
খায়রুল আনাম : আজ আমার বেজায় খুশির দিন। এত খুশি যে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না। তাই ছোট মেয়ে খোঁজখবর নেবার জন্য ফোন করতে, হাতের কাছে পেয়ে তাকেই ঘটনাটা পড়িমরি হয়ে বলে ফেললাম। শুনে সে বলল, ‘ফুল সার্কেল?’ আমি বললাম, ‘তা তো জানি না। হবে হয়তো।’ আর হেঁয়ালি না রেখে গপ্পোটা বরং আপনাদের কাছে ঝেড়ে ফেলে হালকা হই। নাহ্, শেষের শব্দগুলো তেমন সভ্যভব্য ঠেকছে না, বরং আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি বললে মনে হয় মানানসই হয়। হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাদের সঙ্গেই। তা ছাড়া আর কার সঙ্গে করব, বলুন? আপনারা আমার বন্ধু না? অন্তত তা-ই তো বলে এসেছেন। আমিও সে বিশ্বাসে এখনো অটল হয়ে বসে আছি। তার থেকে নো নড়ন, নট চড়ন।
আপনারা যারা আমার ‘যাদবপুর ঘুরে এলাম’ নামের ভ্রমণকাহিনিটি ফেসবুকে বা ‘আগু ঘুরি-পিছু ফিরি, কিছু ভ্রমণ-কিছু স্মৃতি’ ভ্রমণকাহিনির বইয়ের মধ্যে ওটা পড়েছেন, গল্পটা মনে পড়ছে? অন্তত তার কয়েকটা লাইন? শুনুন, মনে না পড়লে অত কাঁচুমাচু করার কিছু নেই। আপনাদের কাছে চুপি চুপি বলি, আফটার অল, বন্ধু মানুষ তো, আপনাদের কাছে আবার লজ্জা কী? সত্যিটা হলো, আমার নিজেরও সেসব মনে নেই। তাই বইটা খুলে কয়েক লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি। ভাবুন, নিজের বই থেকে নিজেই টুকলিফাই করছি। ম’লেও স্বভাব যায় না বলে একটা কথা আছে না? খনার বচন কিনা জানি নে বাপু। তবে কথাটা মনে হয় মিথ্যা নয়। ব্যাপারটা ছিল, আমরা সবাই যাদবপুর থেকে আমাদের গ্র্যাজুয়েশনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুই দিনের একটা গোল্ডেন জুবিলী অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিলাম। এটাই হয়তো শেষ দেখা, মানে লাস্ট চান্স। কে কবে পটল তুলি বলা তো যায় না। তাই সবারই তাতে যোগদানে বেশ উৎসাহ ছিল। ইতিমধ্যে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ টেঁশেও গেছে। যাকগে সেসব কথা। তা লাইনগুলো ছিল মোর অর লেস, এ রকম :
‘…এরপর আমাদের আগের আয়োজন অনুযায়ী দ্বিতীয় দিন সবাইকে গেস্ট হাউসে নিয়ে ডিনারে আপ্যায়ন করা হলো। সাথে সাথে সোশ্যালাইজেশন পর্বও চলতে থাকল। আলাপের এক ফাঁকে আমাদের সময়ের এক টিচারকে হড়বড় করে একসঙ্গে অনেক কথা জিজ্ঞেস করি, ‘স্যার, আপনাকে আমাদের ক্লাসে পাবার এক বছর বা তার একটু বেশি সময়ের পরেই আমরা সব পাস করে বেরিয়ে যাই। সে জন্য অত বেশি করে আপনাকে আমরা পাইনি। রিটায়ার করার পর আপনি এখন কী করে সময় কাটান? কোত্থেকে পাস করেছিলেন? ছেলেমেয়ে কজন? তারা এখন কী করছে? আপনার শরীর কেমন?’ হুশ হুশ করে এতগুলো বাক্য একসঙ্গে বেরিয়ে গেল।
উনি বললেন, ‘আমি ভালোই আছি। এখন অনেক বই পড়ি। না না, ইঞ্জিনিয়ারিং না, গল্পের বই পড়ি। পাস করেছি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, শ্যাম্পেন থেকে। আর আমার একটাই মাত্র সন্তানÑমেয়ে। কোনো ছেলে নেই।’
প্রসঙ্গত বলি, অন্য আরেকজন প্রফেসর, যিনি এখনো একেবারে জোয়ানের মতো দেখতে, মনে হবে আমাদের এক ক্লাস সিনিয়র, তাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, তার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। শ্রীমানি স্যার কেবল বলেছিলেন, আমরা ঘন ঘন আসি না কেন?
যার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিনি ডক্টর ডিএনজি। তাকে আবার জিজ্ঞেস করি, ‘আপনার মেয়ে এখন কোথায় থাকে, স্যার?’
উনি বললেন, ‘আমার মেয়ে ও জামাই থাকে আমেরিকায়।’
‘কোন স্টেটে?’
‘ওই ইলিনয় স্টেটেই।’
‘ইলিনয়ে? ইলিনয়ের কোথায়?’
‘শিকাগোর একটা সাবার্বে।’
‘কী নাম?’
‘নেপারভিল।’
‘সে কী? কী আশ্চর্য! আমিও তো নেপারভিলে থাকি। তা ওখানে প্রায় সাতাশ বছর হতে চলল।’
এরপর যে আমি ওনার মেয়েজামাইয়ের নাম, ঠিকানা ও ফোন নাম্বার নিয়েছিলাম, সে কথা আর বইতে লেখা নেই। আমেরিকায় ফেরত এসে আমি প্রায় চার সপ্তাহ ধরে ওনার মেয়েজামাইকে খোঁজাখুঁজি করেছি। ফোন করেছি, টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছি, ই-মেইল করেছি। ইন্টারনেট থেকে ওদের নামধাম ফলো করে দেখেছি তারা শিকাগো, মাউন্ট প্রসপেক্ট, এলজিনেও ছিল। কিন্তু বর্তমান নিবাস নেপারভিলেই। তাহলে তাদের টিকির নাগাল না পাবার কারণ কী? তাহলে কি তারা কোনো ফরেন অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছে? এসব চিন্তা করতে করতে কেটে যাওয়া এই তিন বছরে ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
এখন রমজান চলছে। সাহ্্রি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে একটা ঘুম দিয়ে উঠতে একটু বেলা হয়ে গিয়েছিল। দেখি আমার সেল ফোনে কেউ একজন ফোন করেছিল। নাম্বারটা বেশ চেনা চেনা। কিন্তু কার নাম্বার তা ঠিক মনে করতে পারলাম না। দেখি একটা ভয়েস মেইল মেসেজও আছে। অন করে শুনলাম, ‘খায়রুল, আমি ডক্টর ডি এন ঘোষ বলছি। আমি এখন নেপারভিলে। আমার মেয়ে এই ফোনটা আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছে। ওরা হোয়াইট ঈগল ক্লাব সাব-ডিভিশনে থাকে। তুমি সময় হলে কোনো এক সময় এই নাম্বারে টেলিফোন কোরো। আর একটু ধরো, ওদের অ্যাড্রেসটাও দিচ্ছি।’
আমি তো অবাক। ডেঙ্গু স্যার এখানে? আমরা তখন উঘএ স্যারকে নিজেদের মধ্যে শয়তানি করে ডেঙ্গু স্যার বলে ডাকতাম। মনে হয়, আসল নামটা দীনেন্দ্র নাথ ঘোষটোষ হবে। তখন বেশির ভাগ প্রফেসরই ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসতেন। বাকিরা প্লেন প্যান্ট-শার্ট বা প্যান্টের ওপর একটা হাওয়াইয়ান শার্ট পরে আসতেন। কিন্তু ডেঙ্গু স্যার রোজই প্যান্ট-শার্টের ওপর একটা টাই পরে আসতেন। মেরুন রঙের। খুব ধীরে ধীরে কথা বলতেন। শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কেনেডির স্টাইলে চুল আঁচড়াতেন।
ম্যাপে দেখা গেল, ওনার মেয়ের বাড়ি আমার বাড়ি থেকে মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিটের রাস্তা। আমি ফোন ব্যাক করলাম। আমার গলার স্বর শুনে স্যার তো বেজায় খুশি। বললাম, ‘খুব ভালো লাগছে শুনে স্যার যে আপনি এসেছেন। আমি দু-এক দিনের মধ্যেই দেখা করতে আসব। এসে অনেক গল্প করব।’
উনি বললেন, ‘তো আজই আসো না কেন?’
ওনার উৎসাহ দেখে বললাম, ‘আজই আসব? আচ্ছা আজই আসছি।’
একটু পরে রেডি হয়ে ওনার মেয়ের বাড়ির মেইন গেটে গিয়ে কলিং বেল টিপলাম। কোনো সাড়া নেই। পরে আবার টিপলাম। কেউ এগিয়ে এল না। ফিরেই চলে আসছিলাম। তারপর দরজার মাঝখানের পুরু কাচের ভেতর দিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলাম। ভেতরটা ফাঁকা, কাউকে দেখাও গেল না। আরেকটু তলিয়ে দেখে মনে হলো, বাইরে কিছু লোক একসঙ্গে কী যেন করছে। ভাবলাম, একবার দেখে যাই। প্রতিবেশী হলে না হয় বলে যাব, আমি যে এসেছিলাম, এই খবরটা যেন ওদের দেয়। ঘুরে এসে দেখি, ওটা ওদেরই ব্যাকইয়ার্ড। আসলে সেখানে তারা মেমোরিয়াল ডেতে বার-বি-কিউ করছে। সঙ্গে প্রতিবেশী পরিবার। স্যারকে দূর থেকে চিনতে পেরে ভরসা পেয়ে এগিয়ে গেলাম।
হাত উঁচু করতে ওনারা আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। ওনার মেয়ে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এসে আমাদের বারান্দায় বসার জায়গায় নিয়ে এল। মেয়েটা বারবার আংকেল আংকেল বলছিল। বললাম, ‘তোমাদের অনেক খোঁজ করেছি, কিন্তু নাগাল করতে পারিনি। তোমাদের ফোন কি বদল হয়েছে?’ মেয়ে বলল, ‘না তো আংকেল, নেপারভিলে আসার পর থেকে ওই একই নাম্বার তো রয়েছে। আমরা ফোন পাল্টাইনি তো।’ তখন জামাই এসে বলল, ‘আমরা দুজনই সেল ফোন ব্যবহার করি। ল্যান্ড ফোনের কাছে আর যাওয়াই হয় না।’ বললাম, ‘লাইটটাও কি বিøংক করে না?’ ওরা বলল, ‘আসলে আমাদের ফোনে অ্যানসারিং মেশিন ফিচারটা নেই তো, তাই বিøংক করার জন্য কোনো লাইট নেই।’
স্যারের স্ত্রী এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমি মিসেস ঘোষ। চলুন, বসে গল্প করি। কী ড্রিংক নেবেন?’
বললাম, এখন কিছু না, পরে। তারপর আমাদের অনেক গল্প হলো। আমার কথা, ওনাদের কথা, অন্য স্যারদের কথা। অনেক স্যারকে নিয়ে যে মজা করতে আমরা বাজে বাজে নাম দিয়েছিলাম, কথা প্রসঙ্গে সেগুলো অকপটে বেরিয়ে পড়ল। খালি ওনার স্বামীর নামটা আর বলতে সাহস হয়নি। এক স্যারের নাম ছিল হরগোপাল গাঙ্গুলীÑঐএএ, তাকে আমরা হাগু বাবু বলে ডাকতাম। উনি নিজেও নাকি সে কথা জানতেন। শুনে ডিএনজি স্যার ও মিসেস স্যারের সে কী হাসি! তিপ্পান্ন বছর পর এই প্রথম স্যারকে প্রাণখুলে হা হা করে হাসতে দেখলাম। মিসেস ঘোষ, হাসার সময় লজ্জায় মুখটা গায়ের চাদরের এক কোণ দিয়ে ঢাকলেন। আমাদের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট, ডিন, রেক্টর (ভাইস চ্যান্সেলর), কারও কথাই বাদ পড়ল না। এমনকি আমাদের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টের ছেলে যে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে থাকে, সে যে আমার ছোট ভায়রা ভাইয়ের প্রতিবেশী ছিল, সে কথাও উঠে এল। মিসেস ঘোষ বললেন, ‘আপনাদের হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ও তার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল তো।’
মিসেস ঘোষ আরো অনেক গল্প করলেন। স্যার চুপচাপ হলে কী হবে, মিসেস বেশ সপ্রতিভ ও আলাপী। কেন আমি আমার মিসেসকেও সঙ্গে আনলাম না, সে ব্যাপারে মৃদু অনুযোগ করলেন। যাদবপুরে হয়তো কথা প্রসঙ্গে সে কথা কখনো উঠেছিল। স্যার তখনকার শোনা কথাটা মনে করে, আমার স্ত্রীকে না আনার কারণটা মিসেসকে জানালেন। মিসেস ঘোষ তখন দুঃখ প্রকাশ করলেন। আর এক যে প্রফেসরের কথা উল্লেখ করেছি, মিসেস ঘোষ জানালেন, তারও পতœীবিয়োগ হয়েছিল। তিনিও নাকি আমার মতো মুষড়ে পড়েছিলেন প্রায় এক বছরের মতো।
বললেন, ‘আমি ও ওনার ওয়াইফ খুব ক্লোজ ছিলাম। সেভাবেই আমরা দুই ফ্যামিলি এখনো খুব ক্লোজ।’
তিনি আমাকে আবার বললেন, ‘আপনি যে লেখক, আপনার কথা বলার ধরন দেখে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। অতি সাধারণ কথা এমন যে সুন্দর করে গুছিয়ে, রসালো করে বলতে পারেন, শুনতে খুব ভালো লাগে। আপনি প্রায়ই আসবেন। গল্প শুনব। এখানে দেখেন না, মেয়েজামাই কাজে চলে যায়। সারা দিন আমরা দুজন কী করি, বলুন তো? বসে বসে বোর হই। আপনি আসলে অনেক ভালো লাগবে।’
বললাম, ও রকম হয়। বেশি বয়সে এসে অ্যাডজাস্ট করা শক্ত। অনেক কেস আছে। আমার এক বন্ধুর মায়ের ও রকম হয়েছিল। বন্ধুর বাবা মারা গিয়েছিলেন। বাড়িতে মা একা। ওরা দুই ভাই আমেরিকায়। তাই মাকে নিয়ে চলে এসেছিল। মা এক মাস ধরে কান্নাকাটি করে ছেলেদের হাতে-পায়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোরা আমাকে পাঠিয়ে দে, বাবা। না হলে খুব সত্বর আমি মারা পড়ব।’ তাকে ওরা পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। আমার নিজের বাবারও একই অবস্থা হয়েছিল। তিনি দুবার গ্রিন কার্ড নষ্ট করেছেন। চলে গিয়ে আর আসতে চাননি। তৃতীয়বার গ্রিন কার্ড করাতে হয়েছিল। আরো অনেক কেস আছে।
মিসেস ঘোষকে অনেকবার বলেছিলাম, আমাকে ‘তুমি’ করে বলুন। আপনি আমার স্যারের মিসেস। কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত উনি আপনি আপনি করেই গেলেন। মনে হয়, পাকা চুল দেখে ওদিকে এগোতে তার ইতস্তত লাগছিল। একসময় লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলেন।
বললেন, ‘তো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার থেকে লেখক হলেন কী করে? আর কবে থেকে সেটা শুরু করলেন?’
উত্তরে একটু রসিয়ে বললাম, সে অনেক কথা। এমন অনেক বে-লাইনের লোক এই লাইনে মরতে আসে। আর লিখতাম ছাত্র বয়সে। তারপর বিদেশে এসে জীবনধারণ করার সংগ্রামে সবকিছু শিকেয় তুলে দিতে হয়েছিল। একবার এক বাংলাদেশি বার্ষিক মহাসম্মেলনের সেমিনারে একটা টপিকের ওপর স্পিচ দিয়েছিলাম। রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই এক সাংবাদিক আমার হাতে লেখা কাটাছেঁড়া স্ক্রিপ্টটা তাদের কাগজে ছাপাবার জন্য চেয়ে বসে। সেই থেকে আবার শুরু।
ইতিমধ্যে বারবার ওরা ‘এবার খাবারগুলো এনে দিই’ বলে সাধছিলেন। শেষে আমি বললাম, খাব, তবে এখনো দুই ঘণ্টার মতো দেরি আছে। শুনে ওনারা বললেন, ‘এটা কি তাহলে মানথ অব রামাদান, মানে রোজার মাস? বুঝেছি, আমার মেয়ের প্রতিবেশীরাও মুসলমান। তারাও রোজা করছে বলে শুনেছি। জানেন, আমরা অনেক দিন ইরাকে ছিলাম। সেখানে কিন্তু কেউ রোজা করত না। তবে দিনের বেলা আইন করে সব দোকানপাট বন্ধ রাখা হতো।’
এ কথাটা আমি আগে কোনো দিন শুনিনি। রোজার মাসে শুধু নয়, কখনো ইরাকে যাওয়া হয়নি তো। তাই ভেরিফাই করার উপায় ছিল না। শুনেছি, সাদ্দামের সময় ইরাকিরা খুব সেকিউলার ছিল। তাই বলে একটা আরব মুসলমান দেশে রমজান মাসে কেউ রোজা করত না, এটা বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। সেকিউলারিজমের সঙ্গে রোজা তো সাংঘর্ষিক নয়। তা ছাড়া সাদ্দাম ও তার সরকার তো সুন্নি ছিল, যদিও রোজার ব্যাপারে শিয়া-সুন্নি কোনো ম্যাটার করে না।
যা-ই হোক, উনি বললেন, ‘মেয়ের দুই প্রতিবেশীর একটা বাংলাদেশি পরিবার ও একটা পাকিস্তানি পরিবার। দুই বাড়ির বউদের সঙ্গে আমার মেয়ের একেবারে দহরম-মহরম, হরিহর আত্মা। বাংলাদেশিরা দুই বোন, একজন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য ধর্মের এক লোককে বিয়ে করেছে। আর অন্য বোনটি হিজাব পরে। আবার পাকিস্তানি বউটার বাবা-মা এসেছে। মা’টা হিজাব পরে।’
বললাম, এখানে সবাই কেমন মিলেমিশে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে থাকে। দেশ, ধর্ম কোনো ব্যাপারই নয়। কেন যে দেশে ওরা সেভাবে থাকতে পারে না!
উনি বললেন, ‘পাকিস্তানি পরিবারটা একটু অন্য রকম। আমাদের নেমন্তন্ন করাতে ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। অনেক খাবারদাবারের আয়োজন। কিন্তু মেয়ের বাবা-মা টেবিলে ঠিক বসতে চাচ্ছিলেন না। ক্ষিধে নেই, পরে খাব বলে দূরে দূরে থাকলেন। সেটা শোধ দিতে আমার মেয়ে ওদের পাল্টা নেমন্তন্ন করেছিল। ওর বাবা-মা নানা অজুহাত দিয়ে, এখন না পরে, এসব বলে কেবল দিন পেছাচ্ছিলেন।’
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি বললাম, কিছু লোকের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম প্রেজুডিসটা এখনো রয়ে গেছে। ইন ফ্যাক্ট, ইদানীং সেটা কিছু বেড়েছে বলে মনে হয়। হিজাব নিকাব পরাও ইদানীং অনেক বেড়েছে। আগে এগুলো প্রায় ছিল না বললেই চলে। থাকলেও খুব লিমিটেড ছিল। সেই সঙ্গে বাইরের পোশাক ছাড়া ভেতরের ঘৃণাও বেড়েছে।
উনি বললেন, ‘সেটা হিন্দুদের মধ্যেও বেড়েছে। ইদানীং আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও পুরোহিতরা মন্দিরে ঢুকতে দেয়নি, উনি মসজিদে মসজিদে ঘুরে বেড়িয়েছেন বলে।’
যা-ই হোক, এই একেবারে মনখোলা, প্রাণঢালা আলোচনার মধ্যে মজার ঘটনাটা হচ্ছে, আমার সদ্য প্রকাশিত ভ্রমণকাহিনির বইয়ের কয়েকটা কপি এ মাসের (মে ২০১৭) নিউ ইয়র্ক বইমেলা উপলক্ষে মোড়ক উন্মোচনের জন্য ঢাকা থেকে আনানো হয়েছিল। তার মধ্যে দুটি কপি আমি নিউ ইয়র্ক থেকে সঙ্গে করে শিকাগোতে নিয়ে আসি। সেখান থেকে এক কপি নিজের অটোগ্রাফ দিয়ে স্যারকে প্রেজেন্ট করার জন্য সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যার ও মিসেস ঘোষ সেটা দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন এ কারণে যে পঞ্চাশ বছর পরে স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়া ও সেই সাক্ষাতের কথা আমার লেখা বইতে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সেই বইটা অটোগ্রাফ দিয়ে নিজ হাতে তাকে প্রেজেন্ট করছি, যার ভেতরে তারই কথা রয়েছে। আর আমারও মনে অনেক খুশি লেগেছে যে প্রায় তিপ্পান্ন বছর পরে আমার একজন শিক্ষক সম্বন্ধে কিছু লেখা বইটি নিজ হাতে তাকে প্রেজেন্ট করতে পেরেছি।
ইহাকে কি ‘ফুল সার্কেল’ বলিয়া ধরা যাইতে পারে?
শিকাগো।