বড়লোকদের চাপা বেদনার কথা

বৈচিত্র্যময় কৈশর ৫

ড. এবিএম এনায়েত হোসেন :

মানবসমাজের যে কোনো বসতিতে বড়লোক বা বিত্তশালী লোকদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এসব লোকদের জীবনে কোনো কিছু না পাওয়ার বেদনা কিংবা পারিবারিক অশান্তি, অব্যক্ত চাপা মনোকষ্টও যে থাকতে পারেÑ তা সাধারণত বাইরে থেকে বোঝা অসম্ভব। উপর তলার লোকদের জীবনাচার, চিন্তা-ভাবনা ও লোভ-লালসা সাধারণ বিত্তহীন, নিম্ন মধ্যবিত্ত বা এমনকি উচ্চ মধ্যবিত্তদেরও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। তবে সাধারণভাবে এসব খেটে খাওয়া ও পেশাজীবী লোকেরা আশা করে থাকে যে, বিত্তবান লোকেরা তাদের কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সমাজের এক বিশাল সংখ্যক বিত্তহীন ও মধ্যবিত্ত জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে। বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন বার্তা দেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিত্তবান লোকেরা যেনো অনেকটা অতীত ইতিহাসের কারুণ-এর সহযাত্রী। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বড়লোকদের হাত প্রায়শই দেখা যায় টান-টান। নিজেদের ভোগ-বিলাসিতা আর সহায় সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যই যেনো তাদের একমাত্র মোক্ষবস্তু।

আমাদের ইতনা ইউনিয়নের বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কতিপয় স্বচ্ছল হিন্দু পরিবার ছাড়া মুসলমান সম্প্রদায়ে বিত্তবান লোক ছিল মাত্র দু-একজন হাতেগোনা। বিত্তশালী হিন্দু পরিবারগুলোর আর্থিক জোগান ঘটতো কলকাতা-প্রবাসী পারিবারিক সদস্যদের কল্যাণে। তারা ছিল নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা উচ্চ পদধারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি।

মুসলিম-প্রধান ইতনা গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় একমাত্র বড়লোক বলতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তমিজউদ্দিন আহমেদ। তাঁর দ্বিতল অট্টালিকা নির্মাণ, দীঘি খনন ও নলডাঙ্গার মাঠে অনেক জমি-জমা ক্রয় করাই ডেপুটি সাহেবের আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ। তাছাড়া তাঁর তিন-তিনটি পুত্র-সন্তানকে শিক্ষাদান করাটাও ছিল তাঁর সাফল্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর বড় ছেলেটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হওয়া সত্ত্বেও মাথা গোলমালে বাড়িতে নিষ্কর্মা জীবনাযাপনে অভ্যস্থ! অপর দু’ছেলের মধ্যে মেজ ছেলে আলতাফ উদ্দিন আহমেদ প্রবেশিকা পাশ করে শেষ পর্যন্ত স্নাতক ডিগ্রি নেননি। ছোট ভাই হাবিউদ্দিন আহমেদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। তিনি ভাইদের মধ্যে সব চাইতে দীর্ঘদেহী, একহারা শরীর, বুদ্ধিদীপ্ত, রাশভারী চেহারা, গম্ভীর কণ্ঠস্বর, মুখে প্রায়শই দামি বিদেশি সিগারেট। কিন্তু গায়ের রংটা কালোই বলা চলে।

আলতাফ সাহেবের গড়ন কিছুটা মাঝারি উচ্চতার, মুখে সস্নেহ হাসি, কিছুটা মোটা-সোটা দেহ এবং গায়ের রঙ ছোট ভাইয়ের মতই কালোর দিকে। মজার বিষয় হলো দু’ভাই পাকিস্তান আবগারি ও শুল্ক বিভাগে কর্মরত। আলতাফ সাহেব শুল্ক পরিদর্শক থেকে পদোন্নতি পেয়ে ডেপুটি সুপারিনটেডেন্ট হয়ে চট্টগ্রাম শহরে বসবাসরত। অন্যদিকে হাবিব সাহেব পাকিস্তানের উভয় প্রদেশের শুল্ক কালেক্টার হয়ে ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে করাচি থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। অফিসের দায়-দায়িত্ব বুঝে নেয়া ও পরিবার-পরিজনের জন্য উপযুক্ত সরকারি বাসাবাড়ি ঠিক করার উদ্দেশ্যে হাবিব সাহেব ও তাঁর পরিবারবর্গকে নিয়ে সাময়িকভাবে গ্রামের বাড়িতে আসতে বাধ্য হলেন।
পাঁচ-ছয় মাসের জন্য হাবিব সাহেবের স্ত্রী রওশন আপা তাঁর ছয়টা কন্যা সন্তানকে নিয়ে শ্বশুরালয়ের দোতলা দালানবাড়ির পশ্চিম পার্শ্বস্থ একটি কক্ষে আশ্রয় নিলেন। তখন সবার থেকে ছোট মেয়েটা (ডোরা) সবে দুধের শিশু মাত্র। অন্যান্য কন্যা সন্তানেরা অনেকটা পিঠাপিঠি বয়সের। সবচাইতে বড়টা (মিলি) নয় বছরের। বাকি বোনগুলোর (বেলি, ডলি, বুলি ও তোরা) বয়সের পার্থক্য দুই থেকে দেড় বছর হবে সম্ভবত! বেলির চেহারা, গড়ন ও চালচলন এবং এমন কি গায়ের রঙটা পর্যন্ত অবিকল হাবিব ভাইয়ের মত দেখতে। পরিবারে কোন পুত্র সন্তান না হওয়ায় বেলিকেই ছেলেদের পোশাক-আশাক পরিয়ে রাখা হতো। গ্যালিস-লাগানো পরনের প্যান্ট ও ছেলেদের শার্ট গায়ে। হঠাৎ কেউ বেলিকে দেখলে ছেলে বলে ধরে নেবে! পুত্র-সন্তান না হওয়ার দুঃখটাকে ভুলে থাকার কী অদ্ভুত চেষ্টা! অনেকটা যেনো ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো’- এই আর কি?
যা হোক, শহরের অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা যখনই অজপাড়াগায়ে আসে, তখন তারা হয়ে পড়ে আকর্ষণীয়। অনেকের কাছেই কৌতূহলের পাত্র, আবার কারো কারো কাছে ঈর্ষণীয়। গ্রামের সবাই তাদেরকে খুশি করতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। কেউ বা আদর করে, কেউ হেসে কথা বলেÑ আবার কেউ কেউ গ্রামীণ ফুল ও ফল-ফলাদি উপহার দেয়। বর্ষীয়সী মহিলারা গ্রাম্য পিঠা-পায়েশ খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তেমনি বেলিকে খুশি করার উদ্দেশ্যে গ্রামের শেখ মহর আলি (ওরফে মহর) পকেটে করে কিছু ডাঁশা-ডাঁশা বরই এনে দিল আমারই চোখের সামনে। বরইগুলো রায়দের মঠের পাশে জন্মানো একটি সুউচ্চ বরই গাছ থেকে আনা। মহর আমার থেকে পাঁচ-ছয় বছরের বড়। তার হাতেও অনেক শক্তি। দূর থেকে ঐ বরই গাছে চ্যাঙ্গা বা ঢিল ছুঁড়েই নিশ্চিতভাবে সে এসব বরই পেড়ে এনেছে। তা না হলে ঐ গাছে কেউ উঠতে সাহস করবে না! কারণ, একদিকে যেমন গাছটি অনেক উঁচুতে গিয়ে ডালপালা দিয়েছে, অন্যদিকে এর নিচে ঘন বিন্যস্ত কাঁটাবন। এর উপর ‘গোঁদের উপর বিষফোঁড়া’র মত আলকুশি বা ‘দয়ার গুড়া’ লতার আধিক্য। আর ঠিক এ সময়েই আলকুশির লতাগুলো যায় শুকিয়ে। শুধু এর হুলওয়ালা সোনালি রংয়ের শিমগুলো থোকায় থোকায় ঝুলতে থাকে। অজান্তে কেউ যদি এ কাঁটাবনের মধ্যে ঢুকে বরই কুড়াতে যায় এবং সেসময় জোরে বাতাস বয়ে গেলে, কিংবা চলাফেরার সময় আশপাশের ঝোঁপঝাড় কিছুটা নাড়া খায়, তাহলে আর রক্ষে নেই! গা, হাত-পায়ে এমনভাবে চুলকানি শুরু হয়ে যায় যে, শেষে কাপড়-চোপড় সব খুলে রেখে রায়দেয় পুকুরে গিয়ে ঝাঁপ দিতে হয়!

মহরের কথা অবশ্য আলাদা। ‘দয়ার গুড়া’ সম্পর্কে সবকিছুই তার জানা। তাই দূর থেকে ঢিল বা চ্যাঙ্গা মেরে আধ ঘন্টা বা এক ঘণ্টা পরে সে বরই গাছটার নিচে গিয়ে পাকা কিংবা ডাঁশা-ডাঁশা বরইগুলো কুড়িয়ে আনতে পারে। তাছাড়া রায়দের একটা তালগাছ থেকে রস সংগ্রহ করার জন্য মহর প্রায়শই মঠের কাছে যায়। এজন্য বরই পেড়ে আনাটাও তার পক্ষে বেশ সহজ।
বেলি বরইগুলো পেয়ে খুবই খুশি। মুখে বেশ কয়েকবার ধন্যবাদও দিল মহরকে। সবকিছু দেখে আমার মনে কিছুটা ঈর্ষার জন্ম নিলো। মহর আমার চাইতে অধিকতর প্রিয় হয়ে উঠছে, আমারই ভাগ্নির কাছেÑ এটা যেনো আমার পক্ষে সহ্য হচ্ছিল না! অথচ, এরূপ মানসিকতা আমার কখনও ছিল বলে মনে হয় না। আমি বললাম

-বেলি! তুমি বরই পছন্দ কর, তাতো আমাকে বলেনি? আমাদের দু-দুটা বরই গাছ আছে। কাল তোমাকে আমি অনেকগুলো বরই পেড়ে দেব।
-ছোটকা মামা! টক-মিষ্টি বরই ও ডাঁশা পেয়ারা আমার খুবই পছন্দের। বেশি করে বরই পেলে ভর্তা করে খাবার বড়ই ইচ্ছা আছে আমার।
বেলি ও মিলি দু’জনেই আগ্রহী হয়ে জানালো।
আমি পরদিন সকালবেলায় স্কুলের পড়া শেষ করে রান্না ঘরের উপরে এলিয়ে পড়া বরই গাছটাতে উঠে টালির ছাদে পা রাখলাম। বরইগুলো তখনও পাকেনি। তবে এগুলোর মাঝ থেকে বেছে বেছে বেশ কয়েকটা সবেমাত্র বাত্তি হওয়া এমন বরই সংগ্রহ করলাম। সঙ্গে বেশ কিছু সংখ্যক আকারে ছোট, অথচ অকাল পরিপক্ব ও লাল হয়ে ওঠা বরইগুলোকেও সঙ্গে নিলাম।
হাফপ্যান্টের দু’পকেটে বরইগুলোকে ঢুকিয়ে আমি পার্শ্ববর্তী দালানবাড়িতে গিয়ে উপস্থিত। তছলুদের রান্নাঘরে তখন সকালের নাস্তা তৈরির তোড়জোড়। মেম খালার মা নানীজানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, বেলি-মিলিরা এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। আর রওশন (হাবিব ভাইয়ের স্ত্রী) আপা বাড়ির উত্তর সীমানায় আগের খাল বরাবর খাট্টা পায়খানায় (উপরে টিনের ছাউনি দেয়া) প্রাকৃতিক কার্যাদি সারতে ব্যস্ত। আমি উপায়ান্তর না দেখে পাতকুয়ার (উপরে চারদিকে ইট-সিমেন্টের চক্রাকৃতির দেয়ালঘেরা) আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে থাকলাম। রান্নাঘরের পেছনে উত্তর দিকে একটা লোহাজাম গাছ উপস্থিত। পাকা জাম কুড়ানোর জন্য জামগাছ তলায় গেলাম। কিন্তু তখনও জাম পাকেনি বলে কোনো লাভ হলো না। যা হোক, প্রায় আধা ঘণ্টা বা পৌনে এক ঘণ্টা পরে রওশন আপাকে একটা খালি কাঁসার বদনা হাতে পাতকুয়াটার দিকে আস্তে আস্তে এগুতে দেখলাম। কুয়ার কাছে এলে আমি তাঁকে সালাম জানিয়ে বললাম

-আপা! কুয়া থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলে দেব নাকি?
-দাও না ভাই। এখনও হাত মুখ ধোঁয়া হয়নি।
রওশন আপার পরনে একটা শাড়ি। চোখে চশমা। মাথার চুলগুলো কিছুটা এলোমেলো, রুক্ষ্ম, সামনের দিককার চুলগুলো কিছুটা কোঁকড়ানো। শারিরীকি গঠন একহারা ধরনের, মাঝারি উচ্চতার এবং গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম।
বালতি দিয়ে পানি তুলে দেবার পর রওশন আপা টুথপেস্ট ও ব্রাশ ব্যবহার করে প্রথমে দাঁত পরিস্কার করলেন। পরে মুখমন্ডলে পানির ঝাঁপটা মেরে মুখ ধুয়ে ফেলার সময় আমি বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম
-রওশন আপা! যদি কিছু মনে না করেন, একটা প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে?
-অবশ্যই পারো ভাই। আমার মনে করার কী আছে?
-আপনার কী কোনো অসুখ-বিসুখ আছে, আপা?
-কেন রে ভাই? এ কথা কেন বলছো?
-আপনি পায়খানায় গিয়ে এতটা সময় নিলেন, ভাই!
-হ্যাঁ ভাই, আমি অমাশয় ও পিত্তশুলে খুব কষ্ট পাচ্ছি।
এর মধ্যে রওশন আপার হাত-মুখ ধোয়া শেষ হয়ে গেছে। তিনি দালানের দিকে হাঁটতে শুরু করে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
-চল, উপরে দোতলায় গিয়ে কথা বলি। ছোট মেয়েটা কখন উঠে যায়, তার ঠিক নেই। আর জেগে উঠলেই দুধ খেতে না পেলে চীৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবে।
পকেটে রাখা বরইগুলো বেলিকে দিতে পারবো ভেবে রওশন আপার সাথে সাথে দোতলায় উঠলাম সিঁড়ি বেয়ে। আপা তার প্রশস্ত কামরায় ঢুকে বারকয়েক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন। তাঁর ব্যথা ভারাক্রান্ত মলিন মুখাবয়বের দিকে চেয়ে একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না। বললাম
-রওশন আপা। আপনারা তো বড়লোক। কোনো কিছুরই সম্ভবত অভাব নেই। কিন্তু আপনার মনে কী কোনো কারণে খুব দুঃখ আছে?
আপা কিছুক্ষণ আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে জবাব দিলেন
-হ্যাঁ ছোট ভাই। আমি বড়ই দুঃখী। তবে এর কারণটা তোমাকে বলা যাবে না। তুমি এখনও খুব ছোট। তুমি এসব বুঝবে না।
আমার কৈশর মনের কৌতুহল অন্তরেই চাপা পড়ে রইলো। এর মধ্যে পাশের কামড়া থেকে মিলি ও বেলি মায়ের কামরায় এসে দেখলো যে, আমি কথাবার্তা বলছি। দু’জনেই চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো
-ও! ছোটকা মামা! কতক্ষণে এলে। আমাদেরকে জানাওনি কেন?
আমি উত্তরে বললাম
-আপার সাথে নিচে দেখা হয়ে গেল। তাই এতক্ষণ তাঁর সাথেই কথাবার্তা বলছিলাম আর কি! যা হোক, এই নাও তোমাদের পছন্দের বরই। যদিও এখনও ভাল করে পাকেনি, তবে খেতে খারাপ লাগবে না।
বরইগুলো দিয়েই আমি ছুটে এলাম আমাদের বাড়িতে। কারণ, এখন স্কুলে যাবার সময় প্রায় হয়ে এসেছে।