মুসলমানদের দুই ঈদ, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দুর্গোৎসব, এরপর এবার আসছে খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শুভ বড়দিন ‘মেরি ক্রিসমাস’। যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বরে বিশ্বের খ্রিষ্টধর্মের সবাই শুভ বড়দিনের উৎসবে মেতে ওঠে। আনন্দ ও উৎসবের সেই দিনটি একেবারেই সামনে। আজ ২১ ডিসেম্বের, মাঝখানে আর মাত্র তিনটি দিন। তার পরই সেই শুভ বড়দিন।
ইতিমধ্যেই বড়দিনের উৎসব উদ্্যাপনে সাজ সাজ রব শুরু হয়ে গেছে বিশ্বময়। চার্চ প্রস্তুত হচ্ছে বড়দিনের বিশেষ প্রার্থনার জন্য। চার্চ, বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সড়কদ্বীপ বর্ণাঢ্য আলোকমালায় সজ্জিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে ক্রিসমাস ট্রি। ঘরে কিংবা চার্চে সেসব আলোক ট্রিমালায় সাজিয়ে বিশেষ স্থানে স্থাপন করা হয়। সেসব ট্রির নিচে উপহারসামগ্রী সাজিয়ে রাখা হবে। ক্রিসমাস উপলক্ষে থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের পরদিন ব্ল্যাক ফ্রাইডে থেকেই বিপুলভাবে কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। এ উপলক্ষে সবকিছুতেই সেল চলছে। এই সেল নিউ ইয়ার্স ডে পর্যন্ত চলবে।
ক্রিসমাস উৎসবে শিশু-কিশোরদের জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয় হচ্ছে সান্তাক্লজের কাছ থেকে উপহার পাওয়া। তারা উদ্্গ্রীব হয়ে থাকে সান্তাক্লজ আসবে এবং তাদের মাঝে উপহারসামগ্রী বিলাবে। বিশ্বাস করা হয়, ঈশ্বর স্বয়ং শিশুদের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে দিতে সান্তাক্লজকে উপহারসামগ্রী দিয়ে পাঠান। বলা হয়ে থাকে, সান্তাক্লজের জন্ম তুরস্কে ২৮০ এডি’তে। তিনি একজন মংক, নাম ছিল সেন্ট নিকোলাস। সেই থেকেই সান্তাক্লজের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে উপহারসামগ্রী বিতরণ করা হয়ে আসছে এবং শিশু-কিশোরেরাও প্রতি ক্রিসমাসে সান্তাক্লজের প্রতীক্ষায় থাকে। সান্তাক্লজের কাছ থেকে উপহার না পেলে তাদের ক্রিসমাসের আনন্দ পূর্ণতা পায় না।
২৫ ডিসেম্বর বড়দিন উদ্্যাপন করা হয় যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষে। প্রভু যিশু এই দিনে বেথলেহেমের এক গোয়ালঘরে মাতা মেরির গর্ভে জন্ম নেন। খ্রিষ্ট ধর্মানুসারে ‘ট্রিনিটি অব গড’-এ বিশ্বাস রেখে বলা হয়, মেরি, দি হোলি মাদার। হোলি সন এবং অ্যান্ড দি হোলি স্পিরিট। ২০ শতকের শুরুতে ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব হিসেবে খ্রিষ্টান-অখ্রিষ্টান সবাই বড়দিনের উৎসব উদ্্যাপন করত। সে সময় ধর্ম বিচারে উদ্্যাপিত হতো না ২৫ ডিসেম্বর। এর পেছনে অন্য কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। তবে হতে পারে এমন, যিনি যিশু, তিনিই ঈসা। তাই ওই সময়কালে মুসলমান-খ্রিষ্টান মিলেই ২৫ ডিসেম্বর উদ্্যাপন করত। তাই সে উৎসব হয়ে উঠত সর্বজনীন, সর্বধর্মীয় উৎসব।
খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রভু যিশু হলেন ‘সন অব গড’। তারা আরো বিশ্বাস করে, প্রভু যিশুর মৃত্যুই শেষ কথা নয়। তিনি মৃত্যুর পর আবার জীবন ফিরে পেয়েছেন। বড়দিনের উৎসব তৃতীয় শতাব্দীর দিকে শুরু হলেও তা নবম শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত তা খ্রিষ্টানদের প্রধান উৎসব হিসেবে উদ্্যাপিত হতো না। ৩৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্ট্যানটাইনের সময়ে ক্রিসমাস প্রথম উৎসব হিসেবে উদ্্যাপন শুরু হয়। সেই সময় রোমান চার্চে প্রথম ক্রিসমাস উদ্্যাপিত হয়। সম্রাট কনস্ট্যানটাইন খ্রিষ্টধর্মকে একটি কার্যকর ধর্মে পরিণত করেন বলে বহুলভাবে বিশ্বাস করা হয়।
ক্রিসমাস সম্পর্কে পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং লর্ড স্বয়ং মানবসমাজকে একটি চিহ্ন দেখাবেন। দেখো, একজন কুমারী গর্ভধারণ করবেন এবং একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেবেন, তাঁর নাম হবে ইমামুয়েল। তোমরা তাঁকে যিশু বলে সম্বোধন করবে। তিনি তাঁর অনুসারীদের পাপ থেকে রক্ষা করবেন।’
এ কথা সব ধর্মমতেই বিশ্বাস করা হয়, সব ধর্মের নবী, যিশু, দেব-দেবতা সবাই তাদের নিজ নিজ ধর্মের মানুষকে সৎ পথ দেখান। যেন তারা পাপের পথ, অসত্যের পথ, বাতিল পথ পরিহার করে সৎ পথে চলতে পারে। সৎ জীবনযাপন করতে পারে। মানুষ যখন তার মনুষ্যত্ব ভুলে যায়, প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য ভুলে যায়, অসৎ কর্মে ও অসৎ জীবনযাপনে প্রবৃত্ত হয় এবং খুন, রাহাজানি, মারামারি, যৌন লালসা, হিংসা, বিদ্বেষে লিপ্ত হয়; তখন আমাদের স্রষ্টা, মহান প্রভু তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে মহামানব পাঠান, যাঁরা আমাদের সঠিক পথ দেখান।
যিশুখ্রিষ্টও তেমনি তাঁর অনুসারীদের সঠিক পথ দেখানোর জন্য ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত হন। তিনি পৃথিবীতে শান্তি, সাম্য, মৈত্রীর বাণী প্রচার করেন। অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে তিনি মানুষকে আহ্বান জানান। মিথ্যা ছেড়ে সত্যের পথে আসতে বলেন। তাঁর আহ্বানে মানুষ বিপুলভাবে সাড়া দিতে থাকে। বিশেষ করে, যুবসমাজ দলে দলে তাঁর অনুসারী হতে থাকে। সৎ পথের ডাকে অনুগত হয়ে যুবসমাজ তৎকালীন সমাজের অসংগতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে থাকে। যিশুখ্রিষ্টের সাম্য-মৈত্রী-মানবিকতার ডাকে মানুষ আলোর পথে আসতে শুরু করে।
প্রভু যিশুর ডাকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যখন আলোর পথে এগিয়ে আসতে থাকে, তখন সে সময়ের সমাজপতিরা প্রমাদ গুনতে থাকে। তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, অন্যায়-অবিচারের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা দেখে তারা যিশুর সত্য প্রচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে থাকে। তাদের রক্তচক্ষু ও রোষানলে পড়তে থাকেন লর্ড যিশু। তারা যিশুর যুক্তির সঙ্গে পেরে উঠতে না পেরে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে তাঁর বিরুদ্ধে। সমাজপতিরা নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন টিকিয়ে রাখতে জোট বেঁধে যিশুখ্রিষ্টের বিরুদ্ধে মাঠে নামে এবং শেষ পর্যন্ত ক্রুশবিদ্ধ করে তাকে হত্যা করা হয়।
এই হৃদয়বিদারক ঘটনা শুধু প্রভু যিশুর ক্ষেত্রেই ঘটে না; যারা সৎবাণী প্রচার করেছেন, অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোর পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কথা বলেছেন, আল্লাহর পথে, ঈশ্বরের পথে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, যুক্তির কথা বলেছেন, তারাই নিজ নিজ সময়ের প্রতিষ্ঠিত অপশক্তির রোষানলে পড়েছেন। তাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। কেউ প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকেই চরম হয়রানির শিকার হয়েছেন। কিন্তু যেহেতু তাঁরা ছিলেন স্রষ্টার প্রেরিত পুরুষ, কেউই নিপীড়নের মুখে সত্য পথ ত্যাগ করেননি। তাঁরা সমাজ পরিবর্তন, সমাজ সংস্কারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে সমাজ, সমাজের মানুষ বিপুলভাবে উপকৃত হয়েছে। সমাজ থেকে অন্ধকার দূর হয়েছে।
কিন্তু এখন যখন আমরা আমাদের সময়ের দিকে তাকাই, দেখি তাদের সত্যবাণী অনেকটাই অসত্যের আবরণে ঢাকা। তাদের দেখানো আলো এখন অনেকটাই অন্ধকারে আচ্ছন্ন। আজ আমরা যতটা উৎসবে মাতি, ততটা মহামানবদের রেখে যাওয়া আদর্শ অনুসরণ করে চলার আগ্রহবোধ করি না। কিন্তু তাঁদের নিয়ে উদ্্যাপন তখনই প্রকৃত অর্থে সার্থক হবে, যখন আমরা তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করে চলতে পারব। আবার অন্ধকার তাড়িয়ে আলোয় ভরিয়ে দিতে পারব সমাজ-সভ্যতা। সত্য এবং যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারব।