সৈয়দ মামুনুর রশীদ :
বই পড়া আনন্দের জন্যই হোক আর জানার প্রয়োজনেই হোকÑমানুষ এখন পড়তে চায় না। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর ‘সক্রিয় লাইব্রেরি’ শীর্ষক নিবন্ধে দুঃখ করে লিখেছেন, ‘কী হবে নতুন লাইব্রেরি বানিয়ে? কে পড়বে? কোথায় পাঠক? যেসব জাগ্রত হৃদয় আর্তপিপাসা নিয়ে আজ লাইব্রেরির দরজায় এসে দাঁড়াবে, সেই সব জ্বলন্ত উদ্দীপ্ত মানুষ কোথায় আজ এ দেশে?’ পড়ার অভ্যাস থেকে মানুষ ক্রমেই সরে যাচ্ছে। প্রযুক্তির এই যুগে ট্র্যাডিশনাল বই পড়া থেকে সরে গিয়ে যদিও ইলেকট্রনিক ই-বুক পড়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তার পরও আগের মতো দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়তে চায় না। কেন পড়তে চায় না? তার একটাই জবাবÑসময় কাটানোর জন্য প্রযুক্তি যেসব সুবিধা সহজ করে দিয়েছে, তাতে এ যুগের মানুষগুলো কী করে পড়তে চাইবে। ফেসবুকের বন্ধুবান্ধবকে ভুলে, এয়ারপডসে শোনা পছন্দের গান ফেলে কার এমন সময় আছে যে বই পড়বে? পড়ার ইচ্ছে থাকলেও স্মার্টফোনের নানান ডিসট্রাকশন ইচ্ছাকে বাধাগ্রস্ত করে দেয়। তার পরও কিছু কিছু মানুষ বই পড়া থেকে কিছুতেই বিচ্যুত হবে না। তারা হার্ডবুক বা ই-বুকই হোক, নেশার মতো পড়বেই। ব্যস্ততাকে অজুহাত করে সময় বের করার বিষয় কোনো কারণ হতে পারে না। ইচ্ছাকে সদিচ্ছা দিয়ে বাস্তবায়ন না করলে তার সুফল পাওয়া যায় না। বিশ্বের সেরা ধনী বিল গেটস এত ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি একজন নিরলস লোভাতুর পড়ুয়া। ছুটির দিনগুলোতে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা পড়ার সময় বের করে নেন। বছরে তিনি ৫০টি নন্-ফিকশন বই পড়ে থাকেন। বিল গেটস এত ব্যস্ত থাকার পরও যদি এতগুলো বই পড়তে পারেন, তবে সাধারণ মানুষ কেন পারে না? পড়ার ইচ্ছা যদি প্রবল না হয়, তবে পড়ার সময় কোনো দিনই হবে না।
৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে মানুষ পড়ালেখার মাধ্যমে সভ্যতার কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। মাটিতে, পাথরের গায়ে ছবি এঁকে আদিম মানুষেরা তার মনের অনুভূতিকে অন্যের কাছে তুলে ধরেছে। এই দেওয়া-নেওয়ার অনুভূতি থেকে মানুষে মানুষের সম্পর্কের বন্ধন তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে ভাব প্রকাশের ভাষা এবং ধীরে ধীরে তা সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। যুগে যুগে মানুষ তার স্মৃতি, সুখ-দুঃখের কথা লিপিবদ্ধ করেছে নানা মাধ্যমকে আশ্রয় করে। তারপর বই আবিষ্কার করল এবং তাতে সাহিত্যের রস এনে মনের অনুভূতিকে বাস্তবতা ও কল্পনার নিরিখে বই আকারে রূপ দিতে লাগল। ‘দ্য এপিক অব গিলগামেশ’কে সবচেয়ে প্রাচীনতম বই হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে অর্থাৎ এটিই আবিষ্কৃত প্রথম বই। ওই বই মহাকাব্য হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান দখল করে আছে। ঐতিহাসিকদের মতে, ২৭০০ খ্রিষ্টপূর্বে মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাকে) ‘গিলগামেশ মহাকাব্য’টি রচিত হয়। ইংরেজিতে প্রথম অনূদিত হয় ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে ‘দ্য ক্লারেন্ডন প্রেস’ অক্সফোর্ড থেকে। বইটির লেখক কে, তা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।
বই আবিষ্কৃত হয়েছে বলেই মানুষ পড়তে শিখেছে। বইয়ের সঙ্গে পাঠকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকে বই কেনার প্রবণতা এবং পরিশেষে লেখক হওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠেছে। লেখকদের সংখ্যা যেমন বাড়তে লাগল, তেমনি বইয়ের সংখ্যাও বেড়ে উঠল। বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় ছাপাখানা আবিষ্কৃত হলে বইয়েরও বিস্তৃতি ঘটল দুনিয়াজুড়ে। পাঠকের জন্য স্থাপিত হলো পাঠাগার। স্কুল-কলেজে গড়ে উঠল গ্রন্থাগার। তখনকার বিনোদনের সীমিত সীমানায় একমাত্র বই ছিল মানুষের অবকাশকালীন সময়ের নিত্য সহচর। ভ্রমণে বই, একাকিত্বে বই, কারাবাসে বই, পার্কের বেঞ্চিতে বসে বই পড়া, রোগসজ্জায় বই পড়া ইত্যাদি অনেক কিছুর মধ্যে বই পড়ার নেশায় মানুষ বিরক্তিকর সময়কে আনন্দের সঙ্গে অতিবাহিত করত। আজও বইপড়ুয়াদের সময় তেমনি করে কাটে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই বইকে আনন্দের সহচর হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে এবং হচ্ছেও। বিশেষজ্ঞদের মতে, বই কখনো বিলুপ্ত হবে না, বরং এর চাহিদা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ই-বুকের চাইতে শক্ত মলাটে মোড়ানো বইয়ের চাহিদা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তার কারণ, স্মার্টফোনের বদৌলতে বইয়ের লাইব্রেরি মুঠোফোনে থাকে বলেই ভ্রমণকারী পাঠক ছাপাখানার শক্ত মলাটের বই তেমন একটা বহন করে না। এর ফলে শক্ত বাঁধাইকৃত বইয়ের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে পাঠক এখন ই-বুকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, কিছুসংখ্যক পাঠক অডিও গল্প শোনার প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তার পরও মানুষ শেষ পর্যন্ত পড়ার অভ্যাস নিয়ে বেঁচে থাকবে অন্তত ই-বুকের কারণে। ‘স্টেটিস্টা’র (ঝঃধঃরংঃধ) তথ্য অনুযায়ী, এখানে ৩০টি দেশের তালিকা দেওয়া হলো, যেখান থেকে খুঁজে পাওয়া যাবে পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহের হিসাব। যদিও তালিকায় বাংলাদেশ বাদ পড়েছে। প্রতি সপ্তাহে প্রত্যেক মানুষ কত ঘণ্টা পড়ার জন্য সময় ব্যয় করে থাকে।
তথ্য অনুযায়ী ভারতের জনগণ এখনো পড়ার প্রতি যত্নশীল। তার কারণ হয়তো ভারত তার নিজস্ব প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকায় বাইরের চমকপ্রদ বিজ্ঞানের নিত্যনতুন উদ্ভাবিত সামগ্রীর অনুপ্রবেশ ভারতে কম। যার ফলে ভারতের মানুষ হয়তো সহজে সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে পারে না বিদেশি স্মার্টফোনের অপ্রতুলতার জন্য। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যে দেশে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে, সেখানেই সোশ্যাল মিডিয়া তরুণসমাজকে রীতিমতো পড়ার অনভ্যাসে পরিণত করছে। যেখানে ভালো বই পড়তে গিয়ে কিছু পাঠক সারা রাত বিনিদ্রায় কাটিয়ে দিয়েছে, সেখানে আজকের তরুণসমাজ সারা রাত কাটিয়ে দেয় শুধু ফেসবুক চ্যাটিং নিয়ে। ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস নিউজ অর্গানাইজেশন ‘কোয়ার্টজ’-এ প্রকাশিত চার্লস চু-এর নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী, গড়ে আমেরিকান পাঠক প্রতি মিনিটে ২০০ থেকে ৪০০ শব্দ পড়ে থাকেন। অন্যদিকে একজন আমেরিকান সোশ্যাল মিডিয়ায় বছরে ৬০৮ ঘণ্টা ও টেলিভিশন দেখে সময় ব্যয় করেন বছরে ১৬৪২ ঘণ্টা। সে ক্ষেত্রে ওই সময় যদি বই পড়ার জন্য ব্যয় করা হতো, তবে বছরে এক হাজার বই পড়া যেত। একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে পড়ার একটুও সময় থাকবে নাÑএ নিয়ে কোনো যৌক্তিকতা না থাকলেও অজুহাত আছে। পড়তে না চাইলে সে জন্য অনেক অজুহাত আছে, নতুবা পড়তে চাইলে যথেষ্ট সময়ের মধ্যে অন্তত ২০টি মিনিট সময় পড়ার জন্য জোগাড় করতে পারবেন। পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষগুলো এত ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পড়ার সময়কে ঠিকই জোগাড় করে নিয়েছেন। আমেরিকার বিখ্যাত ধনকুবের ‘ওয়ারেন বাফেট’ও পড়ার মনোযোগ হারাননি এখনকার ৯২ বছর বয়সেও। তিনি প্রতিদিন ৫০০ পৃষ্ঠা পড়ার জন্য সময় বরাদ্দ রাখতেন। যুবককালে টেসলা কোম্পানির সিইও হওয়ার প্রাক্কালে ‘ইলন মাস্ক’ প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে পড়তেন। যে ফেসবুকের কারণে আমরা অনেকেই পড়ার সময়কে নষ্ট করে দিয়েছি, সেই ফেসবুকের কর্ণধার ‘মার্ক জুকারবার্গ’-এর শতব্যস্ততার মধ্যেও সপ্তাহে একটি বই পড়ার মতো সময় থাকে। ‘মার্কস কিউবান’ও একজন লোভাতুর পাঠক হিসেবে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা সময় দিতে পারেন। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও জগদ্বিখ্যাত পড়ুয়া ‘হাওয়ার্ড বার্গ’ প্রতি মিনিটে ৮০ পৃষ্ঠা পড়তে পারতেন।
সামাজিক মাধ্যমকে উপেক্ষা করে শুধু শুধু পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন, সে পরামর্শ কেউ কাউকে দেয় না। পাঁচমিশালি মেজাজে জীবনকে উপভোগ না করতে পারলেও জীবনকে উদ্্যাপন করতে হলে জীবনাচরণে বৈচিত্র্য থাকতে হবে। বিখ্যাত মানুষদের পড়া নিয়ে যেসব উদাহরণ দিয়েছি, তাঁরা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এগিয়ে চলার বৈচিত্র্য নিয়ে। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের পেশার মধ্যে অবস্থান করে পড়ার সময় জোগাড় করেছেন। সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে সর্বসময়ের আসক্ত বানিয়ে সময়ের সদ্ব্যবহারের বারোটা বাজিয়ে দেওয়ারও কোনো মানে হয় না। জীবনে অনেক কিছু করার আছে কিন্তু আমরা তা করি না অথচ সময়কে অনাদরে অপচয় করার মতো সময় আমাদের ঠিকই থাকে। গভীর রাতে ঘুমের মধ্যভাগে জেগে উঠলেও ফোনে দেখতে হয় বন্ধুদের টেক্সট মেসেজ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে। কিন্তু এই অনাকাক্সিক্ষত বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? নিশ্চয় আছে, যদি তার সঠিক পথের উপায় খুঁজি।
প্রসঙ্গ যেহেতু বই পড়া নিয়ে, তবু ওই পথেই বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে হবে। যদি বই পড়ার ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ পেশায় সক্রিয় হতে চাই, তবেই বিদগ্ধজনের ধারণাকে কাজে লাগাতে পারি। নিউইয়র্ক টাইমসের দ্য বুকস ডেস্কের সিনিয়র এডিটর জর্জ কাউলসের নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ ‘এ ইয়ার অব লিভিং বেটার হাউ টু টেপ ইয়োর ইনার রিডার’। তাতে তিনি সুস্থ জীবনবোধে পড়ার সময়কে কীভাবে ম্যানেজ করা যায়, তার কিছু সুচিন্তিত উপায় দেখিয়েছেন। আমার মনে হয়, আমাদের ব্যক্তিজীবনে তাঁর প্রদত্ত টিপসগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। টিপসগুলো হচ্ছে : ১. হাউ টু মেইক টাইম ফর রিডিং, ২. ডেপোলাপ ট্রাস্টেড সোর্সেস ফর বুক রিকমেন্ডেশনস, ৩. ফাইন্ড আউট হোয়াট টাইপ অব রিডার ইউ আর, ৪. রিড ফর প্লেজার, ৫. রিড হোয়াট ইউ লাইক, ৬. হাউ টু রেইজ এ রিডার, ৭. পুশ ইয়োরসেল্ফ অ্যান্ড লেট ইয়োরসেল্ফ বি সারপ্রাইজড, ৮. রিড হোয়াট ইউ ডোন্ট নো, ৯. বুক ইয়োর ক্যালেন্ডার, ১০. এনগেজড ইয়োর রিডিং, ১১. বিকাম এন অ্যাকটিভ রিডার ও ১২. কংক্রিট টিপস ফর রিডিং মোর।
পড়ার প্রতি যদি যত্নশীল হই, তবেই নির্দ্বিধায় পড়তে পারব, নতুবা বারবার ডিস্ট্রাকটশনের শিকার হব। আর তাতে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়লে একে তো পড়ার মনোযোগ হারাব, অন্যদিকে কোনো পড়াই শেষ হবে না। লেখক তাঁর নিবন্ধে পড়ার ব্যাপারে মনোনিবেশের ওপর বেশি করে গুরুত্ব দিয়েছেন, যাতে পড়ার সময় শুধু পড়ার পরিবেশ নিয়েই পড়া। তাই তিনি বলতে চান, পড়ার সময়ে যখন পড়তে যাবেন, তখন কোনো ফোন, ইমেইল, টেক্সট মেসেজেস অথবা সোশ্যাল মিডিয়াকে কাছে রাখা যাবে না। এমনকি টেলিভিশনটিকেও আনপ্লাগ করে রাখার ব্যাপারে লেখকের পরামর্শ রয়েছে। পড়ার জন্য পাঠকের গোল থাকতে হবে, যাতে করে সপ্তাহে হোক আর মাসেই হোক যে কটি বই পড়তে ইচ্ছুক, তা যেন শেষ করতে পারেন। পড়ার অগ্রগতিকে ট্র্যাক করে রাখার তালিকা তৈরি করা যেতে পারে। বই পড়তে পারেন ট্রেনে বসে, বিমানে, হাসপাতাল বা চিকিৎসকের ওয়েটিং এরিয়ায়। শিক্ষাবিষয়ক গবেষণায় বলা হয়েছে, পড়ায় যেসব উপকারিতা রয়েছে, তার মধ্যে দুশ্চিন্তা হ্রাস, স্মরণশক্তি বজায় ও সহানুভূতি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা। অতএব, বই হোক জীবনকে সুন্দর রাখার আজন্ম অভিভাবক।
-নিউইয়র্ক, ১৭ আগস্ট ২০২২