মরিন ডডের কথা নিশ্চয় অনেকের মনে আছে। পুলিটজার পাওয়া নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট ছিলেন। তার কলামগুলো ছিল একধরনের মসাল্লা। রাজনীতি, হলিউড আর জেন্ডার মিশিয়ে এই মসাল্লা তৈরি করলেও তার ভেতরের যে অসূয়া তা গোপন থাকেনি। তার অসূয়ার সবচেয়ে বড় শিকার ছিলেন হিলারি ক্লিনটন। ২১ বছর ধরে, অর্থাৎ ১৯৯৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মরিন ডড ১৪১টি কলাম লিখেছিলেন হিলারির বিরুদ্ধে। হিলারি কিন্তু তার কোনো উত্তর দেননি। উত্তর দিয়েছিলেন অন্যরা। শেষ পর্যন্ত মরিনকে বিদায় নিতে হয় মাথা নিচু করে।
১৯১৮ সালে সেরা সাংবাদিকতার জন্য পুলিটজার প্রাইজ চালুর সময় থেকে এ পর্যন্ত নিউইয়র্ক টাইমস সর্বাধিক ১২২ বার এই সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছে। ১৮৫১ সালে যাত্রা শুরু হলেও নিউইয়র্ক টাইম কোম্পানি ১৮৯৬ সালে দেউলে হয়ে যায়। সেই দেউলে কোম্পানি কিনে নেয় এ জি সুলজবার্গার পরিবার। আজ এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছে তাদের চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্ম। আমেরিকার জার্নালিজম স্কুলগুলোতে নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টিং ও কলামগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। বিশ্বজুড়ে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি রয়েছেন ১৩০০, তাদের পাঠানো প্রতিবেদন তিন ধাপে ভেটিং করা হয়। চতুর্থ ধাপটি লেগাল। একসময় আইনবিদ দিয়ে পরীক্ষা করা হতো। তখন ল পড়তে গেলে সাংবাদিকতার আইনি দিক নিয়ে এক পেপার ছিল। এখন জার্নালিজমেই আইন একটি পেপার। নিউইয়র্ক টাইমসকে বলা হয় ফাইনেস্ট জার্নালিজম বা এক্সিলেন্স অব জার্নালিজমের প্রতিভ‚।
তার অর্থ কি এই যে নিউইয়র্ক টাইমস ভুল করে না? একপেশে খবর ছাপে না? প্যালেস্টাইন প্রশ্নে তারা কি সাহস দেখাতে পেরেছে? এন্টাই সেমিটিক হওয়ার ভয়ে কি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোরালো হতে পেরেছে? মরিন ডডের একপেশে কলামের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হওয়া কি কেবলই ফ্রিডম অব স্পিচের সুগার কোটিং? তাহলে কেন লিবারেল কলামিস্ট নোয়াম চমস্কির লেখা ছাপার সৎ সাহস দেখায় না নিউইয়র্ক টাইমস? কেন বিলিয়ন ডলারের বিজ্ঞাপন হারানোর ভয়ে ফেডারেটেড স্টোর মেসিসের হিউম্যান রিসোর্সেস ডিভিশনে যৌন হয়রানির খবর চেপে গেছে? আজও কেন নাইন ইলেভেনের ঘটনার নেপথ্যের ঘটনাকে উন্মোচন করতে সচেষ্ট হলো না? পানামার চার্চে লুকিয়ে থাকা প্রেসিডেন্ট নরিয়েগাকে মার্কিন সৈন্যরা যখন কমান্ডো স্টাইলে আক্রমণ চালিয়ে একটি সার্বভৌম দেশ থেকে ধরে নিয়ে এল আমেরিকায়, তখন নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবাদ করেনি। এমনকি সেক্রেটারি অব স্টেট জেনারেল কলিন পাওয়েল যখন জাতিসংঘে গিয়ে মিথ্যা গ্রাফিক্স প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে ইরাকে পরমাণু অস্ত্র আছে এই অজুহাতে একটি দেশ আক্রমণ করল, তখনো নিউইয়র্ক টাইমস নিশ্চুপ ছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস জানত তরুণ রিয়েল এস্টেট মোগল ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্য আর্ট অব দ্য ডিল (১৯৮৭) বইটি গোস্ট রাইটার টনি সোয়ার্টৎজকে দিয়ে লেখানো। ১৯৮৮ সালে নিউইয়র্ক টাইমস প্রথম পাতায় খবর ছেপে ফুলের ভাষায় এর প্রশংসা করেছে। ট্রাম্পের সাক্ষাৎকার ছেপেছে এবং তার নামটি ঘরে ঘরে পরিচিত করে তুলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্ক টাইমস সম্পর্কে জানতেন। তাই প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। টাইমস যখন প্রথম তার বিরুদ্ধে খবর ছাপল, তখনই ট্রাম্প বলে বসলেন, ওদের বিশ্বাস করো না, ওরা সব ভুয়া খবর ছাপে। এরপর মেগান কেলিকে আক্রমণ করলেন প্রথম বিতর্কেই। ফক্স নিউজ ট্রাম্পের পাশে দাঁড়াল। মেগান কেলি ফক্স ছেড়ে দিলেন। তারপর সিএনএনএর ডন লেমন, এনবিসির চাক থাগ ইত্যাদি। আর আমেরিকান আরবান রেডিও নেটওয়ার্কসের ওয়াশিংটন ব্যুরো চিফ এপ্রিল বায়ানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বাহাস ছিল দীর্ঘদিন আলোচনার বিষয়।
তবে এ কথাও তিনি জানেন, ভুল খবরের জন্য বিশাল ব্যক্তিত্বের টিভি সংবাদ অ্যাংকার সিবিএসের ড্যান র্যাদার বা এনবিসির ব্রায়ান উইলিয়ামসের চাকরি হারানোর কথা। আবার এ কথাও ডোনাল্ড ট্রাম্প জানেন, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রাতিষ্ঠানিকতা কত শক্ত ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে। নির্বাচনের আগে বেশির ভাগ টুইট বার্তায় নিউইয়র্ক টাইমসের খবরকে ফেক নিউজ বলে বলে গোয়েবলসীয় থিয়োরি অনুসরণ করলেও ৭ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ১৬ দিন পর নিউইয়র্ক টাইমস অফিসে গিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়ে শেষ মন্তব্য করলেন এভাবে, ‘ঞযধহশ ুড়ঁ ধষষ, াবৎু সঁপয, রঃ’ং ধ মৎবধঃ যড়হড়ৎ. ও রিষষ ংধু, ঃযব ঞরসবং রং, রঃ’ং ধ মৎবধঃ, মৎবধঃ অসবৎরপধহ ঔববিষ. অ ড়িৎষফ লববিষ, অহফ ও যড়ঢ়ব বি পধহ ধষষ মবঃ ধষড়হম, ডব’ৎব ষড়ড়শরহম ভড়ৎ ঃযব ংধসব ঃযরহম, ধহফ ও যড়ঢ়ব বি পধহ ধষষ মবঃ ধষড়হম বিষষ.’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কথা রাখেননি। নিজের কথাকে নিজেই অসম্মান করেছেন। বলেছেন, ভুয়া খবর ছাপার জন্য নিউইয়র্ক টাইমস পাঠক হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে। এই তথ্য সঠিক নয়। ট্রাম্প বলেছেন, এখন আর সংবাদপত্র পড়ার বা টিভি দেখার প্রয়োজন নেই। ২০১২ সালেই এক টুইট বার্তায় তিনি লিখেছিলেন, গু ঃরিঃঃবৎ ভড়ষষড়বিৎং রিষষ ংড়ড়হ নব ড়াবৎ ২ সরষষরড়হ…্ ধষষ ঃযব নরমমরবং. ওঃ’ং ষরশব যধারহম ুড়ঁৎ ড়হি হবংিঢ়ধঢ়বৎ. আর ২০১৭ সালের অক্টোবরে তার টুইটার ফলোয়ার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১.৩ মিলিয়নে। তবে দ্য ডেইলি ডট ফাঁস করে দেয়, এর অর্ধেকই ফেক বা অকার্যকর। ট্রাম্প সে কথা স্বীকার করতে চান না। তিনি মনে করেন, তার টুইট বার্তাই সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। অর্থের মতো সেটাও তার দম্ভের জায়গা। সেই দম্ভের কারণেই তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন এবং নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো পত্রিকা বা আমেরিকার তিনটি নেটওয়ার্ক চ্যানেল এবং সিএনএন, এমএসএনবিসিকে ফেক নিউজ দেওয়ার কারখানা বলতে পারেন। বিষয়টি এ রকম, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না, লেখা যাবে না, যারা বলবে বা লিখবে তারাই ভুয়া। আর যারা তার পক্ষে তারা দ্য বেস্ট। শুধু গণমাধ্যমের জন্য নয়, যে ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে কথা বলবে তারা জঘন্য মানুষ আর যারা তার পাশে থাকবে তারাই সেরা। তবে তিনি লেটনাইট শোগুলো দেখেন না। দেখলে সহ্য করতে পারতেন না। যদিও তিনি বলেছেন রেচেল ম্যাডোকে তিনি পাত্তাই দেন না। না দেওয়ার কারণ রেচেল বিপুল জনপ্রিয়। জনপ্রিয় হওয়ার কারণ রেচেল ম্যাডো শো প্রচÐ পটেনশিয়াল। ট্রাম্প নিজেই বলেছেন সিএনএনের লেটনাইট টক শোকে তিনি ঘৃণা করেন। বুঝতে অসুবিধে হয় না, তিনি ডন লেমনের কথা বলেছেন। যেমন ফেক নিউজ অ্যাওয়ার্ডে তিনি নোবেল প্রাইজ পাওয়া ম্যাক্রোইকোনমিস্ট নিউইয়র্ক টাইমস কলামিস্ট পল ক্রুগম্যানকে অ্যাওয়ার্ড দিয়েই বুঝলেন ভুল করে ফেলেছেন। অতএব, টুইট বার্তায় এই পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তা ডিলিট করে দেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি। কিন্তু ইচ্ছা করলেই সবকিছু করতে পারেন না। সংবিধান আছে। সংবিধানে ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট সাংবাদিকদের রক্ষাকবচ। তিনি প্রগলভের মতো তাদের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করতে পারেন, তার বিরুদ্ধের খবরকে ফেক নিউজ বলতে পারেন, কিন্তু গলা চিপে ধরতে পারেন না। তাই তার অস্ত্র কেবল বাতচিতে। ফেক নিউজ ফেক নিউজ বলে আমেরিকা যে কটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ব করে, তার প্রাতিষ্ঠানিকতার গায়ে কালি মাখিয়ে দিতে চাচ্ছেন তিনি। হিটলার নিজে না করলেও তার দক্ষিণহস্ত প্রপাগান্ডা মিনিস্টার পল জোসেফ গোয়েবলসকে দিয়ে একটি সত্যকে প্রচারযন্ত্রে দশবার মিথ্যা বললে তা শেষ পর্যন্ত শ্রোতাদের বিভ্রান্ত করে এই থিয়োরিকে প্রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর স্বৈরাচাররা সেই থিয়োরি শিরোধার্য করেছেন। বাংলাদেশেও এই থিয়োরি নিয়ে খেলা আমরা দেখেছি পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও সেইসব জননন্দিত গণমাধ্যমকে ভুয়া নিউজের কারখানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এর জন্য তিনি কোনো বরকন্দাজ নেননি। যে বরকন্দাজকে নিয়োগ দিয়েছিলেন, সেই অ্যান্থনি স্কারামুচি এক সপ্তাহও ঠিকতে পারেননি হোয়াইট হাউসে। তাই তিনি নিজেই গোয়েবলসের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সত্য যে কঠিন তারে ভালোবাসিলাম। কঠিন হলেও সত্য চিরায়ত, চিরঞ্জীব। মিথ্যা ক্ষণস্থায়ী। হয়তো সেই ক্ষণস্থায়ী মিথ্যার জেল্লা আছে, ক্ষণস্থায়ী মিথ্যার জেল্লাও ক্ষণস্থায়ী। নিউইয়র্ক টাইমসের যেটুকু দোষ, সেটুকু ২৪ ক্যারট সোনায় ২ ক্যারট খাদের মতো। ওই খাদটুকুর প্রয়োজন আছে। কারণ পৃথিবীতে ১০০ ভাগ পারফেকশন সোনার পাথর বাটি। যে ইনস্টিটিউশন গড়ে উঠে শতাধিক বছর ধরে, তা অনেকটা পুড়িয়ে সোনা খাঁটি হওয়ার মতো। গোয়েবলস ইতিহাসে নিজেই একটি প্রবাদ হয়ে আছেন, যে প্রবাদটি নেতিবাচক, মানবসমাজবিরোধী। আর আমেরিকার বা যেকোনো দেশের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের স্থায়িত্ব নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে। তাদেরও চলে যেতে হয়। নিউইয়র্ক টাইমসের মতো প্রতিষ্ঠান মানবসভ্যতার মশাল নিয়ে এগিয়ে যাবে দীর্ঘকাল। সময়ের বিচারে প্রমাণিত হবে কে ফেক, কে ফেক নয়।
সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাঙালী, নিউ ইয়র্ক।