করলেন। নিউইয়র্কে বিশাল বপুর সংবর্ধনার আয়োজন। প্রস্তুতিপর্বে আমাদের জ্যাকসন হাইটস্থ অফিসে এলেন প্রবাসী নেতারা। নেতৃত্বে সুদর্শন সভাপতি মাহবুব আলী বুলু। তাঁদের জোর প্রস্তাবে আমি হতবাক। আমাকে উদ্বোধনী কবিতা পড়তে হবে। মি. বুলু, হাজ্বী রহমান, এডভোকেট হারিস, বড় ভু’ইয়া, চান্দু, গিয়াস, আলতাফ- এক জোট। সবার মুখে একই সুরের ধ্বনি। এরশাদ সাহেব কবিতার মানুষ। কবিতা দিয়েই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের উদ্বোধন যুক্তিপূর্ণ। কবিতা লিখি বিধায় আমাকেই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে।
আমি প্রথমে সম্মত ছিলাম না। নীতিগত বিষয় ছিলো যুক্তির নেপথ্যে। আশির দশকে আমরা ছিলাম এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে। সামরিক পরিস্থিতির অবসান ও গণতন্ত্রের বিকাশ চেয়েছি। জাতীয় কবিতা উৎসবের অন্যতম প্রস্তাবক ও সংগঠক ছিলাম। আমাদের তারুণ্য ভাঙিয়েছি বিল্লবের ঘুড়ি উড়িয়ে। সেই উদ্দীপনাকালে শীর্ষ ভিলেন ছিলেন জে. এরশাদ। তাঁর সংবর্ধনার আয়োজনে আমার কবিতা কতোটা মানানসই হবে?
কথাটির পিঠে অকাট্য যুক্তি মাহবুব আলী বুলুর। বললেন, তখন তিনি শাসক ছিলেন। কেউ বলেন স্বৈরশাসক, কারও বিবেচনায় পল্লীবন্ধু। কিন্তু সামগ্রিক বিবেচনায় তিনি এখন ক্ষমতাহীন। জেল খেটেছেন, এখন গণতন্ত্রের জন্যে আন্দোলন করছেন। এই যুক্তিতে গণতন্ত্রমনাদের ইস্যুভিত্তিক ঐক্য চাই। কবি নির্মলেন্দু গুণও বিরোধী পক্ষে ছিলেন। এখন তিনিও কবি এরশাদের সুহৃদ ও ঘনিষ্ঠজন। আমাদের প্রবাসকবি সালেম সুলেরী তাহলে কেনো বিমুখ করবেন।
না, আর বিমুখ করা যায়নি। সাড়ম্বরে উদ্বোধনী কবিতা পড়েছিলাম তৎকালীন ‘ঢাকা ক্লাবে’। এরশাদ সাহেব উদ্যোক্তা ও শ্রোতাবৃন্দ ভীষণ প্রীত হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানমঞ্চেই ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম প্রস্তাবকবৃন্দকে। বিশেষ করে অসাধ্য সাধনাকারী মাহবুব আলী বুলুকে।
প্রবাসে পেশাজীবনে ছিলেন ব্যবসায়ী। ক্যানেল স্ট্রিটে ঘড়ি ও অন্যান্য পণ্যের দোকান ছিলো। নিউইয়র্কে অনেকের হাতেই দেখেছি উপহারের নিদর্শন। এক কথায় জনাব বুলু ছিলেন শতভাগ হৃদয়বান মানুষ। ‘ডাউন টাউন বাঙালি বিজনেসম্যান এসোসিয়েশন’ করেছিলেন। বাঙালিদের ব্যবসার বিকাশে আপাদমস্তক খেটেছেন। খানিক অনিয়মের দোহাই দিয়ে অনেকের দোকানে তালা দিতো প্রশাসন। এনওয়াইপিডি বা পুলিশকে সহজেই পটাতে পারতেন সংগঠক বুলু। বলতেন, প্রথম অপরাধ মাফ করে দিন। দ্বিতীয়বার হবে না, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি। এভাবে অসংখ্য উদ্যোক্তার অন্ধকার দূর করে দিয়েছেন।
প্রবাসীদের কর্মসংস্থানেও দৃষ্টান্ত অনেক। সুযোগ থাকলেই অন্যের জন্যে সুপারিশ করেছেন। অনেকের হাতে কাজ ধরিয়ে দিয়েছেন। ২৮ এপ্রিল দুপুরে জনাব বুলুর মৃত্যুসংবাদটি পেলাম। জ্যামাইকা এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টে তখন শনিবাসরীয় আড্ডায়। ফোন পেলাম বঙ্গবন্ধু থিয়েটার সভাপতি ইসমাইল খান আনসারীর। তিনি যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় পার্টির উপদেষ্টাও। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, আমরা অভিভাবককে হারালাম। রাজনৈতিক অনেক মতভেদ থাকতে পাওে, তবে জনাব বুলু সংগঠক ও মানুষ হিসেবে সার্বজনীন ছিলেন।
মৃত্যুসংবাদ প্রাপ্তিকালে সামনে ছিলেন প্রবীণ-প্রবাসী আবু ফিরোজ। বললেন, ১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে প্রথম এসেছি। ক্যানেল স্ট্রিটে বুলু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। আমি তখন বিশাল শহরটি ঘুরে দেখার নেশায় মত্ত। কাজে যোগ দিলে আর শহর দেখা হবে না। তাই ঘোরাঘুরির ভেতর দিয়েই দিন গুজরান করছি। কিন্তু সেদিন চোখ খুলে দিলেন বুলু ভাই স্বয়ং। বললেন, প্রবাসে প্রথম বিবেচনা- পেশা। তারপর না হয় ঘোরাঘুরির নেশা। সময় কি এভাবে নষ্ট করা যায়?
আবু ফিরোজ বললেন, তাঁর কান্ড দেখে অবাক হলাম। পাশের দোকানদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন, খুব ভালো ছেলে, সম্ভ্রান্ত পরিবারের। কাজ থাকলে লাগিয়ে দিন, ভালো ফল পাবেন। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি।
অনেকেরই ‘গ্যারান্টা’র ছিলেন মাহবুব আলী বুলু। কিন্তু লাঞ্চ-ক্যান্সার থেকে বাঁচবার গ্যারান্টি পেলেন না। লং আইল্যান্ডের জুইস হাসপাতাল থেকে বেরুলো আত্মাবিহীন দেহ। সমাহিতকরণের জন্য পাঠানো হলো পৈতৃক ঠিকানায়। এসেছিলেন নীলফামারী থেকে নিউইয়র্কে। আর এবার নিউইয়র্ক থেকে সেই নীলফামারীতে। মানবজীবনের কী বিচিত্র উল্টাগমন!

২০০৬ সালে নীলফামারী জেলার ডোমার গিয়েছিলেন এম এম শাহীন। প্রবাসের প্রধান সাপ্তাহিকীÑ ঠিকানার কর্ণধার তিনি। দু বারের সাবেক সংসদ সদস্যও। আব্বাসউদ্দীন সম্মাননা নিয়েছিলেন মুস্তাফা জামান আব্বাসীর হাত থেকে। আমি ছিলাম অনুষ্ঠানের উদ্বোধক। পরদিন আমরা গেলাম নীলফামারী সদরে। জনাব শাহীনের আগ্রহটি ছিলো চমকপ্রদ। নিউইয়র্ক প্রবাসীদের নীলফামারিস্থ পরিবারগুলো পরিদর্শন করবেন। সেক্ষেত্রে প্রথম নামই মাহবুব আলী বুলুর পরিবার। বাসায় গিয়ে পাওয়া গেলো প্রিয়-শ্রদ্ধেয় জননী খোদেজা খাতুনকে। ছিলেন সহোদর বকুল, মুন্না প্রমুখ। ভুড়িভোজ না করিয়ে ছাড়েনি সেই পরিবার।
ভুড়িভোজে উত্তরবঙ্গে আলোচিত নাম- জনাব বুলুর পরিবার। বড় ছেলে আখতারুজ্জামান রাজার বৌভাত খেয়েছেন ২০ হাজার অতিথি। ছোট ছেলে আসাদ রোমি রোমানের বিয়েতে ১২ হাজার। আমি সৌভাগ্যবান যে, দুটো বিয়েতেই অতিথি ছিলাম। স্ত্রী কুলসুমসহ সন্তানেরা অ্যামেরিকা প্রবাসী। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোর প্রধান আয়োজন হয়েছে ঢাকা ও নীলফামারীতে। রাজার বিয়েতে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ নীলফামারী গিয়েছিলেন। স্টেডিয়ামে বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী, মমতাজ, জহির আলীম, ব্যান্ডতারকা হাসান প্রমুখ অংশ নেন। আংশিক সঞ্চাচনায় ছিলাম আমি। দ্বিতীয় ছেলের বিয়েতে সারারাত ধরে অনুষ্ঠান চলে। পর্দা ও মঞ্চ কাঁপানো তরুণ তারকাপূর্ণ আয়োজন। কথা-কবিতা-গান দিয়ে সঞ্চালনা করেছিলাম অনুষ্ঠানসমগ্র। সেই বিয়ের উকিলবাবা ছিলেন জাপাপ্রধান এইচ এম এরশাদ। ঢাকা থেকে নবদম্পতি নীলফামারী গিয়েছিলো হেলিকপ্টারে। বরাবরের মতো বৌভাত চলেছিলো তিনদিন। শতাধিক গরু, পাঁচ শতাধিক ছাগল, পাঁচ হাজার মুরগি…। ভুরিভোজ নিয়ে এলাহী কারবার দেখেছিলাম উভয় বিয়েতেই।
নীলফামারীতে একাধিক হোটেল বানিয়েছে প্রবাসী হোসেইন রানা। কক্ষগুলো উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো তারকা অতিথিবৃন্দের জন্যে। শহরে যেন এমন কোন নাগরিক নেই- যিনি বৌ-ভাত খাননি।
সর্বসাধারণের চোখের মণি ছিলেন জনাব বুলু। অন্যের জন্যে এমন নিবেদিতপ্রাণ হৃদয়- বিরল। অন্যকে এমপি বানিয়েছেন, মন্ত্রি বানিয়েছেন। নিজের আসন ছেড়ে দিয়েছেন বিনাবাক্যে। আমাদের সাদাকালো ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ২০০২ সালে। কালচারাল ট্যুরজমের পক্ষে দিয়েছিলেন নানান যুক্তি।
বলেছিলেন, সংস্কৃতিই প্রবাসীদের প্রধান সওদা। তা ফেরী করার মধ্য দিয়েই দেশপ্রেম দেখানো সম্ভব। তাতে স্বদেশ ও প্রবাসের সেন্ধুবন্ধ সোচ্চার ও সুদৃঢ় হতে পারে।
একই মাসে প্রবাসের দুই প্রতীক-পুরুষ পরকাল বেছে নিলেন। ২০১৮-এর এপ্রিলেই ঘটলো বিয়োগান্তক ঘটনাদ্বয়। বৃহত্তর সিলেটের গজনফর আলী চৌধুরী। আর উত্তরবঙ্গের মাহবুব আলী বুলু। মাস পেরোলেই পবিত্র রমজান, মহানন্দের ঈদ। আবার কোলাকুলি, বুকে বুক মেলানো। পৃথিবী আবার চলবে এগিয়ে যাওয়ার নিয়মে। কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয় এই কীর্তিমানদের। নিউইয়র্কে প্রবাসী সমাজ প্রতিষ্ঠার পথিকৃতদের প্রতি সতত শ্রদ্ধা।
নিউইয়র্ক, এপ্রিল ২০১৮।