বস্টনে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে তোলপাড়

ঠিকানা রিপোর্ট : স্বজনদের বুকফাটা আহাজারি আর প্রবাসীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চিরবিদায় জানানো হলো যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনে পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সৈয়দ ফয়সাল আরিফকে (২০)। গত ৭ জানুয়ারি বাদ জোহর বস্টনের রক্সবিউরি মসজিদে জানাজা শেষে তার মরদেহ স্থানীয় গোরস্থানে দাফন করা হয়। জানাজার প্রাক্কালে আরিফের মা-বাবা, দাদি এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা কফিনে হাত বুলিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আর্তনাদে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে এবং এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত প্রবাসীরা স্বজনদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন এবং তাদের চোখও অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

বস্টন : সৈয়দ ফয়সল হত্যার প্রতিবাদে প্রতিবাদ সমাবেশ।


এদিকে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের রাজধানী বস্টনে পুলিশের গুলিতে সৈয়দ ফয়সাল আরিফের মৃত্যুর ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ক্যামব্রিজ সিটি হল প্রাঙ্গণে তারা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। ফয়সালের নির্মম মৃত্যুর ঘটনায় দেশেও প্রতিবাদ হচ্ছে। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে সচেতন নাগরিক সমাজের উদ্যোগে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিহত ফয়সালের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষও এ ঘটনায় খুবই ব্যথিত। তারা এই হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার চান। ফয়সাল আরিফের মৃত্যুর ঘটনায় সমবেদনা জানিয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। গত ৪ জানুয়ারি বুধবার দুপুরে ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসের বস্টন ক্যাম্পাসের নবীন ছাত্র ফয়সাল আরিফ ক্যামব্রিজ সিটিতে নিজ বাসার সন্নিকটে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন। পরে ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তার মৃত্যু হয়। আরিফের বুকে পাঁচটি গুলি বিদ্ধ হয়। পুলিশ দাবি করেছে, আরিফ খালি গায়ে একটি ছুরি হাতে ছিলেন এবং নিজেকে জখমের চেষ্টা করছিলেন। এ অবস্থায় হটলাইনে ফোন পেয়ে ডজনখানেক পুলিশ সেখানে গিয়ে তাকে নিবৃত করার চেষ্টা করলে আরিফ সাড়া না দিয়ে দৌড়ে পালাতে থাকেন। পুলিশ আরো জানায়, টেস্টনাট স্ট্রিট ধরে দৌড়ানোর একপর্যায়ে হঠাৎ উল্টো পুলিশের দিকে ছুরি উঁচিয়ে আসছিলেন তিনি। এ অবস্থায় পুলিশ গুলি করতে বাধ্য হয় বলে মিডলসেক্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ম্যারিয়েন রায়ান গণমাধ্যমকে জানান।

বস্টন : সৈয়দ ফয়সল হত্যার প্রতিবাদে প্রতিবাদ সমাবেশ।


তবে স্থানীয় এক টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ওই এলাকার বাসিন্দা এক নারী নিজেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে বলেন, আরিফের হাতে কোনো ছুরি তিনি দেখেননি। এ ছাড়া পুলিশের বিতরণকৃত ভিডিও ফুটেজেও আরিফের হাতে কিছু দেখা যায়নি এবং তার বাম হাতে একটি বই ছিল। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ ও ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির পক্ষ থেকে সবার কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে, জানতে চাওয়া হয়েছে পুলিশ গুলি করার সময় আরিফের হাতে আদৌ কোনো ছুরি ছিল কি না। ক্যামব্রিজের পুলিশ কমিশনার ক্রিস্টিন ইলো সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যেকোনো মৃত্যুই বেদনাদায়ক। আমরা আরিফের মৃত্যুকেও সহজভাবে নিচ্ছি না। সরেজমিনে তদন্ত চলছে। যদি অন্যায়ভাবে গুলি চালানো হয়ে থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট অফিসারের বিরুদ্ধে অবশ্যই যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।
ফয়সাল আরিফের দেশের বাড়ি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুরের দাঁতমারা গ্রামে। ২০১৫ সালে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন তিনি। ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্টের বস্টন ক্যাম্পাসে কম্পিউটারবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিলেন ফয়সাল। তার পরিবারের প্রায় সবাই বস্টনে বসবাস করেন। তিন বছর আগে ফয়সাল তার বাবা-মায়ের সঙ্গে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ক্যামব্রিজে আসেন। ফয়সাল আরিফের দাদা দাঁতমারার শিক্ষক মরহুম সৈয়দ আবুল বশর। ফয়সাল ছিলেন মো. মুজিবুর রহমান এবং শাহেদা বেগম দম্পতির একমাত্র সন্তান। আরিফের বাবা মুজিবুর রহমান দেশে একজন এমএলএফ ডাক্তার ছিলেন। তিনি বস্টন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা।
মার্কিন প্রশাসনের এই ব্যাখ্যা মেনে নিতে পারছেন না ফয়সালের বাবা মো. মুজিবুর রহমান। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের কোনো খারাপ অভ্যাস ছিল না। এমনকি আমাদের পরিবারের কেউ কোনো অপরাধে জড়ায়নি কখনো। দেশেও আমাদের পরিবারের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। ছেলেকে গুলি করে হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।’ তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরো বলেন, ‘ও ছিল খুবই মেধাবী। আশা করেছিলাম সে ইঞ্জিনিয়ার অথবা ডাক্তার হবে কিন্তু এখন সব আশা শেষ হয়ে গেল।’
এদিকে ফয়সালকে পুলিশ গুলি করে হত্যার ঘটনাটি মুহূর্তের মধ্যে বস্টনসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন প্রবাসীরা। ফয়সাল হত্যায় জড়িত দোষী পুলিশের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পরদিন ৫ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে ক্যামব্রিজ সিটি হলের সামনে শত শত প্রবাসী জড়ো হয়ে প্রতিবাদ জানান। ওই সমাবেশে বস্টন, ক্যামব্রিজসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার নানা শ্রেণি-পেশার প্রবাসীরা অংশ নেন। এ সময় তারা ‘স্পিক আপ, স্ট্যান্ড আপ’, ‘জাস্টিস ফর ফয়সাল’, ‘স্টপ পুলিশ ব্রুটালিটি’ স্লোগান দেন। প্রবাসীরা ন্যায়বিচার প্রার্থনার পাশাপাশি এমন বর্ণবিদ্বেষমূলক হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। একই সঙ্গে তারা অভিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সংশ্লিষ্ট নগর কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানান।

বস্টন : সৈয়দ ফয়সল হত্যার প্রতিবাদে প্রতিবাদ সমাবেশ।


প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নির্দোষ শিক্ষার্থী ফয়সাল আরিফকে পুলিশ কর্তৃক হত্যার ঘটনা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ফয়সালের করুণ মৃত্যুতে তার পরিবার ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছে। তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের জানা নেই। তাই দোষী পুলিশদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
ক্যামব্রিজ সিটির মেয়র সুম্বুল সিদ্দিকী ও কাউন্সিলম্যান বুরহান আজিম বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন নিউ ইংল্যান্ড বাংলাদেশি আমেরিকান ফাউন্ডেশনের (নিবাফ) কর্মকর্তারা। ক্যামব্রিজ সিটি মেয়র ও কাউন্সিলম্যানের উদ্যোগে খুব শিগগির ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি ও পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে তারা আলোচনা করবেন বলে উল্লেখ করে নিবাফ।
অন্যদিকে ফয়সাল আরিফ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে ৯ জানুয়ারি সোমবার দুপুরে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে সচেতন নাগরিক সমাজের মানববন্ধনে দাবি ওঠে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে হত্যাকাণ্ডের ব্যাখ্যা চাওয়ার। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের কথা বলে নিজ দেশে মানবাধিকার কেন নেই, সে প্রশ্নও ওঠে মানববন্ধন থেকে। মানবাধিকার নিয়ে রাজনীতি ও ব্যবসা না করার কথাও বলেন বক্তারা। তবে ঢাকায় মানববন্ধনের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, এ ধরনের কর্মসূচিকে উৎসাহ দেয় না মন্ত্রণালয়। আর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, মানববন্ধনের আগে তারা আমাদের চিঠি দিতে পারত। তিনি বলেন, মার্কিন সরকার আশ্বস্ত করেছে ফয়সাল হত্যার ন্যায়বিচার হবে। পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ফয়সাল আরিফের মৃত্যুর ঘটনায় একই দিন সম‌বেদনা জা‌নি‌য়ে‌ছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। দূতাবাসের মুখপাত্র জেফ রিডেনের দেওয়া বিবৃ‌তি‌তে বলা হয়, মার্কিন দূতাবাস সৈয়দ ফয়সালের পরিবার ও প্রিয়জনদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের আহ্বানকে সমর্থন করে মা‌র্কিন জেলা অ্যাটর্নি অফিসের মাধ‌্যমে পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্তের জন্য অনুরোধ জানানো হবে।