মুহম্মদ শামসুল হক :
প্রজাবৎসল নবতিপর বৃদ্ধ রাজা লিয়রের অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তের খেসারত হিসেবে তার অকৃত্রিম দরদি কন্যা কর্ডেলিয়ার অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু, নিজের অনভিপ্রেত মহাপ্রয়াণ এবং অতিলোভী ও মিথ্যাচারিণী কন্যা গনেরিল ও রেগানের ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ঘটনায় পাঠকমাত্রই গভীরভাবে মর্মাহত। লিয়র রাজপরিবারের ধ্বংসের কাহিনি অদ্যাবধি ইংল্যান্ডের বাসিন্দা ছাড়াও বিশ্ববাসীকে অশ্রুসিক্ত করে তোলে।
খ. কাস্টম কর্মকর্তা নুরুল হুদা অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক হিসেবে বন্ধুমহলে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। নুন আনতে পান্তা ফুরায় পরিবারের সন্তান নুরুল হুদা মাত্র সাত বছর বয়সেই দিনমজুর পিতা কাসেম আলীকে হারিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে বড় দুই ভাই করিম ও রহিম অন্যের মাঠে-ঘাটে মজুরি খেটে কিশোর হুদার অন্ন-বস্ত্র-এবং লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছিলেন। কায়ক্লেশে স্কুল ও কলেজের দোরগোড়া অতিক্রমের পর ভাগ্যলক্ষ্মী নুরুল হুদার প্রতি মুখ তুলে তাকানোয় অবিশ্বাস্যভাবে কাস্টমস অফিসে তার চাকরি হয়ে গেল। অঢেল বাম হাতের লেনদেনের সুবাদে অল্প দিনেই বন্ধুবান্ধব এবং এলাকায় হুদা সাহেব হিসেবে নুরুল হুদার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল।
স্যুট-টাই পরিহিত অতিশয় খর্বকায় কুৎসিত-কদাকার নুরুল হুদার চলার পথের দিকে মানুষ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেস ছেড়ে অভিজাত এলাকায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার পর থেকেই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী চৌধুরী পরিবারের পক্ষ থেকে বিয়ের ঘটক এবং বসন্ত কোকিলরা হুদা সাহেবকে নিয়ে রীতিমতো মাতামাতি শুরু করে দিল। বাক্্বাগিশ ও দক্ষ ঘটক নুরু মোল্লা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হুদা সাহেবের বাসায় আসার দ্বিতীয় দিনে চৌধুরী সাহেবের একমাত্র কন্যা দুধে-আলতা মেশানো গাত্রবর্ণধারিণী পুষ্পিতা যৌবনা রুমা চৌধুরী অযাচিতভাবে সশরীরে হাজির হলেন হুদা সাহেবের বাসায়। প্রথম দর্শনেই হুদা সাহেব চৌধুরী-কন্যার প্রেমসাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলেন।
শুরু হলো প্রেমের অছিলায় প্রণয়, অভিসার, বিয়ের আয়োজন, কোটি টাকার কাবিনের শর্ত, প্রাসাদোপম অট্টালিকা খরিদ ইত্যাদি দাবি পূরণের পালা। রুমা চৌধুরীর শর্ত মোতাবেক কয়েক লাখ টাকা ব্যয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলেও পাত্রপক্ষের কারও সৌভাগ্য হয়নি বিয়েতে অংশ নেওয়ার। বিয়ের পর থেকেই মা-ভাই ও গ্রামের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করলেন আল্ট্রা মডারেট হুদা সাহেব। এদিকে অভাব-অনটন ও বার্ধক্যজনিত রোগব্যাধিতে ভুগে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় হুদা সাহেবের পলিতকেশ জননী ইহলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোকে যাত্রা করলেন। মায়ের মৃত্যুর দুই দিন পর প্রথম বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠান থাকায় মায়ের জানাজায় অংশ নেওয়াও কুলাঙ্গার হুদার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অগত্যা হুদার চিরঅনটনগ্রস্ত দুই ভাই মায়ের জানাজার আয়োজন করলেন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি শেষে লোকান্তরিত পিতার কবরের পাশেই মাকে সমাহিত করলেন। চৌধুরী-কন্যাকে বিয়ের পর একাদশে বৃহস্পতির আনুকূল্যে হুদার পদোন্নতি হলো।
আর বাম হাতের লেনদেনের মাধ্যমে অল্প দিনে কোটি কোটি টাকা হাতে আসায় নরকের কীট হিট হুদা হালফ্যাশনের ছয়তলা ভবন, নামে-বেনামে অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্টের মালিক বনলেন। দুই সন্তান, স্ত্রী, স্ত্রীর পক্ষের আত্মীয়স্বজন, স্বার্থান্বেষী বসন্তের কোকিলে হুদা সাহেবের বৈঠকখানা অহরাত্র ঠাসা থাকে। বিবাহবার্ষিকী, সন্তানদের জন্মবার্ষিকী, শ্বশুর-শাশুড়ির বিবাহবার্ষিকী, শ্যালিকার বিবাহবার্ষিকী, মেয়ের আকিকা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের পেছনে হুদা সাহেব রাশি রাশি অর্থের শ্রাদ্ধ করেন অকাতরে। অতিরিক্ত মেদ-মজ্জা ও ভুঁড়িওয়ালা হুদাকে এখন অনেকটা গোলাকার টিলার মতো দেখায় এবং হাঁটাচলার সময় মনে হয় একখণ্ড পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে।
কথায় বলে, সেই স্মরণাতীত কাল থেকে ঋতুর পরিবর্তন, জোয়ার-ভাটা, চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধি এবং জাগতিক উত্থান-পতন সংঘটিত হয়ে আসছে প্রাকৃতিক নিয়মে। একমাত্র বিশ্ববিধাতা ছাড়া একে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বা এখতিয়ার কারও নেই। হুদা সাহেবের জীবনেও ধীর লয়ে রাহুর পদধ্বনি সূচিত হলো। রসনাপূজা, অতিরিক্ত মসলাযুক্ত মুখরোচক খাবার গোগ্রাসে ভক্ষণ, মদ-বিয়ারসহ সব ধরনের নিষিদ্ধ পানীয় অতিরিক্ত সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হুদা সাহেবের শরীরে নানাবিধ জটিল ব্যাধি স্থায়ী পালঙ্ক পেতে বসেছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল-জাতীয় দুরারোগ্য ব্যাধি, খাওয়াদাওয়ায় অরুচি, অনিদ্রা, হাঁটাচলায় কষ্ট, হাঁটুসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রচণ্ড ব্যথা-বেদনার সঙ্গে হঠাৎ বুকের ব্যথা শুরু হওয়ায় হুদা সাহেবকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হলো। ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে ছয়টি ব্লক অপসারণের পর সে যাত্রায় হুদা সাহেব অত্যাসন্ন মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেলেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফেরার পর হুদা সাহেব হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে লাগলেন যে তার চিরদিনের লালিত স্বপ্নসৌধ হঠাৎ ভূপতিত হতে চলেছে। স্ত্রী কারণে-অকারণে তাকে সর্বদা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে এবং পুত্র-কন্যারা হেরোইনের খরচ ঠিকমতো না পাওয়ায় মুখে মুখে বচসা শুরু করেছে। মাদকাসক্ত স্ত্রী গভীর রাতে অভিসার সেরে টলতে টলতে বাড়ি ফেরে এবং ভিন্ন শয্যায় অবসন্ন দেহ এলিয়ে দিয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পুত্র-কন্যাও গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে কাটিয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় টলতে টলতে বাড়ি ফেরে এবং নিজ নিজ বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যার নৈতিক চরম অবক্ষয় স্বচক্ষে অবলোকনের পরও শয্যাশায়ী হুদা কিল খেয়ে কিল হজম করছেন। রুমা চৌধুরী সবকিছু জানার পরও থলে কেটে বিড়াল বেরিয়ে পড়ার আশঙ্কায় পুত্র-কন্যাকে আশকারা দিয়ে যাচ্ছেন। অসুস্থ হুদার চরম দুর্দশা এবং ভোগান্তিকে স্ত্রী রুমা নিজেদের সুখ-নিদ্রার ব্যাঘাত ও অনাহূত উপদ্রব হিসেবে ধরে নিয়ে তাকে মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ারও ভয় দেখান। এদিকে হুদা সাহেবের আয়-রোজগার এবং জৌলুশে ভাটা পড়ার পর থেকে স্ত্রীপক্ষের আত্মীয়স্বজন এবং বসন্তের কোকিলদের আনাগোনাও কমে গেছে। শরাহত পাখির মতো হুদা সাহেব একাকী নিজের বিছানায় রাত জেগে ছটফট করেন এবং মৃত্যুর জন্য প্রমাদ গুনতে থাকেন।
সামান্য আরোগ্য লাভের পর হুদা সাহেব অফিসে এসেছেন এবং স্বহস্তে লিখিত একটি পত্রসহ বেতনের এক লাখ টাকা মেজো ভাইয়ের নাম-ঠিকানা সংবলিত খামে পুরে একজন অতি বিশ্বস্ত পিয়নের নিকট গোপনে রেখে দিলেন। হুদার স্বহস্তে লিখিত পত্রে তার মরদেহটা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার বিশেষ অনুরোধ ছিল। সেদিন অনেকটা কপর্দকশূন্য হুদা সাহেব বাড়ি ফেরার পর চরম ভাগ্য বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলেন। এর আগে একদিন হজে যাওয়ার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করার পর স্ত্রী রুমা চৌধুরী তাকে চরমভাবে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেছিলেন। আর আজ রণমূর্তি ধারণপূর্বক স্ত্রী রুমা চৌধুরী কপর্দকশূন্য হুদা সাহেবের কপালে ঝাঁটা দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন। মূলত গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া এবং উৎকোচ নেওয়া বন্ধ করার পর থেকেই পরিবারে হুদা সাহেবের লাঠি-জুতায় যে আদর শুরু হয়েছিল, সেদিন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল। নিয়তির নির্মম বিধান হিসেবে মুমূর্ষু হুদা সবকিছু নীরবে হজম করলেন। উল্লেখ্য, হুদা সাহেবের অবৈধ আয়ে নির্মিত প্রাসাদোপম ভবনের সামনে একচিলতে খালি জায়গা ছিল। একদিন পর হুদা সাহেব স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে ডেকে বললেন, তার মৃতদেহ যেন খালি জায়গাটুকুতে সমাহিত করা হয়। স্ত্রীর সাফ জবাবÑআগে মরো তারপর দেখা যাবে। এদিকে চরম উত্তেজনা সমভিব্যহারে সেদিন স্ত্রী রুমা চৌধুরী অন্যান্য দিনের তুলনায় অধিকতর আকর্ষণীয়ভাবে সেজেগুজে সন্ধ্যা সমাগমে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের গৃহত্যাগের অব্যবহিত পরপরই পুত্র ও কন্যা নিজেদের গার্ল ও বয়ফ্রেন্ডকে কল করে হুদা সাহেবের নাকের ডগার ওপর দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
শয্যাশায়ী হুদা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সবার গমনপথের দিকে তাকিয়ে দুই ফোঁটা তপ্ত অশ্রু বিসর্জন করলেন। রাত ১২টার দিকে অকস্মাৎ হুদা সাহেবের বুকের ব্যথা শুরু হলো। মৃত্যুর পূর্বাভাস আঁচ করতে পেরে হুদা সাহেব প্রথমে অফিসের পিয়ন চাচাকে ও পরে অ্যাম্বুলেন্স কল করলেন। মুমূর্ষু হুদাকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি রাত একটায় হাসপাতালে পৌঁছাল। আর রাত চারটার দিকে হুদার পরান পাখি খাঁচা ছেড়ে অনন্তলোকে যাত্রা করল। যৌনক্ষুধা মেটানোর পর রাতের শেষ প্রহরে মাতাল স্ত্রী বাড়ি ফিরলেন এবং অবসন্ন দেহটা বিছানায় লুটিয়ে দিয়ে নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়লেন। শেষ রাতে ছেলেটা বাড়ি ফিরলেও মেয়ের বাড়ি ফেরা হলো না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাসায় বারবার কল করলেও কোনো সাড়া পেল না। হুদার মরদেহের পাশে বৃদ্ধ পিয়নের ফোন নম্বর পাওয়া গেল এবং ফোনে হুদার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে বৃদ্ধ পিয়ন চরমভাবে মর্মাহত হলেন। তিনি পড়িমরি হয়ে হাসপাতালে পৌঁছালেন এবং হাসপাতাল অভিমুখে রওনা হওয়ার আগেই অপর এক পিয়নকে হুদার গ্রামের বাড়িতে পাঠালেন। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হুদা সাহেবের স্ত্রীর সুখনিদ্রার ঘোর কাটল।
বিরক্তির সুরে হ্যালো বলার পর জানতে পারলেন যে হুদা অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। আপদ বিদায় হওয়ায় স্ত্রী-পুত্র-কন্যা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। নিজেদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাসপাতালে পৌঁছার পর হুদা সাহেবের দুজন দুষ্কর্মের দোসরকে মৃত্যুর খবরটি জানানো হলো। একজন জানাল যে অসুখ-বিসুখের দরুন সারা রাত অনিদ্রায় কাটানোয় তার পক্ষে হাসপাতালে আসা সম্ভব নয়। অন্যজন জানাল, রাতে তার একটি নাতি হয়েছে, তাই পুত্রবধূকে একা রেখে তার পক্ষে হাসপাতালে আসা সম্ভব নয়। সোজাকথা, মৃত হুদার জীবনে তখন বর্ষা; তাই বসন্তের কোকিলরা আসবে কেন? জানাশোনা একজন হুদা সাহেবের খরিদকৃত খালি জায়গায় মরদেহ সমাহিত করার প্রস্তাব করামাত্রই স্ত্রী তেলেবেগুনে চটে গেলেন। বাঘিনী স্ত্রী রুমা চৌধুরী বললেন, আর আদিখ্যেতা করতে হবে না; বাড়ির ভেতরে কাউকে কবর দেওয়া যায় কি? বরং আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে খবর দিলে সব ল্যাটা চুকে যাবে। ঠিক সে মুহূর্তে হাউমাউ করতে করতে ষার্টোর্ধ্ব লুঙ্গিপরা এক বৃদ্ধ এবং তার সাথে ২৫-২৬ বছরের প্যান্টপরা এক যুবক হাসপাতালে ঢুকল। অশ্রুসিক্ত বৃদ্ধ হুদার মরদেহের ওপর লুটিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল। আর যুবকটি আবেগে উদ্বেলিত না হয়ে হুদার মরদেহ হাসপাতাল থেকে ছাড় করার নিমিত্তে কাগজপত্র তৈরির কাজে লেগে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যে ছাড়পত্র পাওয়ার পর হুদার মরদেহ নিয়ে তার ভাই এবং ভ্রাতুষ্পুত্র গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলেন। সেই মুহূর্তে বৃদ্ধ পিয়ন হুদার ভ্রাতুষ্পুত্রের হাতে খামটি বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, বাড়ি গিয়ে খামটি খুলে হুদার অন্তিম অভিপ্রায় অনুসারে তার মরদেহ সমাহিত করুন। হুদার মরদেহের সঙ্গে প্রিয়তমা পত্নী, পুত্র-কন্যা কেউই এলেন না। খামের মাঝে হুদার স্বহস্তে লিখিত পত্রের সঙ্গে নগদ এক লাখ টাকা পাওয়া গেল। হুদার অন্তিম অভিপ্রায় অনুসারে মা-বাবার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হলো এবং অর্থ কাঙালি ভোজসহ বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে ব্যয় করা হলো।
ভাগ্যহত হুদার মতো লাখ লাখ হুদার উত্থান-পতনের কাহিনি আমাদের জানা এবং শোনা আছে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং মায়া-মরীচিকার হাতছানিতে প্রলুব্ধ হয়ে সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা-অরণ্যকুন্তলা গ্রামবাংলার চিরায়ত কৃষ্টি-সংস্কৃতি; ধর্মীয় ও পারিবারিক মূল্যবোধ এবং স্বজনদের স্নেহবন্ধন ছিন্ন করে আমরা আটলান্টিকের এপারে বসতি গড়েছি। উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রমের বিনিময়ে আমরা ভাগ্যলক্ষ্মীকে ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছি, একাধিক গাড়ি-বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছি। আমাদের নতুন প্রজন্মও নিজেদের প্রজ্ঞা-মেধা-উদ্ভাবনী শক্তি ও কর্মনৈপুণ্যের সুবাদে উচ্চ পদে আসীন হয়েছে এবং কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থও উপার্জন করছে। কিন্তু একাধিক প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির মালিকের কবিরাজের বাড়িতে স্বজনদের অনুপস্থিতিতে মারা যাওয়া, কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে দীর্ঘকাল নির্জন জীবন কাটানোর পর অনেক বাড়ি-গাড়ির মালিকের মৃত্যুবরণ কিংবা হসপিসে পঞ্চত্বপ্রাপ্তির খবরে আমরা বাস্তবিকই উদ্বিগ্ন। নিজেদের ভাগ্যে কী আছে, তা একমাত্র বিশ্বপ্রতিপালকই ভালো জানেন।
নিউজার্সির ডেমোক্র্যাটিক দলীয় বিত্তশালী গভর্নর ২০০৮ সালের ডেমোক্র্যাটিক দলীয় জাতীয় কনভেনশনের প্রাণপুরুষ এবং প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওমাবার বিজয়ের অন্যতম নায়ক ছিলেন। ব্যর্থ বিনিয়োগে সাত লক্ষাধিক ডলার মার খাওয়ার পর রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যের জগৎ থেকে তার চিরবিদায় ঘটেছে। মাস কয়েক আগে জীর্ণ বস্ত্রে ভাগ্যবিড়ম্বিত গভর্নর চিরায়ত অভ্যাসবশত এসেছিলেন এক কাপ স্টারবার্স্ট কফি খেতে। জনাকীর্ণ রেস্টুরেন্টে কেউই সাবেক গভর্নরের প্রতি নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বাংলাদেশি একজন ওয়েটার আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাওয়ায় সাবেক গভর্নর কোনো কথা না বলে দাম চুকিয়ে দিলেন এবং নীরবে জনারণ্যে হারিয়ে গেলেন।
ওয়েটার লক্ষ করল, গভর্নরের অক্ষিযুগল থেকে দুই ফোঁটা তপ্ত অশ্রু নির্গত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটিক দলীয় বহু প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদের শোচনীয় পরিণতির কথাও বিশ্ববাসীর অজানা নয়। মূলত প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে হাল আমলের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে উত্থানের চেয়ে পতন এবং শেষ রক্ষার চেয়ে শোচনীয় পরাজয়ের কাহিনিতে তা ভরপুর মানবসভ্যতার ইতিহাসের পৃষ্ঠাগুলো। বিশ্ব মানবগোষ্ঠীর এমনতর অন্তিম পরিণতির পটভূমিতে বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ওমর খৈয়াম বলেছিলেন, সুখের কোলে লালিত লক্ষপতি মাতা-স্ত্রী-পুত্র ছেড়ে নিতান্ত অকালে পরলোক গমন করছে। আর অশীতিপর বৃদ্ধা হা অন্ন হা অন্ন করে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে অথচ তার মৃত্যু হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেছেন, গৃহিণী হাঁড়ি নিয়ে কাজ করছে, হঠাৎ কোনো আঘাতে হাঁড়িটি ভেঙে গেলে তা দূরে ফেলে দেয়। কখনো সে ভগ্ন খোলার জন্য সুবর্ণ মন্দির তৈরি করে না। তুমি-আমিও বিশ্ববিধাতার দৃষ্টিতে মাটির হাঁড়ির তুল্য। কোনো কারণে তোমাকে আমাকে জগৎ-সংসার থেকে বিদায় নিতে হলে অপর লক্ষ লক্ষ কোটি জীব এসে তোমার আমার শূন্যস্থান পূরণ করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মানবাত্মা পরমাত্মারই অংশবিশেষ। দেহ পিঞ্জরে আবদ্ধ থাকলেও মানুষের অগোচরে পরমাত্মার সঙ্গে পুনর্মিলনের জন্য মানবাত্মা অহর্নিশ রোদন করে। তাই খোদাপ্রেমিকেরা দেহের খোরাকের চেয়ে আত্মার খোরাকের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন এবং পরমাত্মাতে বিলীন হয়ে অমরত্ব লাভ করেন। আর জগৎ-সংসারের মোহবিষ্ট আমরা পার্থিব মায়ামরীচিকার হাতছানিতে প্রলুব্ধ হয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের আশায় সারা জীবন ভ্রমের সাগরে সন্তরণ করি। আর আয়ু শেষে শূন্য ফলাফল নিয়ে পরকালে যাত্রা করি। (সমাপ্ত)
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, ঠিকানা, নিউইয়র্ক। ২৫ অক্টোবর ২০২২।