রাঙ্গামাটি : মাত্র এক দিনের ব্যবধানে শক্তিমান ও তপনজ্যোতি পার্বত্য আঞ্চলিক রাজনীতির দুই শীর্ষ নেতাসহ ছয় খুনের ঘটনায় সন্দেহের তীরে বিদ্ধ হচ্ছে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। তবে ইউপিডিএফের পক্ষে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলা হচ্ছে- তারা নন, তৃতীয় কোনো পক্ষ এসব হত্যাকা- ঘটিয়েছে। তৃতীয় পক্ষ বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন- ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমার কাছে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সেটা আমরা জানি না। যাদের দায়িত্ব, তারাই এটা খুঁজে বের করুক।
ইউপিডিএফের বলা তৃতীয় পক্ষের তত্ত্ব পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। গত ৪ মে ও ৫ মে রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন ধারণাই পাওয়া গেছে। অন্তত চারটি ধারায় বিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনীতি এবং সর্বশেষ সংঘাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) ছাড়া বাকি তিনটিই প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। জেলা শহরের স্টেডিয়ামসংলগ্ন গয়া স্টোরে চা পান করতে ঢুকেই শোনা গেল, চায়ের কাপে আড্ডার বিষয়ও দুদিনে ছয় খুন হওয়ার ঘটনা।
কারা এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে এ নিয়ে জানতে চাইলে আড্ডার একজন পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ইউপিডিএফ, সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিকরা দুর্বল হলে লাভ কার? ইঙ্গিত দিয়েই থেমে গেলেন পাহাড়ি ওই ভদ্রলোক। এটাই থমথমে পার্বত্য জেলা রাঙামাটির অবস্থা। জেএসএসের মূলধারার কথা বলতে চেয়েছেন কি না জিজ্ঞেস করতেই কোনো উত্তর না দিয়ে চায়ের দোকান ছেড়ে চলে গেলেন পাহাড়ি ওই লোকটি। তবে রেখে গেলেন অনেক ইঙ্গিত। আগামী সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি আসনে শক্তিমান চাকমার প্রার্থী হওয়ার কথা ছিল, গত দুদিন অনেকেই এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে জানতে চেয়েছেন, শক্তিমান না থাকলে লাভ কার? আসনটির বর্তমান সাংসদ পিসিজেএসএসের। নভেম্বর থেকে বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের পরও পিসিজেএসএস আশ্চর্য রকমের নীরব রয়েছে। সমকালের পক্ষে দলটির সহতথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি স্পষ্টতই এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তার বক্তব্য, এটি আমাদের বিষয় নয়। তবে তিনি আরও বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই পাহাড়ে শান্তি আসেনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আগ পর্যন্ত পিসিজেএসএসই ছিল পাহাড়িদের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন। ১৯৯৭ সালে চুক্তির পর দলটির চুক্তিবিরোধী বলে পরিচিত অংশটি পিসিজেএসএস ভেঙে ইউপিডিএফ নামে নতুন দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শুরু থেকেই ইউপিডিএফ তাদের আদি সংগঠন পিসিজেএসএসের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়। পরে আবার ১/১১-এর সরকারের আমলে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমার নেতৃত্বাধীন পিসিজেএসএসও ভেঙে যায়। নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত ওই দলটির ভাঙা অংশের নেতা। পাহাড়ের মানুষের কাছে সংস্কারপন্থী নামে পরিচিত এই দলটি নিজেদের জেএসএস (এম এন লারমা) নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। তপনজ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মা গত বছর নভেম্বরে ইউপিডিএফ থেকে ভাগ হওয়া গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের প্রধান।
গত ৩ মে শক্তিমান চাকমা নিহত হওয়ার পরপরই একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে আলাপে শক্তিমানের দল সংস্কারপন্থী জেএসএসের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সুধাকর ত্রিপুরা হত্যাকারী হিসেবে অর্পণ চাকমা বলে একজনের নাম জানিয়েছিলেন। পরে আবার সুধাকর ত্রিপুরা স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, হত্যাকারী সাজেক ইউনিয়নের মাচালং দীপুপাড়া এলাকার লক্কোচ চাকমা, যার ডাকনাম বাবু চাকমা, তারই দলীয় নাম অর্পণ চাকমা। বিবৃতিতে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে ইউপিডিএফের সভাপতি প্রসিত বিকাশ খীসা, সাধারণ সম্পাদক রবিশংকর চাকমাসহ আরও দুই শীর্ষস্থানীয় নেতা আনন্দ প্রকাশ চাকমা ও রঞ্জন মণি (আদি) চাকমার নাম জানানো হয়েছে। তপনজ্যোতি নিহত হওয়ার পরপর ঘটনাস্থলেই তার দীর্ঘদিনের সহযোগী ও দেহরক্ষী ঝিমিত চাকমার সঙ্গে দেখা হলে তিনি এ ঘটনার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করেছিলেন। অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের মিডিয়া উইংয়ের কর্মী লিটন চাকমা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লিটন তপনজ্যোতি হত্যার জন্য প্রসিতের নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফকে দায়ী করেন। সর্বশেষ গত ৫ মে খাগড়াছড়িতে তপনজ্যোতি ও তার সঙ্গে নিহত অন্য তিনজনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগে সংস্কারপন্থী জেএসএসের রাজনৈতিক সম্পাদক বিভুরঞ্জন চাকমা সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রসিত খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফকে দায়ী করে দলটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।
জানা যায়, ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর আলাদা রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ইউপিডিএফ খাগড়াছড়ি জেলার বাইরে শুধু রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলাতেই সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারত। ২০০৭ সালে ১/১১-এর সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা রাঙামাটিতেও একের পর এক উপজেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এমনকি রাঙামাটি শহরেও একাধিকবার বিশাল শোডাউন করে সংগঠনটি। শহরের রিজার্ভ বাজারে নিজেদের নতুন অফিস নিয়ে কার্যক্রমও শুরু করে।
কিন্তু জরুরি অবস্থা শেষ হতেই পাল্টা আঘাত হানে পিসিজেএসএস। ইউপিডিএফের কাছ থেকে উপজেলাগুলোর পুনর্নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। তবে রাঙামাটি সদরের কুতুকছড়ি, নানিয়ারচর উপজেলার সবটুকু, কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া বাজারের দক্ষিণ রাস্তা ছাড়া পুরো উপজেলা ও বাঘাইছড়ির একাংশ, লংগদুর কাট্টলিসহ কিছু এলাকায় এখনও ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ১/১১-এর সরকার ক্ষমতায় থাকাকালেই পিসিজেএসএস ভেঙে গঠিত হয় জেএসএস (এম এন লারমা)। সাধারণের কাছে পিসিজেএসএস জেএসএস মূলধারা এবং জেএসএস (এম এন লারমা) সংস্কারপন্থী জেএসএস নামে পরিচিত। সংস্কারপন্থিরা শুরু থেকেই ইউপিডিএফের আনুকূল্য পেয়েছে এবং রাঙামাটির নানিয়ারচর ছাড়াও খাগড়াছড়ির কিছু এলাকায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। কিন্তু সর্বশেষ প্রসিত বিকাশ খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের ভাঙনে প্ররোচনা দেয় সংস্কারপন্থী জেএসএস। গত বছর নভেম্বরে গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ নামের আরেক আঞ্চলিক পাহাড়ি সংগঠনের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে ইউপিডিএফের ভাঙন চূড়ান্ত হয় এবং এরপরই পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হতে থাকে।
নতুন এই সংগঠনটির আত্মপ্রকাশের মাত্র ২০ দিনের মাথায় ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়ারচরে সাবেক ইউপি সদস্য ও ইউপিডিএফ নেতা অনাদি রঞ্জন চাকমাকে হত্যা করা হয়। তাকে হত্যার ১১ ঘণ্টার ব্যবধানে পৃথক ঘটনায় জুরাছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরবিন্দু চাকমাকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ১৫ ডিসেম্বর রাতে ধামাইছড়া এলাকায় ইউপিডিএফের সংগঠক অনল বিকাশ চাকমা ওরফে প্লুটো খুন হন প্রতিপক্ষের গুলিতে। ১০ মার্চ মধ্যরাতে জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলীর বালুখালী নামক পাহাড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ নেতা নতুন মণি চাকমাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। খাগড়াছড়িতে ৩ জানুয়ারি আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ইউপিডিএফ সংগঠক মিঠুন চাকমা গুলিতে নিহত হন। ১৭ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি সদরের হরিনাথপাড়া এলাকায় প্রতিপক্ষের গুলিতে ইউপিডিএফ কর্মী দীলিপ কুমার চাকমাকে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দীঘিনালা জামতলি এলাকায় সাইন চাকমা ওরফে সুপারকে হত্যা করা হয়।
গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ আত্মপ্রকাশের পর থেকেই একের পর এক হত্যা এবং অবশেষে অপহরণও করে ইউপিডিএফ সমর্থিত হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই নেত্রী মন্টি চাকমা ও দয়াসোনা চাকমাকে। ওই অপহরণ মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছিল শক্তিমান চাকমাকে। দুই নম্বর আসামি ছিলেন গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের প্রধান তপনজ্যোতি চাকমা। তপনজ্যোতির সঙ্গে নিহত তিনজনই জেএসএসের নেতা। দুই দলের নেতাদের একসঙ্গে শক্তিমানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যাওয়ার মধ্য দিয়েও দল দুটির আঁতাত বোঝা যায় এবং সর্বশেষ গত ৫ মে দুই দল মিলেই তপনজ্যোতিসহ নিহতদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন।
শক্তিমান ও তপনজ্যোতি দুজনের হত্যাকাণ্ডে স্বয়ংক্রিয় অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। এসব অস্ত্র কিভাবে পাচ্ছে এই দলগুলো এ নিয়ে কথা হয়, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। দীর্ঘদিন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাতের বিষয়ে নজর রাখছেন তিনি। তার মতে, শান্তি চুক্তির অধীনে পাহাড়ি সব সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়নি। নানা অভিযোগ এবং দাবির বিষয়ে পাহাড়িরা এখনও সোচ্চার। এই প্রশ্নে বাঙালি-পাহাড়ি এবং পাহাড়ি-পাহাড়িরা সংঘাতে লিপ্ত রয়েছেন। তিনি বলেন, শান্তি চুক্তির পর শান্তি বাহিনীর অনেকেই অস্ত্র জমা দেননি।
শান্তি চুক্তি অনুষ্ঠানেই পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের সেøাগান দিয়ে চুক্তির বিরোধিতা করেছিল ইউপিডিএফ। চুক্তির দুই দশক পরও লাশের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। চুক্তির সময় জমা না দেওয়া অস্ত্রগুলো রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর হাতে এবং এগুলোর সঙ্গে তাদের ভা-ারে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন অস্ত্র। পাহাড়ে চাঁদাবাজি থেকে আসা অর্থ দিয়ে এসব অস্ত্র কেনা হচ্ছে। পাহাড়ে যে চাঁদাবাজি হয় সেটা ওপেন সিক্রেট। নগদ টাকার বিনিময়ে আসে মাদক ও অস্ত্র। কোত্থেকে অস্ত্র আসছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যের অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র আসতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সঙ্গে রয়েছে মিয়ানমারের স্থল সীমান্তও।