ঠিকানা রিপোর্ট: জাতিসংঘের চলতি হাই-লেভেল পলিটিক্যাল ফোরামে (এইচএলপিএফ) বাংলাদেশের আয়োজনে গত ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত হল ‘টেকসই উত্তরণের লক্ষ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণ-পথ নির্বিঘœ করতে স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে সহযোগিতা প্রদান’ শীর্ষক সাইড ইভেন্ট। নিউইয়র্কের মিলেনিয়াম হিলটন হোটেলে অনুষ্ঠিত এই সাইড ইভেন্টে কী-নোট স্পীচ প্রদান করেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
জাতিসংঘ যখন বাংলাদেশকে এলডিসিভুক্ত করে তখন বাংলাদেশে ছিল নানা ধরনের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা -সেই প্রেক্ষাপট থেকে আজকের অবস্থানে আসতে কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ, অর্থমন্ত্রী তা তুলে ধরেন। এসডিজি বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, এটি নির্ভর করে সে দেশের সরকারের সদিচ্ছার উপর। এক্ষেত্রে এবছর মার্চ মাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের গ্রাজুয়েশন ক্রাইটেরিয়া পূর্ণ করার সাফল্যগাথার উদাহরণ টানেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, “উত্তরণের অগ্রযাত্রায় আমরা প্রথমে হিসাব কষলাম; আমরা কোথায় ছিলাম, আমাদের দুর্বলতাসমূহ কী কী, আর আমাদের কী কী ক্ষেত্রে সক্ষমতা রয়েছে। এরপর আমরা আমাদের নিজস্ব সীমিত সম্পদ, তহবিল ও কলা-কৌশল ব্যবহার করে এবং জনগণকে সাথে নিয়ে উন্নয়নের দিকে পা বাড়ালাম। আমরা জাতিসংঘ প্রদত্ত গ্রাজুয়েশন ক্রাইটেরিয়া প্রথমবারের মতো পূর্ণ করলাম”। এটি স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য উদাহরণ হতে পারে মর্মে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জসহ বাংলাদেশের মতো উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথাও উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী। উত্তরণ প্রক্রিয়া নির্বিঘœ করতে এসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসা এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বিশ্বের অ-নবায়নযোগ্য সম্পদের ব্যবহারে আরও সতর্ক হওয়ার জন্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। উন্নয়নকে টেকসই করতে এসকল প্রাকৃতিক সম্পদ পরবর্তী প্রজন্মও যাতে ব্যবহারের সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করার কথাও উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং স্বল্পোন্নত, ভূবেষ্টিত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রসমূহের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ফেকিতামোইলোয়া কাতোয়া ইউতোইকামানু বলেন, “স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ নির্বিঘœ করা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা নিশ্চিত করা গেলে উত্তরণ সম্পূর্ণভাবে সফল হবে। অর্থাৎ এটি হবে টেকসই”। তিনি উত্তরণকে একটি দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার স্বাক্ষর বলে অভিহিত করেন যার মধ্যে দিয়ে দেশটির পর-নির্ভরতা হ্রাস পায়। তিনি উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোকে প্রতিটি সুবিধা ও সম্ভাবনার কার্যকর ব্যবহার করতে প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। কাতোয়া ইউতোইকামানু আরও বলেন, উত্তরণকে নির্বিঘœ করতে সদ্য উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করার জন্য উন্নয়ন অংশীদারদের প্রতি জোর আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। টেকসই উত্তরণ নিশ্চিতে তিনি সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
ভূটানের অর্থমন্ত্রী নামগে দরজী উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ভূবেষ্টিত দেশ ভূটানের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। জাতিসংঘে নিযুক্ত মালদ্বীপের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ড. আলী নাসির মোহামেদ ও ক্যাবো ভারদে’র স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত জোসে লুইস ফিয়ালহো রোচা উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিজ নিজ দেশের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।
অনুষ্ঠানটিতে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। উচ্চ পর্যায়ের এই পলিসি ডায়ালগে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনকারী দেশসমূহ বিশেষ করে বাংলাদেশের টেকসই উত্তরণ নিশ্চিত এবং উত্তরণ প্রক্রিয়াকে বাধাহীন করতে তিনি ছয়টি পয়েন্ট উল্লেখ করেন। এগুলো হল: ১) বৈশ্বিক আলোচনার অবধারিত প্রয়োজনীতা ২) উত্তরণের পথে থাকা দেশগুলোর অর্থনৈতিক ও বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক কর্মসূচিতে সংশ্লিষ্ট থাকার অগ্রাধিকার যাতে কোন কারণে বাধা প্রাপ্ত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখা ৩) এলডিসি’র দেশ হিসেবে প্রাপ্ত সুবিধা বঞ্চিত হওয়ার ক্ষেত্রে সৃষ্ট সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় আনা ৪) নীতিগত ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনা ৫) বাধাহীন উত্তরণ কৌশল বিনির্মাণ, ৬) স্বল্পোন্নত থেকে যে পাঁচটি দেশ উত্তরিত হয়েছে তাদের উত্তরণ পথের চ্যালেঞ্জসমূহ বিবেচনায় আনা।
আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী শফিকুল আজম, ইউএনডিপির এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ও জাতিসংঘের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হাওলিয়াং ঝু, জাতিসংঘের এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কমিশন (ইউএন-এসকাপ)-এর ডেপুটি এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি কাভে জাহেদি, জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভোলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এর প্রধান রোনাল্ড মল্লিরুস। বক্তাগণ টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়ন ও স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়া একই সূত্রে গাঁথা মর্মে উল্লেখ করেন। উত্তরণকে মসৃণ বা বাধাহীন করতে টেকসই অর্থায়ন, অসমতা দূর, প্রযুক্তিগত ব্যবধান হ্রাস, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাসহ এসডিজির লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের পাশে দাঁড়াতে উন্নত দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানান।
চলতি এইচএলপিএফ উপলক্ষে বাংলাদেশের এই সাইড ইভেন্টটির সহ-আয়োজক ছিল ইউএন-এসকাপ, মালদ্বীপ মিশন এবং ইউএন-ওএইচআরএলএলএস। অনুষ্ঠানটির মডারেটর ছিলেন ইউএন-ওএইচআরএলএলএস এর পরিচালক হেইদি ফক্স। উল্লেখ্য, ১৮ জুলাই মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণার মধ্য দিয়ে এবারের এইচএলপিএফ শেষ হবে।