কাজী ইবনে শাকুর : আমেরিকা যেখানে এক সময় দেশে দেশে মুক্তি সংগ্রামীদের অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত হতো আজ সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ মানবেতর দিন। বর্তমান প্রশাসন বিভিন্ন দেশ থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে এদেশে আসা লোকদের ডিটেনশনে আটকে রেখে অনেকটা বেল বন্ড নামের মুক্তিপণ আদায় করছে।
দক্ষিণ ক্যামেরুনের মুক্তি সংগ্রামে গভীরভাবে সম্পৃক্ত থাকা আবিরি নেলসন গেহ নামে এক ব্যক্তি পুলিশের হাতে তার ভাই নিহত হবার পর দেশত্যাগ করে। পুলিশ তার ভাইয়ের মতো তাকেও খুন করার জন্য খুঁজছে। তিনি পালিয়ে এসেছে, বাসে, পায়ে হেঁটে মেক্সিকো দিয়ে আমেরিকায়। তার আসা সীমান্তে তিনি আশ্রয় চাইলে আশ্রয় পাবেন। কিন্তু তাকে ২১ মাস আটকে রাখা হয়েছে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে। তাকে বন্দী রাখা হবে যতদিন না তিনি বন্ড দেয়ার জন্য ৫০,০০০ ডলার যোগাড় করতে না পারেন। এখন তার এসাইলাম মামলা আপীল কোর্টে। ভাগ্য তার দোদুল্যমান। গত গ্রীষ্মে তার ৫০০০০ ডলার যোগাড় হয়নি। কিন্তু সান দিয়েগো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিওগ্রাফির এক অধ্যাপক এনন মেরী ডিভানে কাছাকাছি অটো মেসা ডিটেনশন সেন্টারে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি প্রথম ২০ মাস বন্দী। অধ্যাপক লিখেন, ক্যামেরুন ও এখানে আপনি যেভাবে দিনযাপন করছেন, আমি তাতে গভীর দুঃখিত। আমি আপনার সাহসের জন্য ও স্বাধীনতার জন্য আপনার অবদানে আপনাকে অভিনন্দন জানাই।
এই ধরনের চিঠি পেয়ে ২৯ বছরের যুবক মি. গেহ উৎফুল্ল। সাহস পায় বেঁচে থাকার। নতুন করে এক পুরোনো মাধ্যমে মাইগ্রেন্ট বন্দীদের সাথে যোগাযোগ। আর তার উদ্ভাবক সান দিয়াগোর অধ্যাপক। গত সপ্তাহে এ ধরনের শত শত চিঠি যা বন্দীদের কাছ থেকে এসেছে তা প্রকাশ করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে। সেখানে অন্তত ২০টি দেশ থেকে আগত বন্দীর চিঠি রয়েছে। আর বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসন এই ধরনের অনেক বহিরাগতকে বাইরে রাখার জন্য দেয়াল নির্মাণের কথাকে তাদের সিগনেচার ক্যাম্পেটনে পরিণত হয়েছে। আর ভবিষ্যতে অবৈধরা যাতে আসতে না পারে সেজন্য তারা সীমান্ত সিলগালা করার মতলব করেছে।
কিন্তু প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনা নিয়ে ওয়াশিংটন যতই হম্বিতম্বি করুক না কেন, সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে আগত ইমিগ্র্যান্টদের এসব চিঠি-আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক নাটকের সৃষ্টি করেছে। এ নাটকের অংশীদার বাংলাদেশিরাও হতে পারে। অনেক বাংলাদেশি যারা সরকারি মহলের ক্রসফায়ার এর ভয়ভীতি মাড়িয়ে এদেশে এসেছে তাদেরও ৫ হাজার থেকে ৪০,০০০ ডলার পর্যন্ত বন্ড দিয়ে বের হতে হয়েছে। সানদিয়াগোতে আরেকজন ভূগোলের অধ্যাপক কেইট সোয়ানসন বলেন, আমেরিকায় আমাদের ইচ্ছা হচ্ছে অভিবাসনকে অমানবিক করে তোলা। আমরা তাদের কনক্রিটের বাক্সে রাখি। তা তাদের দৃশ্যমান করে তোলে।
বন্দীরা চিঠি লিখতে শুরু করেছে। অনেকে ব্যবহার করছে স্টাবি গলফ পেন্সিল, কমিশারী থেকে তা ৬ সেন্ট দিয়ে কেনা। তারা সাহায্যের আবেদন করে যখন তারা তাদের ধর্ষিতা হবার কাহিনী বলে। মার্ডার ও নির্যাতনের হুমকির শিকার হয় স্বদেশে। আর সীমান্তে তাদের সন্তানদের কাছ থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। স্বেচ্ছাসেবীরা আশ্চর্য হয় আর সমব্যথা জ্ঞাপন করে। ক্রিস্টমাসের কার্ড পাঠায়। কবিতা, ছবি এবং তাদের পরিবার সম্পর্কে সর্বশেষ খবর জানায়, তারা ডিটেনীদের একাউন্টে অনেক সময় কিছু অর্থও পাঠায়। তা দিয়ে তারা যাতে অতিরিক্ত খাদ্য ও পানীয়, টুথব্রাশ ও ¯িœকার কিনতে পারে। ঐসব ব্যক্তি যারা ডিপোর্টেশন এর জন্য অপেক্ষা করছেন, তাদেরকে নৈতিক সমর্থন দেয়ার জন্য হোয়ান্না ব্রকসনামে ইউনিভার্সিটির এসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্টদের একজন কাজ করছেন। তিনি বলেন এ কাজ ডুবন্ত জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে এক কাপ কফি পান করানোর মতো। এখন তিনি ২০০০ স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করছেন।
ফেডারেল ইমিগ্রেশনের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে ওঠে মেসব এক প্রাইভেট প্রিজন কর্পোরশনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ২০১৫ সালে সান দিয়াগের দক্ষিণ পূর্বে তা খোলা হয়। আইস এর এই কাস্টডিতে মোট ৯৩০ জনের মধ্যে ৮৭৯ জন পুরুষ। তবে অর্ধেকেরও কম আটককৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের দ- রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকর্ড এসেস ক্লিয়ারিং হাউজ এ তথ্য দিয়েছে। তাদের মধ্যে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো ও এদেশে অবৈধ প্রবেশের মামলাই সঠিক।
আল সালভেদর থেকে আসা ১৯ বছরের এক সমকামী লোক লিখেন, ‘আমরা ঐ লোক নয় যা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমাদের ভাবেন, আমি চাই আমরা কারা সে সম্পর্কে যারা আমাদের নিয়ে ভাবেন তাদের বিবেক জাগ্রত করতে। আমরা সোসাইটির প্রতি বিপজ্জনক নই।
চিঠিতে স্বদেশ থেকে এত দূরে এসব লোকদের কীভাবে বন্দী করে রাখা হয়েছে তার বর্ণনা দেয়া হয়। কাছে থেকে আসা একজন বলেন ‘যখন আপনি আমার চিঠির জবাব দেবেন তখন তা আমার জন্য খতিস্বরূপ। একথা সত্যি যে আপনাদের ভালোবাসা মিশ্রিত চিঠি আমাকে কাঁদায়। এভাবে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ বন্দীদের একাকীত্ব ঘুচায়, সি. গেহকে তার জন্ম দিনে আইস এর লোকেরা বাইরে নিয়ে যায়। এখন তিনি মালামোর এক বন্দী শিবিরে। গেহ বলেন, আমার কাছে তার সকল চিঠি আছে। আমি প্রতিদিন সেসব চিঠি পাঠ করি।
ছয় সপ্তাহের মধ্যে চিঠি লেখা ও বন্দীদের জন্য ফান্ড জমা রাখার প্রস্তাব করি। এই গ্রুপ অনুমান করে জুলাই থেকে তারা ১০,০০০ এরও বেশি ডলার ব্যয় করেছে। তাদের মধ্যে ১১৪০ জন আছেন তারা এদেশে নিজেদের গোত্রদের জাগানোর চেষ্টা করেছে। হন্ডুরাস থেকে আসা তাদের অনেকে এই ধরনের কাজে দেশ থেকে পালিয়ে এসেছে। ভারত, চীন, পাকিস্তান, কিউবা, জামাইকা, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশের অনেকেই সেখানে আছেন বলে ইউলাইসেস নামে একজন লিখেন। রোসানা বেনিক নামে একজন ভোলান্টিয়ারদের নিজ ঘরে এনে প্রতি সোমবার আপ্যায়ন করেন। অনেকে আবার যারা এসেছেন তাদের এখানে আসা ঠিক না বলে মনে করেন। অনেকে আবার ডিটেনশন থেকে আমেরিকায় থাকার জন্য অনুমতি পেয়ে চলে আসছে। অনেকে আবার চলে যাচ্ছে নিজ দেশে ডিপোর্টেড হয়ে। একজন লোক অধ্যাপিকা পারসনকে লিখেন তিনি এসেছেন হুন্ডুরাসের এম এস ১৩ গ্যাং মেম্বারদের মৃত্যু হুমকি এড়ানোর জন্য। তিনি তাকে তার দেশে যেয়ে স্বামী সম্পর্কে লিখেন এবং হুন্ডুরাস ফুটবল টিমের স্কোর নিয়ে লিখেন, তিন মাস পর তাকে ডিপোর্ট করা হয়। প্রফেসর সোয়ানসন বলেন, এখন চিঠি লেখা বন্ধ। তিনি নিশ্চিত ছিল যে, সে ব্যক্তি মারা গেছে। তবে গত সপ্তাহে জানা যায় সে বেঁচে আছে। তবে কাজের জন্য মেক্সিকো যাওয়ার কথা ভাবছে। তিনি আর আমেরিকার আসার চেষ্টা করবেন না। কিন্তু তার মনে স্থায়ী হয়ে রয়েছে প্রফেসর সোয়ানসন এর চিঠিসমূহ। তিনি বলেন, চিঠি নিয়ে আমি মনে করেছিলাম আমার এক পরিবার আছে। আমেরিকার বাংলাদেশিরা কি কখনও একথা ভেবে দেখেছেন বাংলাদেশের কত লোককে বিতাড়রন করা হয়েছে? তাদের জন্য আমাদের এ দেশের লোকজন কি কিছু করছেন? বাংলাদেশিরা কি কখনও ভেবেছেন?