বস্টনে জমজমাট বৈশাখী মেলা

বস্টন থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি : অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বাঙালি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ এবং এই সার্বজনীন উৎসবে। প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে এ ধরনের উৎসবের মাধ্যমে খুঁজে পায় মা ও মাটিকে। ম্যাসাচুসেটসের নিউ ইংল্যান্ড বাংলাদেশী আমেরিকান ফাউন্ডেশন (নিবাফ) ইনক প্রতিবারের মত এবছরও ৫ মে শনিবার বস্টনের মেডফোর্ড স্কুল অডিটরিয়ামে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযুদ্ধাদের সম্মাননাসহ দিনভর বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪২ কে বরণ করেছে।

বিকাল ৪টায় নিউ ইংল্যান্ড রাওয়ান রমজান বাংলা স্কুল, রাওয়ান ইসলামিক স্কুল, রুহানি মমতাজ সঙ্গীত নিকেতনের আয়োজনে অনুর্ধ ৪ থেকে ৮ বছর, ৯ থেকে ১২ বছর, ১৩ থেকে ১৬ বছরের শিশু ও কিশোরদের জন্য চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রাম বাংলার চিত্রাংকন করে কনিষ্ঠ (৪-৮)বছরের প্রতিযোগীদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অর্জন করেন, আরশিয়া, আরভিন, জারিন ও তাহি, (৯-১২) বছর প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অর্জন করেন রাকা, এম ইউসুফ, শ্রুতি ও ঈশরার সোলাইমান, (১৩-১৬) প্রতিযোগীদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রাংকন করে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান অর্জন করেন ঐশী, শান্ত, তাসিন ও ফাহানা। সন্ধ্যায় সংগঠনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ থেকে আগত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত বীর মুক্তিযুদ্ধাদের সম্মাননা প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সেক্টর কমান্ডরা ফোরাম যুক্ত রাষ্ট্র, বস্টন শাখা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক মাজহারুল ইসলামের রেকর্ডকৃত শুভেচ্ছা এবং নিউ ইংল্যান্ডের অত্যন্ত সুপরিচিত মুখ বিশিষ্ট উপস্থাপিকা আয়েশা দেওয়ান লিপির সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন নিবাফের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপার্সন এবং মেলা কমিটির চীফ অর্গানইজার নাহিদ সিতারা নজরুল।

স্বাগত বক্তব্য এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা শক্তি জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে অনুষ্ঠানটি কর্ডিনেট করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা বস্টন প্রবাসী ইউসুফ চৌধুরী। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য বিশেষ অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ থেকে আগত বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক গবেষক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, বীর মুক্তিযুদ্ধা নাসির উদ্দিন চৌধুরী; নিউইয়র্ক থেকে আগত আমেরিকা বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক মুক্তিযুদ্ধা লাভলু আনসার ও যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডর ফোরামের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধা রাশেদ আহমেদ। জাতির জনকের ৭ই মার্চেও ভাষণ নিজ কণ্ঠে ধারণ করে অবিকল হুবহু প্রকাশ করে শুনান বোস্টন প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাক তালুকদার। অনুষ্ঠানে মূলধারার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অন্যতম জ্যান ডেভেরেউক্স ভাইস মেয়র অফ ক্যামব্রিজ প্রধান অতিথি, স্যাম্বুল সিদ্দিকী ক্যামব্রিজ সিটি কাউন্সিলার বিশেষ অতিথি, শামিম হোসাইন প্রথম সচিব, বাংলাদেশ কনসুলেট জেনারেল নিউ ইয়র্ক বিশেষ অতিথি এবং চৌধুরী পারভিন সুলতানা ডেপটি কন্সুলার জেনারেল বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। অতিথিবৃন্দ আয়োজক সংগঠনকে ধন্যবাদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অতিথিবৃন্দ বাংলাদেশ থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল হক চৌধুরী ও নাসির উদ্দিন চৌধুরি, নিউইয়র্ক থেকে আগত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা রথিন্দ্রনাথ রায়, লাভলু আনসার, রেজাউল বারি, আবুল বশর চুন্নু, রাশেদ আহমেদ, পেন্সিল্ভেনিয়া থেকে আগত মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের মিয়াঁ, নিউ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর থেকে আগত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ইউসুফ চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান, সাইদ শওকত রহমান, মোস্তাক তালুকদার, ড. সৈয়দ আবুল হাসনাত, মং ছাঁতই চৌধুরী, মোঃ শহিদুল ইসলাম, রাতুল কান্তি বডুয়া ও খলিলুর রহমানের হাতে সম্মাননা সনদ ও ক্রেস্ট তুলে দেন। সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধাগণ একাত্তরের চেতনাকে বুকে ধারণ করে স্বাধীনতা বিরোধীদের যে কোন ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় নিজেদের সদা প্রস্তুতির প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্য নগদ পুরুস্কারসহ সনদ বিতরণ করেন মুক্তিযোদ্ধাগণ। উল্লেখ্য এবারই বিজয়ী প্রথম স্থান অধিকারীদেও নগদ এক শত ডলার, দ্বিতীয় পঁচাত্তর ডলার, তৃতীয়কে পঞ্চাশ ডলার এবং চতুর্থ স্থান অধিকারীকে নগদ পঁচিশ ডলার প্রদান করা হয়। এদিকে বিকাল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বিরামহীন ভাবে চলতে থাকে নিউ ইয়র্ক থেকে আগত বাংলাদেশ কনসুলেট জেনারেলের ভ্রাম্যমাণ সেবাদান কর্মসূচি। কাউন্সুলার চৌধুরী সুলতানা পারভিনের তত্ত্বাবধানে মোঃ শামীম হোসাইন প্রথম সচিব, শেখ তারেক আলী প্রশাসনিক কর্মকর্তা, মোঃ মনির হোসাইন প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সেলিম হোসেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সেবা প্রদান করেন। দ্বিতীয় দিনে বোস্টনে কন্সুলার সেবাদান কর্মসূচি ৩৬৪ রিঞ্জ এভিনিউ কমিনিটি রুমে অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যায় রাওয়ান রমজান বাংলা স্কুলের শিক্ষিকা কামরুন নাহার কান্তার পরিচালনায় এবং রূহানী মমতাজ সঙ্গীত নিকেতনের শিক্ষিকা তত্ত্বাবধানে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। শুরুতে কোরান তেলয়াত করেন স্কুল ছাত্রী তানহা। ছিল সোলও সঙ্গীত, একক সঙ্গীত, গান, কবিতা, ছড়া গল্প এবং অভিনয়। অংশগ্রহণ করেন শান্ত, রাকা, শ্রুতি, দেবিকা, কেশব, আরবিন, তানহা, মকলেস, শ্রেয়া ও সুস্মিত। কবিতা আবৃত্তি করেন স্কুল শিক্ষিকা কামরুন নাহার কান্তা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় শিল্পী সৌরভ বডুয়ার গানের মাঝেই গানের ডালি নিয়ে মঞ্চে আসেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পী এস আই টুটুল ।

হলভর্তি দর্শক হাততালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানান । আর শিল্পী একের পর এক তাঁর প্রিয় এবং দর্শকদের পছন্দের গান গুলো গভীর রাত পর্যন্ত গেয়ে শুনান। মেলায় বিভিন্ন দোকান সাজিয়ে বসেন প্রবাসের বিভিন্ন বাঙালি ব্যবসায়িরা। শাড়ি, গহনা, রকমারি খাওয়ার দোকান, ফুসকা, চটপটি, সমুচা, রকমারি মিষ্টি, ছোলাবুট, বিরয়ানীসহ নানান দেশী খাওয়ারের পসরা ছিল। তাছাড়া কবি ফেরদৌস জেসমিনের লেখা নিজস্ব প্রকাশনায় বিভিন্ন পুস্তকের সমাহার নিয়ে বুক স্টলও ছিল। সন্ধ্যার পর শাড়ি গহনার দোকানের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মত। নিউ ইংল্যান্ড বাংলাদেশী আমেরিকান ফাউন্ডেশন ইনক (নিবাফ) এর মেলা কমিটির সদস্যরা হলেন চীফ কর্ডিনেটর নাহিদ সিতারা, ডিরেক্টর পাবলিক রিলেশন ও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট তাহেরা আহমেদ মিতু, অ্যাডিশনাল চিপ কর্ডিনেটর তাহমিনা হাসান কনা, অরগানাজিং সেক্রেটারি ফাহমিদা মালিক, ম্যাগাজিন ও লিটারেচার ফেরদৌস জেসমিন, ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট ফারহানা খোরশেদ, কালসারাল এক্টিভিটিস রাজু বডুয়া, অরগানাইজিং সেক্রেটারি কামরুন নাহার কান্তা, হোটেল অ্যান্ড গ্যাস্ট ম্যানেজমেন্ট মোস্তফা মোহাম্মদ, ওয়েব অ্যান্ড মিডিয়া তহফাতুল ইসলাম মিল্টন, টেকনোলজি ডিজাইন এমরান পাঠান । বর্ষবরণ উপলক্ষে এবছরও কবি ফেরদৌস জেসমিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাংলাঘর।

কবিতা বাণী ছড়া এবং বিজ্ঞাপন ছাড়াও এ বছর বস্টনের কিছু অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ডাঃ শাহীন মিয়ান ,অধ্যাপক জানে আলম ,কাজী নুরুজ্জমান, ওয়াহিদ শেখ, রাতুল কান্তি বডুয়া, পারভিন আসিফ চৌধুরীর জীবনীও ম্যাগাজিনে স্থান পায়। দিলারা জামান দীয়া, নাজমুন নেসা পিয়ারী, মিতালী মুখার্জী, বেলাল মোহাম্মদ জীবন, অনুপমা দেওয়াঞ্জি, শবনম আমীর, দিরুবা শাহাদাৎ, ছন্দা দাস, শাহ আলম দুলাল, ফরিদা খানম, এন এইচ রিপন, সাজেদা কামাল, রুনু হক, সাহেরা আফছা, কোর আয়েশা বেগম মুন্নি, সৃষ্টি নিজামী, ফারজানা ফারজু, সায়লা মুসাব্বির ইভার গল্প কাহিনী কবিতা ছড়া ম্যাগাজিনকে বহুমাত্রিকতা দিয়েছে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রবেশ মূল্য থাকলেও মেলা উপভোগ, কনসুলার সেবাদান, স্থানীয় শিল্পী ও স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পরিবেশিত অনুষ্ঠান উপভোগ ছিল সৌজন্যমূলক।