জয়া ফারহানা
এক দিন এক নেকড়ে ঝর্ণায় জল খেতে গিয়ে দেখে ঝর্ণার নিচ দিকে কাচুমাচু ভঙ্গিতে এক ভেড়াছানা জল খাচ্ছে। দেখে জিভে জল এসে গেল নেকড়ের। ভেড়াছানাটিকে তার চাই-ই চাই। কিন্তু বিনা দোষে ভেড়াছানাটিকে খাওয়া যায়-ই বা কী করে? কিন্তু খেতে তো হবেই। নেকড়ে তখন কাচুমাচু ভেড়াছানাটিকে বলল, ওরে পুঁচকে, হতচ্ছাড়া, পাজি ভেড়ার ছানা, তোর কি আক্কেল বলে কিছু নেই? দেখছিস না ঝর্ণার উপরে আমি জল খাচ্ছি। এত বড় সাহস তোর, আমার জল ঘোলা করিস ভেড়ার ছানা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, নেকড়ে মশাই, আমি তো আপনার জল ঘোলা করিনি। আমি নিচের দিকের জল খাচ্ছি। আর জল তো আসছে ওপর থেকে। আপনি আছেন সেখানেই। আর আমি রয়েছি নিচে। আমার পক্ষে কি আপনার জল ঘোলা করা সম্ভব? নেকড়ে বলল, তুই পাঁচ বছর আগে আমাকে গালি দিয়েছিলি। ভেড়াছানার উত্তর, নেকড়ে মশাই, পাঁচ বছর আগে আমার জনই হয়নি। আপনাকে গালি দিব কীভাবে? এবার দাঁত কিড়মিড় করে নেকড়ে বলল, তুই দিসনি কিন্তু তোর বাপ দিয়েছিল। এ জন্য এখন আমি তোর ঘাড় মটকে খাবো। বলা মাত্র নেকড়ে লাফিয়ে পড়ল ভেড়াছানার ওপর।
গত ২১ মে বিডিনিউজ২৪ডটকম-এর একটি রিপোর্টে এমন এক ভেড়াছানার ওপর নেকড়ের আক্রমণ দেখছি। দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রামে র্যাবের সোর্স পরিচয় ভুল করায় হাবিব নামের নিরীহ একজন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। বন্দুকযুদ্ধ বলতে আমরা বুঝি দু’পক্ষের হাতেই বন্দুক। আর সব প্রশ্ন যদি ছেড়ে দিই, যদি কেবল এই মামুলি প্রশ্নটিও করি, একপক্ষের হাতে থাকা বন্দুক দিয়ে গুলি করে মেরে ফেললে কেন তার নাম বন্দুকযুদ্ধ, তবু আশা নেই উত্তর পাওয়ার। সম্ভবত ক্রসফায়ার নাটক সবার মুখস্থ হয়ে যাওয়ায় এবং এর মর্ম আত্মস্থ করতে পারায় এই নতুন নামকরণ। তবে তাতেও কুল রক্ষা করা মুশকিল। ক্রসফায়ারের মতো বন্দুকযুদ্ধও বটতলার পুঁথিতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ২০ জন বন্দুকযুদ্ধে মারা যাচ্ছেন। পুলিশের দেয়া তথ্যানুযায়ী তারা সবাই ভয়ঙ্কর মাদক ব্যবসায়ী। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন থাকলে এদের প্রত্যেকের আইনের মাধ্যমে বিচার হতো। বিচার বিভাগ যে মামলার ভারে ভারে অচলায়তনে পরিণত হয়েছে এবং বিচার বিভাগের ওপর খোদ সরকারি দলের লোকেদেরই যে আস্থা নেই তার প্রমাণ তারা নিজেরাই বলছেন এই মাদক ব্যবসায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হলে এদের ৯৯ শতাংশই নাকি জামিনে ছাড়া পেয়ে যেত। ভয়ঙ্কর মাদক ব্যবসায়ীরাও জামিন পান তবে বন্দুকযুদ্ধের নাটক কোনো কাকতালীয় বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ধরা মাত্রই কাউকে গুলি করে মেরে ফেলা, হতে পারে সে সন্ত্রাসী, হতে পারে মাদক মামলার আসামি, হতে পারে খুনের আসামি কিন্তু রাষ্ট্র কখনই কাউকে বিনাবিচারে হত্যা করতে পারে না। বেয়াই হলেও না। সরকারের ওপর মহল থেকে হয়তো ভাবা হয়েছিল বেয়াইকে হত্যা করে এই বন্দুকযুদ্ধকে জায়েজ করা যাবে। কিন্তু যা অন্যায় তা বেয়াইয়ের সঙ্গে ঘটলেও অন্যায়, বিরোধী নেতাকর্মীদের মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে করলেও অন্যায়। একজন অপরাধীর বিচার না হওয়াও তত বড় অন্যায় নয়, যত বড় অন্যায় একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা।
তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে সরকার একটি ভয়ের সংস্কৃতি সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে যেন কেউ সরকারের অন্যায় কর্মকা-ের বিরুদ্ধে মুখ না খোলে। বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজাতে সক্ষম যে কেউ ব্যক্তিগত শত্রুকে প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে। পুলিশের সোর্সদের ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা ষোলো আনা। আরো একটি পরিকল্পনাও আছে এই বন্দুকযুদ্ধের। তা হলো- যারা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছে তাদের গডফাদারদের আড়াল করা। কোন পুলিশ বাহিনী ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ সেøাগান নিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছে? যে পুলিশের অবৈধ আয়ের সিংহভাগ আসে মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে, সেই পুলিশ? পুলিশের প্রত্যক্ষ সমর্থন সহযোগিতা ছাড়া কোনো এলাকায় মাদক ব্যবসা সম্ভব? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইনবহির্ভূত কার্যকলাপ নিয়ে জনমনে বিস্তর প্রশ্ন। প্রশ্ন, ক্রসফায়ার বন্দুকযুদ্ধ এনকাউন্টার নিয়ে। প্রশ্ন অপহরণ নিখোঁজ গুম নিয়ে। প্রশ্ন রিমান্ডে পুলিশের বাড়াবাড়ি নিয়ে। প্রশ্ন জনগণের সঙ্গে পুলিশের ব্যবহার নিয়ে। পুলিশের ক্ষমতায়ন হয়েছে সন্দেহ নেই। বেতন বেড়েছে। সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। কমেছে জবাবদিহি। যখন তখন যে কাউকে তারা ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে পারে। গ্রেফতার করার জন্য যেসব পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা অনুসরণ না করলে তাদের যে খুব চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয় তাও নয়। কে চ্যালেঞ্জ করবে? চ্যালেঞ্জ করলে যে তদন্ত কমিশন গঠন হবে সেখানেও পুলিশ। পুলিশ নিজের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কি নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করবে? তবে সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ নিয়ে সব প্রশ্ন ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ। না, একটু ভুল বলা হলো। বন্দুকযুদ্ধের চেয়েও বড় আলোচনার বিষয় পুলিশ যাদের কাছ থেকে টাকা খাচ্ছে তাদেরই আবার বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করছে এই প্রসঙ্গ। এত ভালো পারফরম্যান্সের কারণেই বোধহয় ২০১৩ সালে টিআইবির জরিপে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবাইকে হটিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল পুলিশ বিভাগ।
দুর্ভাগ্য স্বাধীন দেশের স্বাধীন পুলিশ বাহিনী অথচ এখনো এই পুলিশের বহু আইনকানুন পরাধীন সময়ের আইনকানুন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। পুলিশকে এসব আইনকানুন দিয়েই ট্রেনিং দেয়া হয়। যে কারণে বহু ক্ষেত্রে তাদের আচরণ পরাধীন দেশের পুলিশের মতো। কখনো কখনো সে আচরণ পরাধীন দেশ ছাপিয়ে সামন্ততান্ত্রিক আচরণে রূপ নেয়। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, গ্রেফতারের সময় মৃত্যু, পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর চেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর কিছু হতে পারে না। মাদক ব্যবসা যে কত খারাপ, মাদক ব্যবসায়ীরা যে দেশকে একেবারে তছনছ করে দিচ্ছে তা নিয়ে প্রচুর লেখা হচ্ছে। সন্দেহ নেই এর সবই ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এত দিন কিভাবে মাদক ব্যবসায়ীরা দেশ তছনছ করে দেয়া এই ব্যবসা এত নির্বিঘেœ নিরুপদ্রবে চালিয়ে যেতে পারলেন?
দুই. ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র্যাব প্রতিষ্ঠার সময় একে একটি এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছিল। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল কেন এটি এলিট ফোর্স? এলিট ধারণা থেকে তৎকালীন রেগুলার ফোর্স প্রকৃত অর্থে এত দূরে সরে গিয়েছিল যে আলাদাভাবে আরেকটি ফোর্স গঠন করে তাকে এলিট বিশেষণ দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শূন্যে নেমে যাওয়া বা বিলুপ্ত ভাবমূর্তি উদ্ধারের এক রকম চেষ্টা আর কী। দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অপব্যবহারের কারণে পুলিশের ভাবমূর্তির প্যারামিটার আশঙ্কাজনক নিচে নেমে গেলে সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়ে ভাবমূর্তি উদ্ধার। সেই চেষ্টার ফলে র্যাব। প্রতিষ্ঠা হলো র্যাব। বলা হলো জমিজমা বা টাকা-পয়সা সংক্রান্ত এবং ব্যক্তিগত-পারিবারিক কোনো অভিযোগ র্যাব গ্রহণ করবে না। জনগণ তখন জানল পুলিশের মধ্যে এমন একটি ফোর্স তৈরি হয়েছে যারা রহিম মিয়ার বেড়ার সীমা ভেঙে করিম মিয়ার ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলা অথবা ফুফাতো ভাই কালা মিয়ার জমি মামাতো ভাই ধলা মিয়া দখল করে নেয়ার মতো আটপৌঢ়ে বিচার আচারের মধ্যে নাই। তবে তো এটা এলিট ফোর্সই বটে। কিন্তু এই ‘এলিট ফোর্স’ কি ‘এলিটীয়’ মূর্তি ধরে রাখতে পেরেছে? ১৩ বছর পর এই এলিট ফোর্স সম্পর্কে লোকে কী ধারণা করে তা কখনো কোনো জরিপে পাওয়া যাবে না। প্রকৃত তথ্য পেতে হলে ভিন্ন পথ ধরতে হবে। ঘাসের মধ্যে যেমন পিঁপড়া মিশে থেকে পরিস্থিতি বুঝে নেয় তেমন জনগণের মধ্যে জনগণ হয়ে বুঝতে হবে র্যাব সম্পর্কে লোকের ধারণা কী। ঠিক এলিট নয়, একটি বন্ধুসুলভ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলতে যে চেহারা আমরা ধারণা করি তার সঙ্গে না আমরা রেগুলার ফোর্সের কার্যকলাপ মেলাতে পারি না কোনো এলিট ফোর্সর কার্যকলাপ মেলাতে পারি। হাইকোর্টের নির্দেশনামা না মানার সংস্কৃতি রেগুলার ফোর্স থেকে এলিট ফোর্স প্রত্যেকের মধ্যেই আছে। হাইকোর্ট থেকে নির্দেশ দেয়া আছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কাউকে গ্রেফতার করলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতারের স্থান, সময় এবং যদি তাকে কোথাও আটক রাখা হয় তাহলে সেই স্থানের কথা তার নিকট আত্মীয়দের জানাতে হবে। এখানেই শেষ নয়। আবাস স্থান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও থেকে গ্রেফতার করা হলে ১২ ঘণ্টাও নয় সে ক্ষেত্রে জানাতে হবে এক ঘণ্টার মধ্যে। এটা নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার। শুধু তাই নয়। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে দিতে হবে। আইনজীবী এবং নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে পরামর্শের সুযোগও দিতে হবে। এমনকি গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে কী কারণে গ্রেফতার করা হলো তার কারণও জানাতে হবে। অপরাধী ধরার এবং বিচার করার এই পুলিশি পদ্ধতির কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় প্রত্যেকটি ফোর্সই ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে। গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশ মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা না করার বহু রেকর্ড আছে। সে রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে বন্দুকযুদ্ধে হত্যার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করা এবং বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া সংখ্যাধিক্যের রেকর্ড।
তিনযারা পুলিশি হেফাজতে মারা যাচ্ছেন, যারা বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছেন, যারা গুম খুন অপহরণের শিকার হচ্ছেন এবং যারা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছেন তাদের প্রত্যেকের অসহায়ত্ব আমাদের অনুভব করা দরকার। যে কেউ যখন তখন আমরা এই পরিস্থিতির শিকার হতে পারি। শুধু সে কারণেও নয়। মানুষ হিসেবেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করা উচিত।
মধ্যযুগের বিচারহীনতার সংস্কৃতি কি আবার ফিরে আসবে বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে? অমূলক সন্দেহে যখন তখন হত্যা হবে বিরোধী মতাদর্শের অথবা নিরীহ কোন নাগরিক? কোনো রকম বিচার না করে একজন মানুষকে হত্যা করে ফেলা খুব বড় ধরনের অপরাধ। আমরা যদি নিজেদের সভ্য মানুষ পরিচয় দিতে চাই, যদি দেশকে সভ্য পরিচিতি দিতে চাই তাহলে অবশ্যই বিচারবহির্ভূত তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের প্রতিবাদ করতে হবে।
লেখক : কলাম লেখক