বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান রাষ্ট্রপতির

ঠিকানা অনলাইন : রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্ম, চিন্তা, আদর্শ ও দর্শন বাংলাদেশসহ বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে দেশের রাজনীতিক, ঐতহিাসিক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, এবং সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, রাষ্ট্র, দেশ ও জীবন গড়তে বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম ও আদর্শ নতুন প্রজন্মর জন্য বড় অনুপ্রেরনা হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনের ভাষণে তিনি আজ এ আহবান জানান। এর আগে রাষ্ট্রপতি সন্ধ্যা ৬টা ৮ মিনিটে অধিবেশন কক্ষে প্রবশে করলে নিয়ম অনুযায়ি জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। সবাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শণ করেন। এ সময় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ঐতিহাসিক ভাষণ বাজানো হয়। এর পর সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ভাষণ শুরু করেন।

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশকে জানতে হলে, বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হবে, বঙ্গবন্ধুকে জানতে হবে। এই দুই সত্তাকে আলাদাভাবে দেখার চেষ্টা যারা করেছেন তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। আজকের বাস্তবতা এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে জাতি এগিয়ে যাক ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথে, নোঙ্গর ফেলুক বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলায়’।’

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়। বঙ্গবন্ধু একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সত্তা, একটি ইতিহাস। জীবিত বঙ্গবন্ধুর মতোই অন্তরালের বঙ্গবন্ধু শক্তিশালী। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি থাকবে, এদেশের জনগণ থাকবে, ততদিনই বঙ্গবন্ধু সকলের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মুক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে তিনি বিশ্বকে আলোকময় করেছেন। তাই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে বঙ্গবন্ধুর নীতি, আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বেড়ে উঠতে পারে সে লক্ষ্যে সকলকে উদ্যোগী হতে হবে।

করোনা ভাইরাস সংক্রমনের এ সময় সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের এ বিশেষ (দশম) অধিবেশনের দ্বিতীয় কার্যদিবসে রাষ্ট্রপতির ভাষণের সময় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও সরকার এবং বিরোধী দলীয় সদস্যরা সংসদে উপস্থিত ছিলেন।

রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, “৭ কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না”। করোনা মহামারী দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারাকে সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত করলেও থামিয়ে দিতে পারেনি। তিনি আশা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে করোনাসহ সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে বাঙালি জাতি কাঙ্খিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে এবং গড়ে তুলবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সুখী-সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত, দুর্নীতি ও শোষণহীন সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ। জাতির পিতার দর্শন ছিল ‘বাংলার মানুষের মুক্তি’। সেই মুক্তি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি। তিনি কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে ভবিষ্যত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। পরিকল্পিত উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধু আধুনিক রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন, যা দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-১৯৭৮) প্রতিফলিত হয়েছিল। তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে এমডিজির অধিকাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ নিম্ন মধ্যআয়ের দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে প্রথমবারের মত স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ উত্তীর্ণ হওয়ার সকল শর্ত পূরণ করেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। কিছু কিছু সূচকে বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ আজ এশিয়ার সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ।

তিনি বলেন, পরপর তিন বছর ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক এক-পাঁচ শতাংশে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক দুই-চার শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না হলেও প্রবৃদ্ধির এ হার ছিল এশিয়া এমনকি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বেশি। দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দুই হাজার চৌষট্টি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও এখন ৪১ বিলিয়ন ডলারের উপরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২ বছরের উপরে। প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় শতভাগ। স্বাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে।

আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে সরকার ‘রূপকল্প-২০৪১’ কে সামনে রেখে বহুমাত্রিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর প্রধান অভীষ্ট হলো ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্যের অবসান, উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদায় উত্তরণ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের অবলুপ্তিসহ উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদায় আসীন হওয়া যেখানে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫শ’ মার্কিন ডলারেরও বেশি। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ২০২১-২০৪১ মেয়াদে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। সেইসাথে নিশ্চিত করতে হবে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা, ব্যাপক শিল্পায়ন, অর্থনীতি সুসংহতকরণ, নগরায়ন, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, জ্বালানি বহুমুখীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাসহ মেধাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ।

তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে খাধ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, কৃষি, শিক্ষা, আবাসন, বিদুৎ-জ্বালানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নারী ও শিশুদের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত, নারীর ক্ষমতায়ন, তথ্য ও প্রযুক্তি, ক্রীড়া ও যুব উন্নয়ন, পল্লী উন্নয়নসহ সব খাতে অর্জিত ব্যাপক সাফল্যের খতিয়ান দেন।

রাষ্ট্রপতি বলেন, উন্নয়নের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ নির্মূল, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিকাশ, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন পুরস্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রদত্ত এ সকল আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং সম্মাননাসমূহ সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। এ বিরল সম্মান দেশ ও জাতির জন্য গৌরবজনক। এজন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান।

ভাষণ শেষে মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতিকে জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক স্মারক গ্রন্থসমূহ উপহার দেয়া হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী রাষ্ট্রপতির হাতে উপহার তুলে দেন। এর পর রাষ্ট্রপতি প্রস্থান করলে স্পিকার অধিবেশন ১৫ মিনিটের জন্য মুলতবি করেন। বাসস

ঠিকানা/এসআর