ফের ভয়ালরূপে করোনার হানা

ঠিকানা রিপোর্ট : বিশ্বে শুরু হয়েছে করোনাভাইরাস মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ। সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে হু-হু করে। এই সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যার দিক দিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে রয়েছে। আগামী আড়াই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন আড়াই হাজারের মতো মারা যাবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশেও সংক্রমন বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও এদিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। সংক্রমণের দিক দিয়ে বর্তমানে এশিয়ার শীর্ষ পাঁচ ও বিশ্বে ২৪তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ফ্রান্স-জার্মানির অবস্থাও ভালো নয়।
প্রথম দফার তুলনায় দ্বিতীয় দফায় করোনার প্রাদুর্ভাব আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় অনেক দেশই সংক্রমণ এড়াতে লকডাউনসহ নানা প্রদক্ষেপ নিয়েছে। ইতালি, ব্রিটেন, লেবানন, ফ্রান্স, হাঙ্গেরিসহ বিভিন্ন দেশ ফিরে গেছে লকডাউন কিংবা কারফিউয়ে। বাংলাদেশও সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে কঠোর হচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী নভেম্বর মাসের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন গড়ে লক্ষাধিক লোক করোনায় নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে এবং সহস্রাধিক মারা যাচ্ছে। গত ১৩ নভেম্বর ২৪ ঘণ্টায় যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় নতুন করে ১ লাখ ৮৪ হাজারের বেশি আক্রান্ত এবং ১ হাজার ৩০০ জন মারা গেছেন। কয়েক মাসের মধ্যে এটা সর্বোচ্চ রেকর্ড।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ৫ কোটি ৪৫ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা সাড়ে ১৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আর আমেরিকায় আক্রান্তের সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ এবং মৃতের সংখ্যা আড়াই লাখের কাছাকাছি।
আর জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ১৫ অক্টোবর বলা হয়েছে যে আগামী ১ মার্চ নাগাদ করোনায় যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা ৪ লাখ ৩৯ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। সেই হিসাব অনুযায়ী আগামী আড়াই মাসে যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন আড়াই হাজারের মতো মারা যাবে।
ভয়াবহ পরিস্থিতি আচ করতে পেরে বিভিন্ন স্টেট সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতিমধ্যে ওয়াশিংটন স্টেটের গভর্নর জে ইনসলী ১৬ নভেম্বর মধ্যরাত থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন করে বিভিন্ন কার্যক্রমের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। এ ছাড়া নিউইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমো, কলরাডো গভর্নর জারেড পলিস, আরকানসাসের গভর্নর আসা হ্যাটচিনসন, ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর চার্লী বেকার, নেভাদার গভর্নর স্টিভ সিসোলাক, ক্যালিফোর্নিয়া, নর্থ ডাকোটা, ওকলাহোমা, উইসকনসিন ও কেন্টাকিসহ আরও কয়েকটি স্টেটের গর্ভনররাও সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
এদিকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যো বাইডেনের উপদেষ্টা মাইকেল অস্টারহম বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষেতে যুক্তরাষ্ট্রে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহের লকডাউনের প্রয়োজন হতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রধানের হুঁশিয়ারি : কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত না হওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেডরস এঢানম ঘেব্রীসাস। ঘেব্রীসাস বলেন, ভ্যাকসিন নিয়ে মাতামাতি না করে বিশ্ববাসীর উচিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় অধিকতর তৎপর হওয়া এবং করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিউএইচও) দেয়া হিসাবে গত ১৪ নভেম্বর এক দিনে গোটা বিশ্বে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৯০৫ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর আগে এক দিনে এত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়নি।
করোনার মূলোৎপাটন হবে না : সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের ছোঁয়াচে রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হোয়াইট হাউস করোনা টাস্ক ফোর্সের সদস্য ড. অ্যান্থনী ফাউসি বলেন, আমেরিকা থেকে করোনার মূলোৎপাটন সম্ভব হবে না। আমেরিকা থেকে করোনার মূলোচ্ছেদের চিন্তা-ভাবনা নেহায়েত অমূলক। তবে ভ্যাকসিন প্রয়োগের ফলে করোনাজনিত মৃত্যুর হার কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে নভেম্বরের শেষ কিংবা ডিসেম্বর নাগাদ কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন পাওয়া যাবে এবং ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে জুলাইর মধ্যে আমেরিকা আবার আপেক্ষিক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
হঠাৎ আশার আলো : গত ১৬ নভেম্বর হঠাৎ আশার আলোর ঝলকানি দিয়েছে পিফাইজার। ড্রাগ প্রস্তুতকারী ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্তর্বর্তীকালীন বিশ্লেষণে তাদের প্রস্তুত করা কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের ৯৪.৫% কার্যকার প্রমাণিত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটি রোড আইল্যান্ড, টেক্সাস, নিউ মেক্সিকো এবং টেনেসিতে তাদের এক্সপেরিমেন্টাল (পরীক্ষামূলক) ভ্যাক্সিন সরবরাহের জন্য পাইলট প্রকল্প শুরু করছে। বহু জাতিগোষ্ঠী-বর্ণবিশিষ্ট বাসিন্দা এবং ইমিউনাইজেশন অবকাঠামোর ভিত্তিতে স্টেটগুলোর শহর এবং গ্রামীণ কমিউনিটিতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হবে।
ভালো নেই বাংলাদেশ
চলতি বছরের গোড়া থেকেই করোনার থাবায় সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও কার্যত অচল। এরপর মাস দুই ধরে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল এই মহামারি। কিন্তু আবার হু-হু করে বাড়ছে করোনা। এবার শীত আসার আগেই ফের বাড়তে শুরু করেছে সংক্রমণ। গত ১৬ নভেম্বর বিগত ৭০ দিনের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী শনাক্ত ও গত ১৭ নভেম্বর ৫৮ দিনের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সংক্রমণের দিক দিয়ে বর্তমানে এশিয়ার শীর্ষ পাঁচ ও বিশ্বে ২৪তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
নভেম্বরের শুরু থেকে দেশে ফের হু-হু করে বাড়তে শুরু করে করোনার সংক্রমণ। বর্তমানে দেশে করোনায় সংক্রমণের হার ১৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ, সুস্থতার হার ৮০ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার এক দশমিক ৪৩ শতাংশ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত ২০ সেপ্টেম্বর শীতে করোনার সংক্রমণ বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তখন প্রকোপ ঠেকাতে সবাইকে প্রস্তুত থাকারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এলে চিকিৎসার কোনো সমস্যা হবে না। ইতিমধ্যে চিকিৎসার সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে এলোমেলো অবস্থা ছিল। সেই অবস্থা আমরা কাঠিয়ে উঠেছি। অনেক অভিজ্ঞতাও অর্জন হয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও অনেক অগ্রগতি হয়েছে।’
করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুলাহ বলেন, ‘ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ওই দেশগুলো একাধিকবার লকডাউন ও কারফিউ দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছে। তবে আমাদের দেশে শীত প্রধান দেশের মতো অবস্থা হবে না। কিন্তু প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।’ সরকারের করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার আগাম প্রস্তুতি সন্তোষজনক বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি সার্বিক বিষয় মনিটরিং করছে এবং সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছে।