বটবৃক্ষের স্মৃতি রোমন্থন

শত বছর পরে
পদ্মা নদীর চরে
আজ আবার মনে পড়ে,
আমি এক বটবৃক্ষ জন্মেছিলাম,
অঝরে বর্ষা ঝরা এক আষাঢ়ে।
এখন আমার বিশাল
সবুজ ডালপাতার,
শীতল ছায়ার তলে,
মানব-মানবীর দোকান ঘর,
মাল-সামান, হাট-বাজার,
চাল, ডাল, তেলের
কেনাবেচা চলে।

দূর-দূরান্তের গ্রামগঞ্জ থেকে
খাল-বিলের ধার বেয়ে,
সবুজ ধান ক্ষেতের
আশপাশ দিয়ে,
মেঠোপথে একেবেঁকে,
কতো শত মানব-মানবী,
আসে আমার সুবিশাল
সবুজ শীতল ছায়ার বুকে।

মধ্যরাত অবধি চলে
কেনাবেচা, খেলাধূলা,
বাজে বাঁশি, গান-বাজনা, ঢোল-তবলা
কীর্তন, জারি-সারি,
নাচে যুবক-যুবতী,
পুরুষ-নারী আরো কতো কি নিরবধি,
আমার পাশ দিয়ে বয়ে যায়
জোয়ার-ভাটার রূপালী পদ্মা নদী।
উত্তাল বাতাসে বসন্তের বেলা,
নীল আকাশে পাখিদের খেলা,
কতো শত রঙ-বেরঙের পাল তোলা
নৌকা, মহাজন, মাঝিমাল্লা,
যাচ্ছে-আসছে জীবন যুদ্ধে
সবুজ সোনালী ধরণী মধ্যে
অর্থ সম্পদের পাহাড়ে,
কে কতো উপরে উঠতে পারে,
আকাশ ছোঁয়ার মানসে
একই সঙ্গে দিচ্ছে সবাই পাল্লা।

আমার ছেলেবেলায়
দেখেছিলাম বৃটিশ রাজের
বিরুদ্ধে, স্বদেশি আন্দোলনের
কতো শত নেতা-কর্মীর দল,
গোপনে অকস্মাৎ হামলে পড়তো,
বোমাবাজিতে তছনছ করতো,
ইংরেজ সেনাদের জনবল।

একবার আমারই বটবৃক্ষের ডালে-ডালে,
স্বদেশি আন্দোলনের
দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মীদের দলে-দলে,
ইংরেজ সেনারা বিনা বিচারে
নারী-পুরুষ নির্বিচারে
ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দিলো,
বোমা হামলার প্রতিশোধ নিলো,
এভাবেই চলেছিল কতোকাল
এখনো মনে পড়ে অবিরল।

তারপর ১৯৭১-এর স্বাধীনতার যুদ্ধে
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর
অনাচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে,
স্বাধীনতাকামী বাংলার মানুষ
পাশাপাশি এক সাথে, দিনে ও রাতে
রুখে দাঁড়ালো দা, কুড়াল, বন্দুক হাতে,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সংগ্রামী আঞ্বাহ্বানে,
জয় করলো বাঙালি জীবনে-মরণে,
কোটি জনতা উঠলো ফুঁসে,
ঝাঁপিয়ে পড়লো আগুনের তুষে।

একদিন ১৯৭১-এর অক্টোবর মাসে
আমারই বুকের পাশে
পদ্মা নদীর রূপালী জলে
হানাদারদের গানবোটের কবলে,
মেশিনগান আর কামানের
গোলাগুলির অনলে
ঝলসে গেলো কতো শত মানুষের প্রাণ
অকালে জীবনকে করে গেলো দান,
দেশমাটির মুক্তির তরে অকাতরে,
অঝরে মুক্তিকামী মানুষেরা গেলো ঝরে।
অশান্ত পদ্মা নদীর জলে, নিমেষে
কতোশত ক্ষত-বিক্ষত লাশ
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বেওয়ারিশ ভাসে,
বিশ্ববাসীর অজান্তে আর অন্তরালে
বাংলার মাটি ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত লালে,
কতো ফুল ঝরে গেলো অকালে,
এপাড়ে ওপাড়ে ভরে গেলো
নারী-পুরুষ শিশুদের অগণিত লাশে
পদ্মা নদীর আনাচে-কানাচে, সবুজ ঘাসে।
হিংস্র হানাদারদের বর্বর আঘাতে
আমার সুবিশাল বটবৃক্ষের
সবুজ শীতল ছায়ার তলে
দাউ দাউ আগুনের শিখা জ্বলে,
বাজারের সব দোকান, বাড়িঘর
নিমেষে জ্বলে-পুড়ে হলো ছারখার,
মৃত মানব-মানবীর লাশ,
জ্বলে পুড়ে হলো ছাই,
তারই মধ্যে আমি বটবৃক্ষ
নীরবে নিঃশব্দে, জীবন্ত সাক্ষী হয়ে
দাঁড়িয়ে রইলাম ঠাঁয়।
শত বছরের জীবনে আমার
এতো ধ্বংস এতো খুন,
এতো লেলিহান আগুন
আর এতো এতো লাশ,
দেখিনি কোনোদিন
জঘন্য বর্বর এমন সর্বনাশ।
১৯৭১-এর ডিসেম্বর, তারিখ ষোল
লক্ষ-লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে,
পরাধীনতার শেকল ছিঁড়ে
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।
শান্তির পতাকা উড়িয়ে
নিপীড়িত মানুষের মন-প্রাণ জুড়িয়ে,
অবারিত আনন্দ-উল্লাসের সুখে
বিজয়ীর বেশে বাংলার বুকে,
বীরদর্পে হাজার-হাজার মুক্তিযোদ্ধা,
আরো কতো শত শিক্ষিত বোদ্ধা,
সাংবাদিক, রাজনীতিক, ঋষিমুণি
শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি ও জ্ঞানীগুণী,
ফিরে এলো, অজস্র রাশি রাশি
সাথে দুর্দিনের পরম বন্ধু ভারতবাসী।

আবারও বসলো আমার
সুবিশাল শীতল ছায়ার তলে
দোকান, বাড়ি, ঘর
এবং বিশাল বড় হাট-বাজার
মালসামান কেনা-বেচার,
চারদিকে এখন চলে
নানা রঙের ও বর্ণের,
কতো রকমের সৃষ্টি উল্লাস,
আমার চারিপাশে জ্বলে
লাল-নীল, হলুদ-সবুজ,
আলোর দীপ আর বয়ে যায়
ঝলমল আনন্দ উচ্ছ্বাস।

আমার নিজের কাছেই প্রশ্ন,
ক্লান্ত শ্রান্ত সবাই,
আমার কাছে ফিরে আসে
এবং দুনিয়াদারি ভোলে,
একটু ছায়া, একটু মায়ার আশে
যেমন মায়ের কোলে।

মনে হয়, আমি বটবৃক্ষ
সবাই আমার সন্তানতুল্য,
এখানেই আমার পরম পাওয়া
এবং আমার জন্ম স্বার্থক,
খুঁজে পাই আমি স্নেহের-ভালোবাসা
আর আমার অবদানের মূল্য।
-নিউ ইয়র্ক।