ফরিদপুর : ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ ঝিলটুলি এলাকার একটি ফ্লাট থেকে সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক সাজিয়া বেগম (৩৬) ও সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা ফারুক হাসানের (৩৮) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ৫ মে রাত ১টায ওই ফ্ল্যাট থেকে লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। নিহত কলেজ শিক্ষিকা সাজিয়া বেগম ফরিদপুরের সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি দুই ছেলে নিয়ে এই বাসার নিচতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। তার স্বামী শেখ শহিদুল ইসলাম ঢাকায় মোটর পার্টসের ব্যবসা করেন। তাদের বাড়ি রাজধানীর সূত্রাপুর থানার বানিয়ানগর এলাকায়।
ব্যাংক কর্মকর্তা ফারুক হাসানের গ্রামের বাড়ি যশোর জেলার শার্শা উপজেলার নাভারন গ্রামে। তার বাবার নাম মিজানুর রহমান। ফারুক থাকতেন ঢাকার আগারগাঁও এলাকার ৩৮ নম্বর বাসায়। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে মেঝ ফারুক হাসান। ফারুক সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে লিগ্যাল মেটার্স ডিভিশনে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন সোনালী ব্যাংক ফরিদপুরের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. শামসুল হক।
ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি এ এফ এম নাসিম বলেন, বাড়ির মালিক পুলিশকে খবর দিলে আমরা এসে লাশ উদ্ধার করি। দক্ষিণ ঝিলটুলি এলাকার নুর ইসলামের বাড়ির নিচতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। শিক্ষিকার লাশ দরজার পাশে রক্তাক্ত অবস্থায় এবং ব্যাংক কর্মকর্তার লাশ ফ্যানের হুকের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তার বুকে আঘাতের ক্ষত রয়েছে। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাজিয়ার স্বামী ব্যবসায়ী শেখ শহিদুল ইসলামকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। ওসি নাসিম আরো জানান, প্রাথমিক তদন্তে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এই দুজন পূর্ব পরিচিত ছিলেন সেটা প্রেমের সম্পর্ক হতে পারে। আর একটি বিষয় হলো, ফারুক হাসান এই বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন তার পরিচয় গোপন করে। ফ্ল্যাট থেকে রক্তমাখা ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই ঘটনায় মামলা দায়েরর প্রস্তুতি চলছে।
ফ্ল্যাটের মধ্যে ঝুলন্ত অবস্থায় লাশ প্রথম দেখেন বাড়ির মালিকের ছেলে ডেভিড হাসান। তিনি বলেন, গত ৭ মে রাজেন্দ্র কলেজের অভিষেক অনুষ্ঠানের কনসার্ট ছিল। রাত ১১টায কনসার্ট শেষে বাড়ি ফিরে নিচ তলার ওই ফ্লাটের দরজা খোলা দেখতে পাই। দরজার ফাঁকা দিয়ে দেখতে পাই ব্যাংক কর্মকর্তার লাশ ঝুলছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানাই। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে।
ডেভিড আরো জানান, নিহত কলেজ শিক্ষিকা এক বছর আগে এই বাসা ভাড়া নেন। তিনি তার দুই সন্তান নিয়ে বাসায় থাকতেন। তার স্বামী ঢাকায় ব্যবসা করেন। মাঝে মধ্যে এই বাসায় আসতেন। ঘটনার দিন তার স্বামী ফরিদপুরের বাসাতেই ছিলেন। আর ব্যাংক কর্মকর্তা ফারুক এক মাস আগে নিচতলায় কলেজ শিক্ষিকার পাশের ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। এক মাস আগে বাসা ভাড়া নিলেও তিনি থাকতেন না। দুই দিন আগে তিনি বাসায় এসে ওঠেন।
নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা ফারুক হাসানের বন্ধু সাংবাদিক মুক্তাদির রশিদ জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফারুকের সঙ্গে সাজিয়ার পরিচয় ছিল। একটা সময় তাদের বিয়েও করার কথা ছিল। কিন্তু সাজিয়া শেষ পর্যন্ত বিয়ে করবে না বলে জানালে তাদের মাঝে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সাজিয়া বছরখানেক আগে আবার ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে।
ফারুক হাসানের ভাই পুলিশ কর্মকর্তা মো. সোহরাব হোসেন বলেন, সাজিয়ার সঙ্গে ফারুকের কোনো সম্পর্ক ছিল কি নাÑ সেটা আমরা পরিবারের কেউ জানি না। ও এভাবে ফরিদপুর আসবে সেটাও জানা ছিল না আমাদের। তিনি বলেন, ঘটনা যাই ঘটুক, ভাইকে তো হারিয়েছি, এখন সত্যটা জানতে চাই। এই ঘটনার জন্য কেউ দায়ী হলে তার শাস্তিও চাই।
নিহত শিক্ষিকা সাজিয়ার স্বামী শেখ মো. শহিদুল ইসলাম ও ফুফু আফসারী আহমেদ জানান, অন্যান্য দিনের মতো গত ৫ মে-ও যথারীতি কলেজে যান সাজিয়া। বিকেল ৪টায় স্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা হলে সাজিয়া বাসায় ফিরছেন বলে জানান। এরপর থেকে আর ফোন রিসিভ করেননি তিনি। রাত ১১টায সামনের ফ্ল্রাটে (মো. ফারুক হোসেনের ফ্ল্যাট) ফারুক হাসানকে ঝুলন্ত ও সাজিয়াকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেয়া যায়। উভয়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুলতান মাহামুদ বলেন, ম্যাডাম গত ৫ মে কলেজে গিয়েছিলেন। দায়িত্ব শেষ করে সাড়ে ৩টায কলেজ থেকে বাসার উদ্দেশে বের হয়ে আসেন তিনি। এরপর সন্ধ্যার পরে জানতে পারি তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে আমরাও বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করে না পেয়ে থানায় জানাই। তিনি জানান, কলেজের শিক্ষিকার এমন নির্মম মৃত্যুতে শোক পালন করছে কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
এ দিকে গত ৭ মে বিকেলে সাজিয়া ও ফারুকের লাশের ময়নাতদন্ত শেষ করেছে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা।