খলকু কামাল
আদি নিবাস সিলেট শহরের শেখঘাট ছাড়ার পর নিউ ইয়র্কে বসতি গড়েছি প্রায় ৩ যুগ আগে। একজন খেটে খাওয়া দিনমজুর হিসেবে সপ্তাহে ৫ দিন রিজিকের ধান্ধায় ব্যস্ত থাকার পরও স্বদেশ এবং স্বজনদের স্মৃতি সতত মানসপটে ভেসে উঠে। তাই সীমিত বিচার-বিবেচনা ও অভিজ্ঞতার আলোকেত বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নকল্পে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদয় বিবেচনার জন্য কিছু পরামর্শ উপস্থাপন করছি।
আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে আমেরিকার ন্যায় দেশের আনাচে-কানাচে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উপর অধিক হারে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, আমেরিকার উন্নয়নের পেছনে রয়েছে অত্যাধুনিক স্বাস্থ্য সেবা ও আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি। তাই বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও শিক্ষিত এবং সুস্থ সবল জাতির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
দেশ ও ১৬ কোটি জনগণের স্বার্থে ৬৪টি জেলা শহরে একটি করে মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপন করা হলে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা স্বল্প খরচে চিকিৎসা ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে। আর দেশের প্রয়োজন মেটানোর পর অবশিষ্ট প্রকৌশলী এবং চিকিৎসকদের বিদেশে চাকরি সৃষ্টির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্র আয় করা যাবে। তাছাড়া অপেশাদার ও অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে না পাঠিয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শ্রমিক বিদেশে প্রেরণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিচারে দেশ ও জাতির উন্নয়নে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ নিচে দেয়া হলো :
# ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীতে ৩টি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তাই সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী অবশিষ্ট ৫টি বিভাগীয় শহরে সিলেট, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল ও রংপুরে জরুরি ভিত্তিতে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করলে ঢাকার উপর অনেক চাপ কমে যাবে।
৬৪টি জেলা সদরে সরকারি নীতিমালা মোতাবেক একটি করে ৫০ আসনের মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে জাতীয় উন্নয়নে গতি সঞ্চারিত হবে।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহরে একটি করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে সুস্থ সবল জাতিগঠন সহজ হবে।
দেশের প্রতিটি জেলার গুরুত্ব রয়েছে। বাড়ছে জনসংখ্যার চাপ। জেলা শহর ও অন্যান্য উপজেলার অসুস্থ নাগরিক উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনে বড় বড় শহরে যাচ্ছেন। তাই দেশের প্রতিটি জেলা সদর সরকারি হাসপাতালগুলোকে ৫০০ আসনে উন্নীত করে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অত্যাধুনিক হাসপাতালে রূপান্তর যাতে প্রতিটি জেলার রোগীরা আর ঢাকামুখী না হয়ে ভয়াবহ যানজটকে এরিয়ে নিজ জেলা শহরে স্বল্প খরচে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার সাথে একজন সুনাগরিক সব মৌলিক চাহিদা হিসেবে স্বাস্থ্য সেবা পেতে পারে।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে সঙ্গতি বজায় রেখে বিদ্যমান ৪৯২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে একশত আসনে রূপান্তর এবং প্রয়োজনীয় ডাক্তার, নার্স আধুনিক মেশিনারীজ যন্ত্রপাতিসহ সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরা হলে স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত হবে।
উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে বর্তমান ৪টি বিভাগীয় শহর ঢাকার বুয়েট ও টুয়েট, চট্টগ্রামে চুয়েট, খুলনার কুয়েট ও রাজশাহীতে রুয়েট নামে মোট ৫টি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যারয় রয়েছে। তাই দেশের উচ্চশিক্ষার স্বার্থে নতুন নীতিমালা তৈরি অর্থাৎ বাকি বিভাগীয় শহর সিলেট, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও রংপুরে একটি করে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে মেধাসম্পন্ন ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ সহজ হবে।
দেশের ৬৪টি জেলা সদরে একটি করে ১০০ আসনের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য।
দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে মহিলা শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে।
সরকারি নীতিমালা মোতাবেক প্রতিটি বিভাগীয় শহরে একটি করে মহিলা ইন্সটিটিউট স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
দেশের প্রতিটি জেলা সদরে সরকারি মহিলা ডিগ্রি কলেজগুলোকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রূপান্তর করলে নিজ নিজ জেলার যাত্রীরা পরিপূর্ণ নিরাপত্তার সাথে কম খরচে সুন্দর পরিবেশে নিজেদের শহরে মাস্টার্স কোর্স সম্পূর্ণ করতে পারবে।
সরকারি নীতিমালা মোতাবেক প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দ্রুত বাস্তবায়ন হলে দেশের শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে।
সরকারি নীতিমালা মোতাবেক প্রতিটি জেলা সদরে একটি করে নার্স ইন্সটিটিউট স্থাপনের প্রয়োজনীয়তাকেও গৌণ ভাবার উপায় নেই।
দেশের প্রতিটি উপজেলা সদরে একটি করে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট স্থাপন করা হলে সকল উপজেলায় দক্ষ জনশক্তি তৈরির পথ সুগম হবে। দক্ষ জনশক্তি বাইরে পাঠালে বছরে অতিরিক্ত হাজার হাজার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে। সাথে সাথে তারা নিজেরাই স্বাবলম্বী হবে।
দেশের প্রতিটি উপজেলা সদরে একটি করে মহিলা ডিগ্রি কলেজ স্থাপন। এতে করে তারা নিজেদের উপজেলায় স্বল্প খরচে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সাথে ডিগ্রি পাশ করতে পারবে।
দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মানুষ গড়ার কারখানা অর্থাৎ যাতে প্রতিটি যুবক দক্ষ জনশক্তি হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পারে, তার জন্য একটি করে কারিগরি স্কুল স্থাপন করার অনুরোধ রইল।
প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে বালক ও বালিকা হাইস্কুল স্থাপন অথবা বর্তমানে যেগুলো মানসম্মত আছে ওইগুলোকে জাতীয়করণের পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য বলে মনে করি।
প্রতিটি জেলার সাথে ঢাকার সড়ক যোগাযোগ আরো উন্নীতকরণ এবং বর্তমান সড়কগুলোকে চার লেনে রূপান্তর করা হলে যুগের চাহিদা পূরণ হবে।
দেশের প্রতিটি উপজেলার সড়কগুলোকে ২৪ ফুট চওড়া করলে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো তড়িত ও সহজ হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমানোর নিমিত্ত জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করছি।
স্বপ্নের সুনামগঞ্জ-নেত্রকোণা মহাসড়ক জরুরি ভিত্তিতে নির্মাণ করা হোক।
অতি প্রয়োজনীয় লাখ লাখ প্রবাসীদের স্বার্থে সিলেট-আখাউড়া ডাবল রেল লাইন দ্রুত নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
আরিচা-দৌলতদিয়া টানেল নির্মিত হলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন গতি আসবে।
ঘোড়াশাল-টঙ্গী সড়ক চার লেনে রূপান্তর করা হলে যাতায়াত ব্যবস্থায় নতুন প্রাণ সংযোজিত হবে।
দেশের কোটি প্রবাসী যাত্রীদের স্বার্থে ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে বিমানবন্দর রেল স্টেশন পর্যন্ত দ্রুত টানেল নির্মাণ হলে প্রবাসী যাত্রীরা পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সাথে দ্রুত যাতায়াত করতে পারবেন।
রেল যোগাযোগ উন্নয়নে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-যশোর রেলপথ নির্মাণ এবং ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
ঢাকা-টঙ্গী রেল লাইনকে চার লেনে দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হোক।
সিরাজগঞ্জ-বগুড়া রেল লাইন নির্মাণ হলে ঢাকা ও রংপুরের মধ্যে ১১২ কিলোমিটার দূরত্ব কমবে এবং যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘব হবে।
দেড় ঘন্টায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাতায়াতের স্বার্থে দ্রুত বুলেট ট্রেন সার্ভিস চালুর কার্যক্রম অনতিবিলম্বে হাতে নেয়া উচিত।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ঘুনধুম রেল লাইন দ্রুত নির্মাণ হলে পর্যটন শিল্পের উন্নতি হবে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মিত হলে ব্যবসা-বাণিজ্য নতুন প্রাণচাঞ্চল্য পাবে।
বাংলাবান্ধা, ভারত, নেপাল, ভুটানের মধ্যে নতুন রেল লাইন নির্মাণ করা হলে চারটি দেশের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে চারটি দেশই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে।
দেশের প্রতিটি উপজেলাকে আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তোলার স্বার্থে প্রথমে উপজেলা সদরকে পৌরসভায় রূপান্তর করার প্রস্তাব করছি।
উপজেলা সদরে গ্যাস সরবরাহ। গ্যাস সুবিধা না থাকলে সিলিন্ডার গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি উপজেলা সদরে আধুনিক ওয়াসা স্থাপন পূর্বক দূষণমুক্ত ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারি নীতিমালা মোতাবেক প্রতিটি উপজেলা সদরে দ্রুত একটি করে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ অনতিবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।
সরকারি নীতিমালা মোতাবেক প্রতিটি উপজেলা সদরে একটি করে মিনি স্টেডিয়াম স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ করা হোক।
মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে ন্যূনতম মাসে দেড় হাজার রিয়াল নিশ্চিত করার জন্য আইন পাশকরণ। ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম আইন রয়েছে। একই সাথে বিদেশে গমণেচ্ছুকদের হয়রানী লাঘবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক প্রেরণের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন তৈরি এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরার দাবি সর্বস্তরের প্রবাসী জনতার।
প্রবাসী যাত্রীদের নিñিদ্র নিরাপত্তা ও যাতায়াতের সুবিধার জন্য শাহজালাল বিমানবন্দর এবং ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে একটি ওভারব্রীজ নির্মাণ এবং সেই সঙ্গে ক্যান্টনমেন্ট রেলওয়ে স্টেশনে সকল আন্তঃনগর ট্রেনের ৫ মিনিটের বিরতির ব্যবস্থা গ্রহণ করার সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।
চা শিল্প উন্নয়নে বহির্বিশ্বের চা প্রধান দেশসমূহ থেকে বিশেষজ্ঞ এনে চা শিল্পের আধুনিকীকরণ ও ৫৫টি মুসলিম দেশের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে চা রফতানির উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
লাখ লাখ প্রবাসীদের স্বার্থে ঢাকা এয়ারপোর্টে নতুন একটি রানওয়ে নির্মাণ করা হলে বিমান উঠানামা অতি দ্রুত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সহজ হবে।
চট্টগ্রামে ও সিলেট এয়ার পোর্টকে পূর্ণাঙ্গ এয়ারপোর্টে রূপান্তরের দাবি বহু দিনের। বর্তমানে লাখ লাখ প্রবাসীদের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের এয়ার লাইনগুলোকে সে সকল এয়ারপোর্ট অবতরণের পারমিশন দেয়া হলে ঢাকা এয়ারপোর্ট প্রবাসী যাত্রীদের ভোগান্তি ও সময়ক্ষেপণ অনেক কমে যাবে।
লেখক ও সমাজসেবক, নিউইয়র্ক।