বহিষ্কার ও পদত্যাগ নিয়ে বিএনপিতে অস্থিরতা

রাজনৈতিক ডেস্ক : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে মাঠের বিরোধীদল বিএনপি। কিন্তু এক দিকে বহিষ্কার অন্য দিকে পদত্যাগের কারণে দলটিতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করায় গত ২০ দিনে তৃণমূলের দেড় শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

প্রতিক‚ল পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করছেন সাবেক এমপিসহ প্রভাবশালী নেতারা। স্থায়ী কমিটির এক সদস্যসহ একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা পদত্যাগ করতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। অনেক নেতা ইতোমধ্যে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।

তারা দলের কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের প্রায় গুটিয়ে নিয়েছেন। এসব নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। বিএনপির এক নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পদত্যাগের কয়েকটি কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। অনেক ব্যবসায়ী নেতাকে বিদেশে যেতে বাধা দিচ্ছে সরকার। কারও কারও পাসপোর্ট ফেরত দেয়া হচ্ছে না।

আবার অনেকের ব্যবসায় কর, ভ্যাটসহ নানা ঝামেলা রয়েছে। বিএনপির সঙ্গে জড়িত থাকায় অনেক নেতার ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা। ভবিষ্যতে আরও হয়রানির শিকার হতে পারেনÑ এমন শঙ্কায় নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

পদত্যাগকারী কয়েক নেতা দলের হাইকমান্ডকে এমনটা জানিয়েছেনও। ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষা, রাজনৈতিক হয়রানি থেকে নিষ্কৃতি পেতেই তারা পদত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। তবে পদ-পদবি নিয়ে অসন্তোষ ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে মূল্যায়ন না করাও পদত্যাগের আরেকটি কারণ বলেও স্বীকার করেন ওই নীতিনির্ধারক।

তবে দল থেকে পদত্যাগ করা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন বিএনপির হাইকমান্ড। নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে কিংবা সরকারের চাপে দুর্বল চিত্তের কেউ কেউ দল ছাড়তে পারে বলে মনে করেন তারা। এতে দলে সার্বিকভাবে কোনো প্রভাব পড়বে না।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বহিষ্কার এবং দল থেকে পদত্যাগের বিষয়ে করণীয় নিয়ে সম্প্রতি দলের সিনিয়র নেতারা আলোচনা করেন। দল ছেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন তারা। বিষয়টি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অবহিত করা হয়।

পদত্যাগের পাশাপাশি বহিষ্কার নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। গত ২০ দিনে তৃণমূলের দেড় শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তাদের অধিকাংশই বহিষ্কার হয়েছেন।

দলের শৃঙ্খলা ফেরাতেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান নীতিনির্ধাকরা। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, তৃণমূলের বিপুলসংখ্যক নেতাকে বহিষ্কার দুঃখজনক।

তবে দলের শৃঙ্খলার স্বার্থে এর বিকল্প ছিল না। পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সুসময়ে অনেকেই দলে ভিড় করেন। দুঃসময়ে নিজেদের রক্ষায় কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন। এ নিয়ে দলে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ বলেন, এসব পদত্যাগে বিএনপির রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। যারা যাচ্ছেন তারা রাজনীতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, সরকারের নানামুখী চাপের কারণে কেউ কেউ পদত্যাগপত্র দিচ্ছেন।

আমরা এসব পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছি না। বহিষ্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতেই দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে। দলের শৃঙ্খলার স্বার্থেই এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর পদত্যাগের মধ্য দিয়ে দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিলেও পরে তিনি বিকল্পধারায় যোগ দেন।

ভাইস চেয়ারম্যান ইনাম আহমেদ চৌধুরী পদত্যাগ করে সরাসরি যোগ দেন আওয়ামী লীগে। গত মাসে পদত্যাগ করেন এক সময়ের প্রভাবশালী নেতা দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য, খুলনা মহানগরের সাবেক আহŸায়ক ও খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগার লবী।

২৫ ফেব্রæয়ারি পদত্যাগ করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও ফতুল্লা থানা সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহ আলম। গত ১৬ মার্চ পদত্যাগ করেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-অর্থবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তরের সহসভাপতি মোহাম্মদ শাহাবউদ্দিন।

এ পর্যায়ের নেতারা পদত্যাগপত্রে কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত সমস্যা, অসুস্থতা ও পারিবারিক সমস্যার কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারের চাপ এবং নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই তারা দল ছাড়ছেন বলে মনে করেন বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

এ দিকে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত তৃণমূলের দেড় শতাধিক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তারা উপজেলা ভোটে অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ শনিবার ১৮ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে তৃণমূলের এসব নেতাই ছিলেন সর্বাগ্রে। তাদের বহিষ্কার করা নিয়েও দলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। একটি অংশ মনে করে, দলীয় শৃৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তাদের বহিষ্কারের কোনো বিকল্প ছিল না। তবে বহিষ্কারের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ নিয়ে কারও কারও আপত্তি রয়েছে। বিপুলসংখ্যক নেতার বহিষ্কারের খবরে তৃণমূলে আরও অস্থিরতা ও হতাশা সৃষ্টি হতে পারে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, যেসব নেতা দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করে উপজেলা ভোটে অংশ নিচ্ছেন, তাদের বহিষ্কার করছে না বিএনপি। তারা বিজয়ী হলে কিংবা পরবর্তীকালে দলে ফেরার আবেদন করলে তাদের ক্ষমা করে পদ ফিরিয়ে দেয়া হতে পারে। আর যারা স্বপদে থেকেই ভোটে অংশ নিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

বিএনপির এক নীতিনির্ধারক বলেন, উপজেলা নির্বাচন কেন্দ্র করে বহিষ্কার নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এটা বলতে গেলে একটা রুটিন কাজ। দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ায় রুটিনমাফিক তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। সুবিধাজনক সময়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে।

অতীতেও তাই হয়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ইউপি, উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনেও অন্তত দুই শতাধিক মাঠের নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে ৯০ ভাগের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ৩০ ডিসেম্বর প্রহসনের নির্বাচনের পর আমরা তৃণমূলের মতামত গ্রহণ করি। তারা উপজেলা নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না বলে মত দেন। তাদের মতের ভিত্তিতেই দলের হাইকমান্ড উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এখন অনেকেই দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এখানে সরকারি দল এবং বিভিন্ন এজেন্সির চাপও রয়েছে তাদের ওপর। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে তাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে। তৃণমূলের সুপারিশের ভিত্তিতেই তাদের বহিষ্কার করায় এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়বে না।

দল থেকে পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যারা দুর্বল চিত্তের তারাই পদত্যাগ করতে পারে। নিজেদের সম্পদ রক্ষায় এবং সরকারের নানামুখী চাপে কেউ কেউ হয়তো এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এতে দলের কোনো ক্ষতি হবে না।