মুহম্মদ ফজলুর রহমান : বাংলা ভাষা, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বদ্বীপ, বঙ্গোপসাগর সব ‘ব’য়ে ঘেরা বাঙালি। আর জাতির জনকও ব’য়ে বঙ্গবন্ধু। সব যেন একাকার। এসব কথা বলতে গিয়ে বাঙালি দিশেহারা হয়ে পড়ে। বাঙালির হৃদয়ে কেবল রক্তক্ষরণই হয় এসব কথায়। কলমে লেখা হারিয়ে যায়, ভাষার যোগান হয় না।
বাঙালির জন্য এত মায়া, এত ভালোবাসা কোন পলিমাটি থেকে জন্মেছিলে তাঁর বুকের জমিনে! বাঙালির আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন, চাহিদা, চাওয়া-পাওয়া সবই জমে ছিল বঙ্গবন্ধুর বুকে। তাঁর নিজের কোন স্বপ্ন ছিল না, নিজের বলে কিছুই ছিল না। ব্যক্তিগত সুখ, স্বস্তি, সংসার, পরিবার, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা, সন্তানদের প্রতি স্নেহ বাৎসল্য, ব্যক্তিগত প্রেম-প্রীতি সবই উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালিকে স্বাধীন করতে। সব বঞ্চনা-বৈষম্য থেকে মুক্ত করার লড়াইয়ে। তাঁর সব ভাবনা, সব স্বপ্ন ঘিরে ছিল বাংলার মাটি আর মানুষ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ৫৪ বছরের সমগ্র জীবনটাই ছিল স্বদেশ মাটির জন্য, স্বদেশবাসীর জন্য উৎসর্গীকৃত। বাংলা আর বাঙালি এই ছিল তাঁর ভালোবাসা, ধ্যান-জ্ঞান। বিশ্বসভাতেও তিনি যতটুকু সময় এবং সুযোগ পেয়েছেন, বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতিকে গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত করে গেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১’র মার্চ মাসে পাকিস্তান ক্ষমতা হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র করলে পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে যে আগুন জ্বলতে শুরু করে সেই অনুকূল পরিবেশের সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতার কথা ভেবেছিলেন এবং ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবং ‘ঘরে ঘরে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যায় যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার কথা’ বলেছিলেন। স্বাধীনতা বিরোধীরা পাকিস্তান ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবতে পারতেন না, সর্বশক্তি দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতো বলে তারা বঙ্গবন্ধুকে জানার চেষ্টা করেননি। তাই প্রশ্ন তোলেন- জাতির আবার পিতা কি? অথচ এরাই পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পিতা মানতে আনন্দ এবং গৌরব বোধ করতেন। তারা জানে যারা জন্ম দেন, তাদেরকে পিতা মানা হয়। পাকিস্তানপন্থীরা জ্ঞানপাপী, তাই সব জেনেও বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানতে চায় না। লজ্জা লাগে স্বীকার করতে, নইলে পাপবোধ করে।
যারা বাঙালি জাতির উত্থান ইতিহাস জানেন, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের লড়াই-সংগ্রামের এবং ৩০ লাখ মানুষের স্বাধীনতার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ আর ইসলামের নামে ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নেয়ার নির্মম ও নিষ্ঠুর ইতিহাস জানেন এবং বিশ্বাস করেন, তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে, সম্ভ্রমের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতির স্বাধীন বাংলাদেশের পিতা মানতে গৌরব বোধ করেন। বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের বাঙালি জাতির জনক। তাঁর আগে বাঙালি জাতির সুসংবদ্ধ কোন রূপ দিয়ে, তাদের মনে বীর বাঙালির ধারণা দিতে এবং স্বাধীনতার জন্য স্বপ্ন দেখাতে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে নিজের জীবন-যৌবন উৎসর্গ করেননি।
বঙ্গবন্ধুকে জানতে, তাঁর অবদান স্বীকার করতে এবং জাতির জনক মানতে খুব বেশি কষ্ট নিতে হবে না। যদি কেউ একটু খোলা মনে আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, স্বাধীনতার আগে এবং পরে তাঁর বিভিন্ন ভাষণ পাঠ করেন, তবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাঁর বোধের ভেজাল দূর হয়ে যাবে। ধারণা পরিষ্কার হবে এবং বিশ্বাস করতে আর কোন জটিলতা বা অবিশ্বাস থাকবে না যে, বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ- সবকিছতে বঙ্গবন্ধু মিশে আছে।
বাঙালি হতে গেলে শুধু বাঙালির ঘরে জন্ম নিলেই হবে না। শুধু বঙালি জবান হলে চলবে না। বাঙালি হতে গেলে বাংলা, বাংলাদেশ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভালবাসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস রাখতে হবে। রাজনীতি নিয়ে বিরোধ থাকতে পারে। অমত, দ্বিমত, সমালোচনা থাকতে পারে। নেতা নিয়ে বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু জাতির পিতা নিয়ে থাকলে চলবে না। মূলে, ইতিহাসে, অস্তিত্বে অবিশ্বাস হলে চলবে না। যারা মস্তিষ্কে, মননে, স্বপনে, পাকিস্তানের প্রেমে মশগুল, তারা ভেবেছিলেন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সবশেষ! বাংলাদেশ, বাঙালি, বাংলা ভাষা, বাংলার ইতিহাস, কৃষ্টি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সব শেষ। তা হয়নি, হতে পারে না। বাংলার জল-মাটি-হাওয়া থেকে বঙ্গবন্ধুকে পৃথক করার কোন উপায়তো নেই। সব যে একাকার! ব’তে বঙ্গবন্ধু, ব’তে বাংলাদেশ, ব’তে বাংলা ভাষা, ব’তে বঙ্গোপসাগর। ব’য়ে ঘেরা বাংলাদেশ। পৃথক করা যাবে কী করে!
ঘাতকরা তাই যতই ভাবুক সবশেষ, শেষ হয়নি। বঙ্গবন্ধু আছেন। প্রবলভাবেই আছেন। বরং ঘাতকরা নেই। যতটুকু তারা আছে, তা বাঙালিদের ঘৃণায়, ধিক্কারে। মীরজাফর হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসম্প্রদায়িক বিশ্বাস, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কখনোই বাঙালির বিশ্বাস থেকে পৃথকময়। তারা চিরঞ্জীব। তারা সংসপ্তক। কৃষকের দোল খাওয়া ফসলের হাসিতে, শ্রমিকের হাতুরিতে, কল-কারখানায় উৎপাদনে, সমৃদ্ধ সম্পন্ন বাংলাদেশের প্রতিটি ধূলিকণায় বঙ্গবন্ধু। সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর ছায়া। তাঁর তর্জনী নির্দেশনা। শোষণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ। অভাবী মানুষের মাথায় বঙ্গবন্ধুর স্নেহের পরশ। তিনি বাংলার, বাঙালির মহানায়ক, মহামানব। বাংলার গৌরব, বাংলার সৌরভ। বাঙালির নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যায় ভ্রমরের গুঞ্জনে, কোকিলের কুহুরবে, প্রকৃতির সবুজে শ্যামলে। বঙ্গবন্ধুকে দেখা যায় গ্রাম্যবালার অবসন্ন দুপুরে মধ্য পুকুরে, অবাধ সাঁতারে, গানে ও গীতিতে। নববধূদের মেহেদী রাঙা হাতে, নূপুর নিক্কনে, শিশুদের খিলখিল হাসিতে। বঙ্গবন্ধুকে দেখি প্রেমের সংলাপে। দেখি প্রতিক্ষণে, প্রতি পলে। বাংলার মানচিত্রে বঙ্গবন্ধুর মুখ। দেখি বাংলার পদ্মা মেঘনা গৌরী, যমুনার ছলাৎ ছলাৎ স্রোতে। প্রতি জনপদের কোলাহলে। বাঙালির হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে নিলেও রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় উচ্চারিত হবে জনকের নাম। উচ্চারিত হবে জয় বাংলা স্লোগানে। জাতীয় সঙ্গীতে।
ঘাতকরা ভাবতে পারেনি- বঙ্গবন্ধুর রক্তস্রোত ৩২ নম্বরের সিঁড়ি বেয়ে বুড়িগঙ্গা-বঙ্গোপসাগরের স্রোতে মিশে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৫২, ৫৪, ৬২, ৬৬, ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭১-এ ৩০ লাখ মানুষের জীবনদান, ২ লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমের মূল্য, মহৎ মহৎ সব অর্জন শেষ হয়ে যাবে না। ঘাতকরা ভেবেছিলে- বাঙালি বলে পরিচয় দেয়ার কেউ থাকবে না, লাল সবুজের পতাকা উড়বে না, আমার সোনার বাংলা গীত হবে না। সব ভুল। বাংলার মাটি থেকে বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির বিনাশ নেই। বাঙালির আনন্দ-বিষাদে, অহংকারে বঙ্গবন্ধু। প্রতি বাঙালির চোখের তারায়, হৃদস্পদনে বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু এখন আরও প্রবল। আরও বহুমুখে বিস্তৃত।
ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে বঙ্গবন্ধুকে আরও নানা আঙ্গিকে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকায় জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে আরও প্রসারিতভাবে দেখার-জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের অর্জন রক্ষায় তাঁকে অনেকটা একাই লড়াই করতে হচ্ছে। যারা আছেন, তাদের অনেকেই ভাত ছিটানো কাকের মতো। ভাত ছিটালে আছে, নইলে নাই! বঙ্গবন্ধু দেশ পরিচালনা করলেন মাত্র ৩ বছর সাড়ে ৭ মাস। একটি দেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার সুযোগ খুবই কম সময় পেয়েছিলেন, নিহত হলেন ঘাতকের হাতে। তিনি এমন পরিস্থিতির কথা বুঝতে পেরেছিলেন, সেজন্যই কি তিনি একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন যেমন বাঙালিদের দেখিয়েছিলেন, তেমনি মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে তিনি বাঙালিদের একটি আধুনিক সমৃদ্ধ, অগ্রসর, মানবিক এবং আলোকিত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভাবতে গেলে সত্যি বিস্ময় জাগে! তিনি সত্যি জল-হাওয়া-মাটি-মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে না পারলে এমনটি করে ভাবনা ভাবতে পারতেন কি এতো স্বল্প সময়ে? সবাইকে তাঁর জানা ছিল। বাঙালির অভাব কোথায়, বাঙালির চাহিদা কী, দেশের কল্যাণ কীসে, সমৃদ্ধি কীসে। বিদেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক হলে দেশের উন্নয়ন সহায়ক হবে। বিদেশের বৈরিতা থেকে দূরে থাকা যাবে। কৃষিনীতি, শিল্পনীতি, কৃষকের উন্নয়ন, শ্রমিকের উন্নয়ন, খেটে খাওয়া মানুষের উন্নয়ন- কী নিয়ে তিনি ভাবেননি! এসব ভাবনা সাড়ে ৩ বছরে কারো পক্ষে ভাবা সম্ভব? আসলে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতার ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে দেশকে গড়ার ভাবনাও একই সঙ্গে ভাবতেন বলে তা সম্ভব হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কার কথা ভাবেননি? বিশেষ করে যারা দেশ স্বাধীন করতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন, জীবন ও সম্ভ্রম দিয়েছিলেন তাদের এবং যারা দেশের অর্থনীতি ও সমৃদ্ধির মৌলিক শক্তি কৃষক-শ্রমিকের কথা, সমাজে তাদের অবস্থান-সম্মান, মর্যাদা নিয়ে সবসময়ই ভেবেছেন। কৃষক উন্নয়নে সমবায় ভাবনা, সাটিফিকেট মামলা প্রত্যাহার, জমির সিলিং করে, খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি জনতাকে মর্যাদা দিতে তিনি হোয়াইট কলার অফিসার, যারা কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের উপর ছড়ি ঘোরায়, তাদের উদ্দেশে বলতেন- ‘কার টাকায় আপনি ইঞ্জিনিয়ার সাব, কার টাকায় ডাক্তার সাব, কার টাকায় রাজনীতিবিদ সাব, চেয়ারম্যান সাব, কার টাকায় সব সাব? কার টাকায় আপনার বেতন হয়? কার টাকায় আমরা গাড়ি চড়ি? সব ঐ মেহনতি গরিব মানুষের টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলবেন।’ বঙ্গবন্ধু সমাজের এই বৈষম্য, অন্যায়-অসম্মান, অমর্যাদায় ক্ষুব্ধ হতেন। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন- ‘আমি বৈষম্যের এ সমাজকে চরম আঘাত হানতে চাই।’ তরুণসমাজ ও নারী প্রগতিতে তিনি আস্থা রাখতেন গভীরভাবে। তাদের তিনি দেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধি অর্জন এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের শক্তি বলে বিশ্বাস করতেন।
তিনি যে উচ্চারণ ১৯৭১-এর ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- সেই উচ্চারণ বাস্তবে রূপ দিতে আমৃত্যু মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির ভাবনা ছিল তার অন্তরে। কারাগারের ভেতরের থাকুন বা বাইরে, স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে বাঙালির মুক্তি, বাঙালির মানোন্নয়ন ছাড়া আর কিছুই ভাবতেন না। তিনি প্রায় ১৫ বছর পাকিস্তানের কারাগারে কাটিয়েছেন। সে অবস্থাতেও তিনি নিজের মুক্তি বা সংসারের প্রিয়জনদের কথা ভাবেননি। ভেবেছেন বাংলার মানুষের স্বাধীনতার কথা!
বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন- শিক্ষার বুনিয়াদ শক্ত করতে না পারলে, জাতিকেও একটি শক্তিশালী আধুনিক এবং সময়ের উপযোগী রাষ্ট্র করে গড়ে তোলা যাবে না। সে কারণেই তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দিতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারির প্রতিও তাঁর দরদ লক্ষ্য করা যায়। তার প্রমাণ মেলে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারিদের দাবির প্রতি সমর্থন দিয়ে ১৯৪৯-এর ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত পর্যন্ত হন। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্ত্বশাসন দেন। তিনি বিশ্বাস করতেন- শিক্ষকরা নিজেদের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ।
১৯৫০ সালের দিকে, এমন কি যখন তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতায় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়, তখনও তিনি জাতীয় নেতা হিসেবে প্রথম ৫ জনের মধ্যে ছিলেন না। তিনি ধাপে ধাপে সবাইকে টপকে কেবল অন্যতম নেতায় পরিণত হলেন না, এক নম্বর নেতায় পরিণত হলেন। এর পেছনে অনেকে রহস্য খোঁজেন। এর পেছনে কোন রহস্য নেই। তিনি বাংলার স্বাধীনতার কর্মসূচি সামনে রেখেই ধাপে ধাপে রাজনীতির সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উপরে উঠেছেন। নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগেও তিনি প্রথম সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হননি। তিনি রাজনীতির সর্বস্তরে নেতৃত্ব দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে করতেই নেতৃত্বের শীর্ষ চূঁড়ায় উঠেছেন। তিনি ধাপে ধাপে অভিজ্ঞতা এবং প্রজ্ঞা অর্জনের মধ্য দিয়েই রাষ্ট্রনায়কে রূপান্তরিত হওয়ার পথ অতিক্রম করেছেন। হয়েছেন রাজনীতির নায়ক থেকে মহানায়ক। হয়ে ওঠেন ‘খোকা’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ এবং ‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে ‘জাতির পিতা’।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান যখন স্বাধীনতা অর্জন করে, তখন থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে থাকা যাবে না। বাঙালি জাতির মুক্তি নিজস্ব স্বাধীনতায়। সেই স্বাধীনতা ১৯৭১-এ অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই-সংগ্রাম, জেল-জুলুম সব সয়েছেন। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি তার বিশ্বাসে অটল থেকেছেন। তিনি ওয়াদা করেছিলেন- ‘বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশা আল্লাহ’। সে ওয়াদা রক্ষা করেছেন ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে।
আবার দেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেল, যুদ্ধ বিধ্বস্ত সেই দেশ গড়ার কাজে একটি দিনও বিশ্রাম না নিয়ে মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন কর্মযজ্ঞে। সংসার, স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের কথা ভাবলেন না, তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আত্মনিয়োগ করলেন। হাত দিলেন পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত সব অবকাঠামো নতুন করে গড়ে তোলার কাজে। স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেখতে পেলেন ধ্বংস্তুপের উপর তিনি বসে আছেন। সরকারি গোডাউন খাদ্য শূন্য। সরকারি ট্রেজারি অর্থ শূন্য। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট সব ভাঙা। কোন কিছুর পরোয়া না করে তিনি নেমে পরলেন কর্মে। শুরু করলেন শূন্য থেকে। কোন কিছুর দিকেই তাকালেন না।
রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর প্রতি যাদের সংশয় ছিল, তারা বিস্ময়ে দেখতে থাকলেন নতুন রাষ্ট্র গড়ে তোলার কারিশমা! তিনি অনুধাবণ করলেন এই যজ্ঞ সম্পন্ন করতে শুধু অভ্যন্তরীণ সম্পদে কুলাবে না। বিদেশের সহযোগিতা লাগবে। দেশের মানুষের কল্যাণ আর মাতৃভূমিকে গড়ে তোলার স্বার্থে তিনি কোন দ্বিধা না করে বিদেশের সহযোগিতার আহ্বান জানালেন। তুলে ধরলেন দেশের পররাষ্ট্রনীতির দর্শন। বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে ভাষণ দিতে গিয়ে (৪ ডিসেম্বর ১৯৭৪, ঢাকা) প্রসঙ্গক্রমে বললেন, ‘…সবার সাথে আমি বন্ধুত্ব করতে চাই। আমি আমেরিকার সাহায্য নিয়েছি। সোভিয়েতও আমেরিকার সাহায্য নিয়েছিল বিপ্লবের পরে। আমি সবার সাহায্য নিচ্ছি, সাহায্য দাও আমাকে। আমি আমার দেশ গড়তে চাই। সবার সাথে বন্ধুত্ব চাই। আমার ফরেন পলিসি… ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরেন পলিসি। …সকলের সাথে আমি বন্ধুত্ব করতে চাই। কারো সাথে দুশমনি করতে চাই না।’ (ওঙ্কার সমগ্র, ৩২১ পৃ.) বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ে তোলার জন্য আশ্রয়হীনদের পুনর্বাসনের গুরুত্ব অনুভব করেছিলেন। সে প্রয়োজন মেটাতে অনেক দেশের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি দেশের সম্পদ সকলে মিলে ভোগ করার জন্য সমবণ্টনের কথা বলেছেন। ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাটের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনিই প্রথম জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে মাতৃভাষাকে বিশ্বসভায় মহিমান্বিত করেছেন।
সম্ভ্রম হারানো মা-বোনদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর নিজের নাম তাদের পিতার নাম হিসেবে ব্যবহার করতে পর্যন্ত বলেছেন। তাদের বিয়ে করার জন্য তাঁর অনুসারী যুবকদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি সদা সোচ্চার ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বাংলাদেশকে সবদিক থেকে স্বনির্ভর, সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন। ঘাতকেরা জাতির জনকের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। পাকবিলাসী ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানি ধারায় পরিচালিত দেশ বানাতে চেয়েছিল, পারেনি। দারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা থামেনি। সেই ধারাবাহিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে দেয়ার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর ছায়াতেও তাদের ভয়। ঘাতকের উত্তরসূরীরা বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যও রাখতে দিতে চায় না। বঙ্গবন্ধুর ছায়াতেও তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে কেঁপে ওঠে। তারা কতটা আহাম্মক! ২১ বছর চেষ্টা করে দেখেছে। পারেনি, সে কথা ভুলে গেছে। তারা অবিশ্বাসীর দল, তাই বিশ্বাস করতে চায় না- ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’। বাংলাদেশ যতদিন আছে, বঙ্গবন্ধু ততোদিন আছেন- ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড বাংলাদেশ ইনসেপারেবল’ হয়ে।
রাজনীতির নামে হোক, আর ধর্মের নামে, বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম কোনভাবেই মুছে ফেলা যাবে না। নতুন করে ইসলামের নামে তাদের অপকর্ম বাংলার মানুষ সমর্থন করবে না। বাংলার মানুষ জানে, ইসলামের আড়ালে রয়েছে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা। সে কারণে ভাস্কর্যের নামে বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্য ভাঙতে ষড়যন্ত্র করছে বলে ভাস্কর্য আর মূর্তি পৃথক করে দেখাচ্ছে। প্রথমটায় সফল হলেই তারা দ্বিতীয়টায় হাত দেবে। ভাস্কর্য, মূর্তি, পুতুল ব্যবহারের উদ্দেশ্য পৃথক হলেও আসলে পৃথক নয়। যারা অসম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং অন্যধর্ম পালনের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তাদের কাছে ভাস্কর্য এবং মূর্তির পার্থক্য গ্রহণযোগ্য হবে না। আসলে সত্য লুকাতে মতলবীরা এমন ব্যাখ্যা হাজির করার চেষ্টা করছেন। মৌলবাদীদের এটা রাজনৈতিক অপতৎপরতা। তারা ইসলামের নামে জল ঘোলা করে মাছ শিকার করতে আবার মাঠে নেমেছে। তাদের এই কুকর্মের অর্থ না বুঝলে বিপদ আছে।
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এই মাসে ক্ষমতার হিসেব-নিকেশে রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার চক্রান্তরোধে কতটা সোচ্চার হবেন জানি না, তবে মুক্তিযুদ্ধ করে জীবন দিয়ে, সম্ভ্রম হারিয়ে যারা দেশটা স্বাধীন করেছেন, তারা চুপ করে থাকবেন না আশা করি। তারা ঠিকই প্রতিবাদে সোচ্চার হবেন। এবং চক্রান্তকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সকল চক্রান্ত রুখে দেবেন। বিজয়ের মাসে আমাদের আরেক বিজয় হোক মৌলবাদীদের চিরতরে পরাজিত করে।
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অতল শ্রদ্ধা। যারা জীবন দিয়ে, সম্ভ্রম দিয়ে এবং জীবনের সমূহ ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, তাদেরকে সংগ্রামী শুভেচ্ছা। ৫০তম বিজয় দিবস সফল হোক। করোনামুক্ত হোক আমেরিকা, বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মানব সন্তান।
বাংলাদেশের বিজয় শুভেচ্ছা সবাইকে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঠিকানা। ১৮ ডিসেম্বর, নিউইয়র্ক।