ছন্দা বিনতে সুলতান
জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে।/ চিরস্থির করে নীড়, হায়রে, জীবন…নদে?
জন্মিলে মরিতে হবে- এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু কিছু মৃত্যু আমাদের হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিয়ে যায়। আমরা ভুলতে পারি না তাদেরকে তাদের সৃষ্টিকর্মকে। তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকেন আমাদের হৃদয়ের মাঝে। বরেণ্য আবৃত্তিকার, মহান মুক্তিযোদ্ধা, স্থপতি কাজী আরিফ এমনই একজন। ২০১৭ সালের ২৯ এপ্রিল নিউইয়র্কের মাউন্ট সেনাই হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার কন্যা অনুসূয়া সবাইকে তখন অনুরোধ করেছিলেন আমরা যেন তার বাবাকে ভুলে না যাই। না, আমরা ভুলিনি তার বাবাকে, আমাদের প্রিয় কাজী আরিফ ভাইকে। দেখতে দেখতে এক বছর, অর্থাৎ ৩৬৫ দিন হয়ে গেলো আরিফ ভাই এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে। আছেন দূর আকাশের মাঝে জ্বলজ্বলে এক তারা হয়ে। তার সেই বলিষ্ঠ ভরাট কণ্ঠে যেন বলছেন- নির্ভয়ে কবিতা পড়, জানই তো নক্ষত্রেরও পতন হয়।
কাজী আরিফ জন্মেছিলেন ফরিদপুরের রাজবাড়ীতে, ১৯৫২ সালের ৩১ অক্টোবর। কিন্তু তার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম শহরে। সেখানেই তার পড়াশুনা, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্যের হাতেখড়ি। ১৯৭১ সালে ১ নম্বর সেক্টরের মেজর রফিকের কমান্ডে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধশেষে বুয়েটে ভর্তি হন। বুয়েটে অধ্যয়নকালে তিনি শিল্প-সাহিত্যের চর্চা চালিয়ে যান। কাজী আরিফ জাতীয় বসন্ত উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আশির দশকে বাংলাদেশে আবৃত্তি চর্চা ও আবৃত্তি শিল্পকে আধুনিক সংগঠিত রূপ দিতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন। বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তাদের অন্যতম তিনি। তার উল্লেখযোগ্য আবৃত্তি অ্যালবাম- পত্রপুট। আবৃত্তি চর্চায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি কাজী সব্যসাচী পুরস্কার পান।
এমন মহান একজন মানুষের সান্নিধ্যে আসার কিছুটা সুযোগ আমার হয়েছিলো। তারই কিছুটা তুলে ধরছি। প্রিয় মানুষকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে কিছু লেখা অনেক কঠিন কাজ। আজ সেই কঠিন কাজটি আমায় করতে হচ্ছে। চোখ দুটো শুধুই ঝাঁপসা হয়ে আসছে!
আমি ভীষণ কবিতাপ্রেমী। কবিতা আবৃত্তি আর লেখালেখির সাথে আমার সখ্য সেই শিশুকাল থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে তখনকার বেশ ক’জন আবৃত্তিকারের সাথে পরিচয় হলেও কাজী আরিফের সাথে সাক্ষাৎ হয়নি কখনো। নিউইয়র্কে এই প্রিয় ব্যক্তিত্বের সাথে সাক্ষাৎ হয় বহুবচনের এক অনুষ্ঠানে। সালটা ঠিক নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, খুব সম্ভবত ২০১৩ সালের কথা। বহুবচনের অনুষ্ঠানটি ছিল মুন্না ভাই, অর্থাৎ হক ইয়োলো ক্যাবের অফিসে। শুনলাম কাজী আরিফ ভাই এসেছেন। তার আগের দিন তিনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, তাই বেশ কিছুটা ক্লান্ত। আমারও ফেরার তাড়া বেশি থাকায় স্বরচিত কবিতা পাঠ করেই চলে এলাম। তাঁর সাথে সেদিন আর পরিচয় হলো না। কাজী আরিফ ভাই নিউইয়র্কের বহুচন নামক সংগঠনটির সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন । কবি শামস আল মমীন এবং মুজিব বিন হকের সাথে রয়েছে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। আমি বহুবচনের সাথে ওতেপ্রোতভাবে জড়িত। বহুবচনে নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি করি, স্বরচিত কবিতা পাঠ করি। কাজী আরিফ ভাইকে সামনে দেখলেই মাইক্রোফোন হাতে প্রথমেই যে কথাটি আমি বলতাম, তা হলো বিখ্যাত আবৃত্তিকার কাজী আরিফ ভাই আমার সামনে, তাই আমি কিছুটা নার্ভাস। একদিন শামস আল মমীন ভাইয়ের লেখা একটি কবিতা আবৃত্তি করছিলাম। আবৃত্তি শেষ হলে আরিফ ভাই আমাকে বললেন- ছন্দা এমন কথা আর কখনো বলবে না, তুমি অনেক ভালো আবৃত্তি করো। এমনভাবে বললেন, আমি কিন্তু এরপর হতে কখনই আর এ কথাটি বলিনি। আরিফ ভাই বহুবচনের আসরে নিয়মিত আসতেন। আমাদের সাথেও সখ্য বাড়ে। যদিও তিনি আমাদের অনেক সিনিয়র, কিন্তু আড্ডাতে বসলে হয়ে উঠতেন সবার। খুব মনে পড়ছে, কবি শামস আল মমীন ভাইয়ের বাড়ির আঙিনার সেই আড্ডার কথা। মমীন ভাই বেলরোজে বাড়ি কিনেছেন। নতুন গৃহে প্রবেশ উপলক্ষে তার খুব কাছের কিছু মানুষকে দাওয়াত করেছেন। লোপা ভাবীর হাতের মুখরোচক খাবার খাওয়ার পর আমরা সবাই বাড়ির আঙিনায় বসলাম। নাম না জানা দুটো বড় গাছ আমাদের সেই দুপুরে হাত পাখার মত ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছিলো। হাস্যরসিক লেখক আবু রায়হান ভাই তার স্বভাবসুলভ গুণে আমাদের মাতিয়ে রাখছিলেন। যেন পণ করেছেন কারোই গোমড়া মুখ দেখবেন না! আরিফ ভাই, জলি ভাবী, রোকেয়া ভাবী কেউ যেনো কম নয়! আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজেকে খোলস থেকে বের করলাম। আমার বেড়ে ওঠা চট্টগ্রাম। আর তাই চট্টগ্রামের প্রাক্তন সাংসদ লিয়াকত ভাইকে সবসময় ‘বদ্যা’ বলে সম্বোধন করি। আমার চাঁটগ্যাইয়া ভাষা শুনে আরিফ ভাইও আমার সাথে চাঁটগ্যাইয়া ভাষায় কথা বলতে থাকেন। এমন বরেণ্য আবৃত্তিকারের কণ্ঠে বিশুদ্ধ চাঁটগ্যাইয়া ভাষা শুনে আমি তো তাজ্জব! সাঁঝ হয়ে এলে আমরা সবাই ঘরে ফিরে আসি। কিন্তু সেদিনের সেই স্বর্ণালী স্মৃতিটুকু আজও আমাদের মণিকোঠায় চির জাগরুক আছে।
২০১৫ সালের আমার কাব্যগ্রন্থ ‘বাতাসে খুঁজি ভালোবাসার ঘ্রাণ’ বের হয়। মাত্র এক কপি হাতে এসে পৌঁছেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশনের একটি অনুষ্ঠান। আরিফ ভাই নির্দিষ্ট সময়ে এসে বসে আছেন। আমি, আরিফ ভাইয়ের পাশে বসি। অরিফ ভাই আমার বইটি হাতে নিলেন। বললাম, ভাইয়া এক কপিই মাত্র পেয়েছি। তিনি বইটি নিয়ে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে পড়তে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মঞ্চে উঠার পালা। সেদিন আমি আমার লেখা আপন ঠিকানা কবিতাটি আবৃত্তি করলাম। মঞ্চ থেকেই দেখছি আরিফ ভাই আমার বইটি পাঠরত। কবিতা শেষ করে মঞ্চ থেকে এসে বসতেই আরিফ ভাই বললেন- ছন্দা সবগুলো কবিতা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি। তুমি একই সাথে কবিতা লেখো এবং আবৃত্তি করো, এমনটি খুব কম দেখা যায়। বেশ ভালো। আমি বললাম, ভাইয়া এই বইটির প্রায় সবগুলো কবিতাই আমার হাইস্কুল আর কলেজ পড়াকালীন সময়ের লেখা। আরিফ ভাই বললেন, তাতে কি, কবিতাগুলোতো বেশ ভাল হয়েছে। আরও লেখো, ভালো করবে।
খুব মনে পড়ছে, ২০১৫ সালে জুইস সেন্টারে বহুবচনের আয়োজনটির কথা। মহাকবি আলওলের পদ্মাবতীর সংক্ষিপ্ত এবং আধুনিকরূপ দিয়েছেন আবু রায়হান ভাই। এই পুঁথিটির ধারাবর্ণনা আমাকে করতে হবে। রায়হান ভাই স্বভাবে যতোটা হাস্যরসিক, অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ততোটাই সিরিয়াস। এক্ষেত্রে তিনি মি. পারফেক্টসনিস্ট! তিনি আমাকে বললেন, ছন্দা অন্যরা পুঁথিপাঠ করবেন, আপনি তা পৌঁছে দেবেন দর্শকের কাছে, তাই আপনার উপর দায়িত্বটা বেশি। আপনি ঠিকভাবে ফুটিয়ে তুললেই আমরা সাকসেসফুল!
কনকনে শীতের রাত, আগত দর্শক সবাই বোদ্ধা। আমি মঞ্চে থেকে দেখছি কাজী আরিফ ভাই মাথায় চাদর মুড়ি দিয়ে জবুথবু হয়ে বসে দেখছেন, সাথে আবৃত্তিকার মিথুন আহমেদ। অনুষ্ঠান শেষ হলেও আরিফ ভাই অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সাথে ছিলেন। বেশ প্রশংসা করলেন। এমন আরো অনেক স্মৃতি আছে তাঁর সাথে, সব এই স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়।
আর একটি ঘটনা শেয়ার না করলেই নয়। বিখ্যাত আবৃত্তিকার শিমুল মোস্তফা এসেছেন নিউইয়র্কে। উঠেছেন আবু রায়হান ভাইয়ের বাসায়। রায়হান ভাই আর কবি মিশুক সেলিম ভাইয়ের আয়োজনে জ্যামাইকায় শিমুল মোস্তফার আবৃত্তি সন্ধ্যা। অনুষ্ঠান শুরুর আগেই আমি অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছে যাই। একটু পরই কাজী আরিফ ভাই আসেন। চতুর্দিকে ক্যামেরা, ফ্লাস, সেলফি। এরই মাঝে আরিফ ভাই আমাকে দেখে আমার মাথায় স্নেহের পরশ রেখে বলে উঠেন, ছন্দা কোথায় ছিলে তুমি এতোদিন, তোমাকে তো কোথাও দেখি না? কোথায় থাকো তুমি? একসাথে অনেক প্রশ্ন! মনে হলো যেন বড় ভাইয়ের স্নেহের হাত মাথায় ছোট বোনের জন্য উদ্বিগ্ন! কাজী আরিফ ভাইয়ের সাথে যখন কথা বলতাম, কখনই মনে হয়নি তিনি বিখ্যাত আবৃত্তিকার কাজী আরিফ! সব সময় মনে হয়েছে ভার্সিটির একান্ত আপন, পরোপকারী বড় ভাইটি যেন।
আরিফ ভাইয়ের হার্টের অসুখ জানতাম। কিন্তু সেটা যে এতটা সিরিয়াস, তা জানতাম না। তার অট্টহাসির মাঝে যে এতটা রুগ্নতা কিংবা একাকীত্ব লুকিয়ে আছে, তা বুঝতে দিতেন না। ভেবেছি হার্টের অপারেশন শেষে আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন আমাদের মাঝে! না, তিনি এলেন না, আর ফিরে এলেন না! চলে গেলেন পরপারে! রাতের তারা দেখা আমার নিয়মিত অভ্যাস। তারার মাঝে যেন আমার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়মুখগুলো দেখি। নিউইয়র্কের নিয়নের আলোতে তারাভরা আকাশ দেখা যায় না। তাই এবার দেশে গিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসের বাসার খোলাছাদে বসে মনভরে তারাভরা আকাশ দেখেছি। প্রতিটি তারার মাঝে আমি হারিয়ে যাওয়া মুখগুলো খুঁজেছি। বাবা, ফুফু, নানা, নানু, মৃত আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, তাদের মাঝে আরিফ ভাইয়ের মুখটিও ভেসে উঠেছে। পরপারে ভালো থাকবেন আরিফ ভাই। নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই।