ফের ফ্যাক্টর খালেদা আড়ালে নানা খেলা

বৃত্তবন্দী আ’লীগ-বিএনপি * সুদিনের অপেক্ষায় জামায়াত

বিশেষ প্রতিনিধি : কর্মক্ষম খালেদা জিয়ার চেয়ে বেশি ফ্যাক্টর হয়ে উঠছেন ৭৮ বছর বয়সী অসুস্থ খালেদা জিয়া। কেবল তার নিজের দল বিএনপি বা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নয়; আরো নানা শক্তির কাছে তাকে নিয়ে অনেক হিসাব-নিকাশ। কেউ নিচ্ছেন ‘কৌশল’, কেউ পাতছেন ‘ফাঁদ’। আবার সমীকরণ মেলানোর পক্ষও আছে। রুটিন চেকআপের অংশ হিসেবে ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃৎপিণ্ডে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যার আপডেট অবস্থা জানতে এক্সরে, সিটি স্ক্যান, রক্তসহ বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়া জরুরি বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। খালেদা জিয়া হাসপাতালের উদ্দেশে বের হওয়ার আগে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের কয়েকজন নেতা তার বাসভবনে যান। তারা কথা বলেন কিছুক্ষণ। এর আগে সর্বশেষ খালেদা জিয়াকে গেল বছরের ২৮ আগস্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে বাসায় নেওয়া হয় ৩১ আগস্ট। চিকিৎসা শেষে বাসভবনে ফেরেন তিনি। গত দুই বছরে অসুস্থতা নিয়ে তাকে ছয়বার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
এবার হাসপাতালের শিডিউল তারিখের আগে খালেদা জিয়াকে নতুন করে সাবজেক্ট বানিয়ে দেয় সরকার। অনেকটা আগ বাড়িয়ে আইনমন্ত্রী কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই গণমাধ্যমকে জানান, খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন, তবে নির্বাচন করতে পারবেন না। তথ্যসহ কয়েক মন্ত্রী বলেন, তিনি রাজনীতিও করতে পারবেন না। এর কদিন আগে প্রভাবশালী সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, শেখ পরিবারের ক্ষমতাশালী সদস্য শেখ সেলিম নিশ্চিত করে বলেছিলেন, খালেদা জিয়া রাজনীতি-নির্বাচন কোনোটাই করবেন না মর্মে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে বের হয়েছেন। তার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ ধরনের কোনো শর্তের বিষয় ছিল না খালেদা জিয়ার জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে। খালেদা জিয়াকে নিয়ে মন্ত্রীসহ সরকারের এমন অতিকথন ও উদ্বেগের পেছনের মাজেজা জানে বিএনপি। দলটির নেতাদেরকে মন্ত্রীদের এসব কথার পিঠে কথা না বলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েক জায়গা থেকে। বলে দেওয়া হয়েছে এর পেছনের রহস্য ও সরকারের উতলা হওয়ার নেপথ্য তথ্য।
বিএনপিকে নির্বাচনে আনা, রাজনীতিতে আরো কাহিল করে তোলাসহ অনেক অ্যাজেন্ডা সরকারের। তার ওপর বিএনপির সাম্প্রতিক কিছু কূটকৌশল সরকারকে ভাবিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিটি স্থানিকের আওতা ছাড়িয়ে হয়ে গেছে বৈশ্বিক বিষয়। যার প্রকাশ ঘটছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের চাপের মধ্যে। বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনকে এক নম্বর শর্ত করছে তারা। এর বিপরীতে সরকারের শীর্ষ মহল থেকেও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওয়াদা শোনানো হচ্ছে বিদেশিদের। কিছুদিন ধরে যেসব বিদেশি হাইপ্রোফাইল এসেছেন, তাদের সবাইকেই আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস শোনানো হচ্ছে সরকারের তরফে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের বিচারের তালগাছটা প্রকারান্তরে বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে প্রায়। অনেকটা বাধ্য হয়ে সরকারকে বিদেশিদের কাছে আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে মর্মে ওয়াদা করতে হচ্ছে। এর মাত্র কদিন আগে নির্বাচন প্রশ্নে বিদেশিদের কোনো কথা শোনা হবে না বলে সাহসী ও স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। কদিনের ব্যবধানেই এখন সেই বিদেশিদের কাছেই সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিতে হচ্ছে সরকারকে। বিদেশিরাও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নির্বাচনের কথা বেশি বেশি টেনে আনছে। অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের নসিহত করছে। সরকার বা সরকারি দল তা অগ্রাহ্য করছে না। বলছে না এসব সবক তারা শুনবে না। উপরন্তু কথা দিচ্ছে। সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওয়াদা দিচ্ছে। গোটা বিষয়টি একদিকে সাংঘর্ষিক, আরেকদিকে বিএনপির জন্য বেশ পুলকের। তার ওপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার আশঙ্কার বোমা ফাটিয়ে বলেছেন, সব দল না এলে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বড় দুই দলসহ বাদবাকিদেরও নিজেদের ‘গ্যাপ’ দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন। বড় রকমের বার্তা রয়েছে তার এই আহ্বানের মধ্যে। সেই উপলব্ধি থেকে মাস কয়েকের ব্যবধানে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে সরকারের নানা পদক্ষেপ এখন ওপেন সিক্রেট। সেই সঙ্গে চাতুরীও স্পষ্ট। বিএনপিও এখন পর্যন্ত খেলছে ঠান্ডা মাথায়। বড় দুই দলের এই কৌশল ও পরস্পরকে ঘায়েলের ফাঁকে জামায়াতে ইসলামী খেলছে আরো বিচক্ষণতায়। সময়োপযোগী কিছু ছক রয়েছে তাদের। সরকারের দিক থেকে কঠিন পরিস্থিতির শিকার দলটি। জেল-জুলুমসহ নানা নিপীড়নে কাহিল দলের আমির, সেক্রেটারি জেনারেল থেকে শুরু করে তৃণমূলের নিরীহ কর্মী পর্যন্ত। আবার মিত্রসঙ্গী বিএনপির কাছেও উপেক্ষিত জামায়াত। বিএনপির একটি অংশ তাদের স্পেস দিতে চায় না। তাচ্ছিল্যের শিকারও হচ্ছে কখনো কখনো। জোট পর্বের পর যুগপৎ আন্দোলনের শরিক হয়ে বিএনপি-ঘোষিত কর্মসূচির দিনে কোথাও কোথাও তাদের ভূমিকা আরো জোরালো হচ্ছে, যা সরকারকে ঘাবড়ে দিলেও বিএনপির কাছে সেভাবে আমল পাচ্ছে না।
কঠিন এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে জামায়াত আন্দোলনের মাঠে থাকার পাশাপাশি নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াচ্ছে বিভিন্ন উইংয়ে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন আছে কি নেই, তা নিয়েও ভাবছে না। সরকার দল নিষিদ্ধ করে দিলেও এ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত না হওয়ার সিদ্ধান্তে চলে গেছে জামায়াত। সরকারের দিক থেকে বিএনপির সঙ্গ ছাড়াসহ কিছু শর্তে জামায়াতকে নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়াসহ আরো বিশাল প্রাপ্তির টোপও রয়েছে। জামায়াত জানে, সরকার চাইলেই তাদের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। কেন করে না, তাও জানে। বর্তমান এ কঠিন সময়েও সরকারের অফার লুফে ভবিষ্যৎ কলঙ্ক না কুড়ানোর সিদ্ধান্তে অটল জামায়াতের শীর্ষ থেকে তৃণমূল। তাদের বিশ্বাস, বিএনপির চেয়েও তাদের সাংগঠনিক গাঁথুনি বেশি শক্তপোক্ত। তারা টানা ১৫ বছর ধরে যে যাতনা সইছে, বিএনপি তা সইতে পারত না বলে ধারণা তাদের। পরিস্থিতি বিবেচনায় বর্তমানের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ভবিষ্যৎকে। এ ভাবনার অংশ হিসেবে দল ভেঙে কয়েক টুকরা হয়ে গেলেও সেদিকে তাকানোর গরজ নেই তাদের। সময় পাল্টালে পরিস্থিতি এমন থাকবে না বলে বিশ্লেষণ ও আত্মবিশ্বাস তাদের।